সংক্ষিপ্ত


কৃষি আইন (Farm Laws 2020) বিরোধী আন্দোলনকে গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে এনে দাঁড় করিয়েছিল দিল্লির ট্রাক্টর সমাবেশ (Republic Day tractor rally)। কী ঘটেছিল সেই দিন, বেশ কিছু প্রশ্ন নিয়ে এখনও রয়েছে রহস্য। 

২০২০ সালে নতুন ৩ কৃষি আইন (Farm Laws 2020) প্রবর্তনের পর থেকেই এই আইনের বিরোধিতায় আন্দোলন শুরু করেছিলেন বিভিন্ন রাজ্যের কৃষকরা। তবে, কৃষক আন্দোলনকে এক দারুণ গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে এনে দাঁড় করিয়েছিল ২০২১ সালের ২৬ জানুয়ারি, দিল্লির ট্রাক্টর সমাবেশ (Republic Day tractor rally)। তার আগে প্রায় গোটা ডিসেম্বর মাস ধরে সরকারের সঙ্গে কৃষক নেতাদের আলোচনা হয়েছিল। সরকার বেশ কিছু সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছিল কৃষি আইনে, কিন্তু, কৃষকদের সাফ বক্তব্য ছিল - আইন প্রত্যাহার করতে হবে। দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা যখন আর একেবারেই এগোচ্ছে না, সেই সময় আন্দোলককে পরবর্তী পর্যায়ে নিয়ে যেতে প্রজাতন্ত্র দিবসের দিন, দিল্লিতে ট্রাক্টর সমাবেশ কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন কৃষকরা। 

অনেক টালবাহানার পর শর্তসাপেক্ষে এই কর্মসূচির অনুমতি দিয়েছিল দিল্লি পুলিশ (Delhi Police)। তবে একই সঙ্গে দিল্লি পুলিশ জানিয়েছিল, ট্র্যাক্টর সমাবেশে বিঘ্ন ঘটানোর পরিকল্পনা করেছে পাকিস্তান। ২৬ জানুয়ারি, কৃষকরা গাজীপুর (Gazipur), সিংগু (Singhu) এবং টিকরি (Tikri) সীমান্তে জড়ো হয়েছিলেন। কৃষক সংগঠনগুলির দাবি অনুসারে মোট ২ লক্ষ ট্র্যাক্টর সেই সমাবেশে অংশ নিয়েছিল। প্রথমে নির্ধারিত পথ অনুসরণ করেই এই মিছিল চলছিল, কিন্তু, পরে সেই রাস্তা থেকে বিচ্যুত হয়ে তারা অন্যান্য রাস্তাতেও ঢুকে পড়ে। এই নিয়ে বিক্ষোভকারী কৃষকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ শুরু হয়েছিল। যা ক্রমে, ট্রাক্টর সমাবেশ কর্মসূচিকে একটি হিংসাত্মক ঘটনায় পরিণত করেছিল। 

বিক্ষোভকারীরা, ব্যারিকেড ভেঙ্গে আইটিও মেট্রো স্টেশন এবং শহরের কেন্দ্রস্থলের দিকে মিছিল করা শুরু করেছিল। দিল্লি পুলিশকে কাঁদানে গ্যাস এবং লাঠিচার্জ শুরু করে। বিক্ষোভকারীরাও পাল্টা একটি ডিটিসি বাস ও পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর করে। পুলিশের দাবি, বিক্ষোভকারীরা লাঠি, লোহার রড, পাথর নিয়ে আক্রমণ করেছিল। কিছু কিছু নিহঙ্গ সম্প্রদায়ের মানুষ ঘোড়ায় পিঠে ছিল এবং তাদের কাছে তরবারি, কৃপান এবং ফুরসার মতো ধারালো অস্ত্রশস্ত্র ছিল। বিক্ষোভকারীদের কয়েকজন এমনকী ট্রাক্টর নিয়ে পুলিশকে চাপা দিয়েছে, এমন অভিযোগও করে পুলিশ। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তার ট্রাক্টর উল্টে তার তলায় চাপা পড়ে এক কৃষকেরও মৃত্যু হয়। 

