সংক্ষিপ্ত


গত দু'মাস ধরে চলেছে নৌবাহিনীর অপারেশন সমুদ্র সেতু ২

তাদের মূল মন্ত্র নিঃশব্দ পরিষেবা

করোনার সময়ও তারা সেই নিঃশব্দেই পরিষেবা দিয়ে গেল

কী কী ভাবে জাতীয় সংকট মোকাবিলায় সহায়তা করল বাহিনী

গত দু'মাস ধরে, নৌবাহিনী কোভিডের দ্বিতীয় তরঙ্গের মোকাবিলায় জাতীয় প্রচেষ্টায় সহায়তার জন্য অপারেশন সমুদ্র সেতু ২ পরিচালনা করছে। এই অভূতপূর্ব জাতীয় সংকটের জন্য অনেক ক্ষেত্রে স্বাভাবিক পদক্ষেপের বাইরে গিয়ে সমাধানে পৌঁছানোর জন্য উদ্ভাবন এবং সংশোধন প্রয়োজন। সমস্যার প্রকৃতি অনুসারে, ভারতীয় নৌবাহিনী পদক্ষেপ নিয়েছে।
 
জাতীয় স্তরে মেডিকেল অক্সিজেনের চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে ভারতীয় নৌবাহিনীকে ইন্দো-প্রশান্ত মহাগরীয় বিভিন্ন দেশ থেকে তরল মেডিকেল অক্সিজেন বয়ে এনেছে এবং খালি সিলিন্ডার নিয়ে গিয়েছে। অপারেশন সমুদ্র সেতু-২ এর অংশ হিসাবে, সমুদ্রে যে কোনও চ্যালেঞ্জ গ্রহণের জন্য প্রস্তুত রণতরীগুলি দ্রুত পারস্য উপসাগর থেকে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত ভারত মহাসাগর অঞ্চল জুড়ে বন্ধুত্বপূর্ণ বিদেশী দেশগুলিতে স্থাপন করা হয়েছিল। নৌবাহিনীর তিনটি কমান্ড থেকে