এর মধ্যে আন্দোলনকারীদের একাংশ পৌঁছে যায় দিল্লির ঐতিহাসিক লাল কেল্লায়। লালকেল্লার গম্বুজের উপর থেকে ভারতের জাতীয় পতাকা খুলে ফেলে পতাকার খুঁটিতে শিখ ধর্মীয় পতাকা, নিশান সাহেব লাগিয়ে দেয়। পুলিশ ও কৃষকদের মধ্যে সংঘর্ষে দুর্গের ভেতরে অন্যান্য অংশেরও ক্ষতি হয়। দিল্লি পুলিশের মতে এই ঘটনায় ৩৯৪ জন পুলিশ সদস্য এবং হাজার হাজার কৃষক আহত হয়েছিলেন। দিল্লি পুলিশের ৩০ টি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, দিল্লিতে অতিরিক্ত আধাসামরিক বাহিনী মোতায়েন করেন। কৃষক সংগঠনগুলির পক্ষ থেকে হিংসায় উস্কানি দেওয়ার জন্য এবং লাল কেল্লায় একটি নিশান সাহেব পতাকা উত্তোলনের জন্য অভিনেতা তথা সমাজকর্মী দীপ সিধু এবং গ্যাংস্টার থেকে সমাজকর্মী হওয়া লাখা সিধানাকে দোষারোপ করেছিল।

কৃষখ আন্দোলনকে পরিচালনা করেছে যে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা বা এসকেএম, তাদের বেশ কয়েকজন নেতার মতে, ২৬ তারিখের ঘটনা ছিল কৃষকদের আন্দোলনের পক্ষে প্রথম বড় ধাক্কা। এসকেএম নেতা যোগেন্দ্র যাদব মেনে নিয়েছেন, আয়োজক হিসাবে তাঁদের আরও শৃঙ্খলা দরকার ছিল। অনেক বড় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রয়োজন ছিল। কিন্তু, ট্রাক্টরগুলি যখন লালকেল্লার দিকে যাচ্ছিল, তখন কেন কেউ বাধা দিল না? প্রজাতন্ত্র দিবসে দিল্লিতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের, তার মধ্যে লালকেল্লা প্রাঙ্গনে কেন কেউ তাদের প্রবেশ করতে বাধা দিল না? এই সব প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। পুলিশকর্মীরা নাকি বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সেলফি তুলছিলেন, এমন অভিযোগও করেছেন তিনি। সব মিলিয়ে কৃষক আন্দোলনকে ধ্বংস করতে ওই দিনের হিংসার পিছনে রাষ্ট্র জড়িত ছিল কিনা, সেই প্রশ্নও উঠেছে।

এসকেএমের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তাঁরা অনেকেই ভেবেছিলেন, ২৬ জানুয়ারির ঘটনার পর কৃষক আন্দোলন শীঘ্রই পথ হারাবে। কারণ ২৬ জানুয়ারির ঘটনা ছিল আন্দোলনকে প্রতিহত করার গভীর ষড়যন্ত্র। অত্যধিক পুলিশ বাহিনী ব্যবহার করা, স্থানীয়দের বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে উসকে দেওয়া, প্রতিবাদ আন্দোলনে সাম্প্রদায়িক রঙ লাগানো - বিক্ষোভকারীদের সকল দিক থেকে নিশানা করা হয়েছিল। কিন্তু, এত কিছুর পরেও কৃষকদের ঐক্য ভাঙেনি। আন্দোলন ফের পথ খুঁজে পেয়েছিল। আরও বেশি সংখ্যক লোক প্রতিবাদে যোগ দিয়েছিল। সিংগু, টিকরি এবং গাজিপুরে প্রতিবাদীদের প্রতি সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল আশেপাশের গ্রামবাসীরাও। 

তবে সহজে ট্র্যাকে ফেরেনি এই আন্দোলন। এর জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছিল কৃষক সংগঠনগুলিকে। ২৬ জানুয়ারির ঘটনার পর এসকেএম-এর প্রধান নেতারা অন্তত চার দিন ঘুমাতে পারেননি। একাধিক স্তরে তাদের লড়াই করতে হয়েছে। প্রথমত, এসকেএম নেতাদের জীবনের ঝুঁকি ছিল, তাদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দেওয়া। দ্বিতীয়ত, প্রতিবাদের ক্ষতি করছে যারা, তাদের চিহ্নিত করে থামানো। তৃতীয়ত, দিনরাত নিয়মিত আবেদন করে কৃষকদের ঘরে ফিরে যাওয়া থেকে বিরত রাখা। এভাবেই ফের আন্দোলন তার গতি পেয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত, বছরের শেষে কৃষকের এই আন্দোলন সাফল্যও পেয়েছে।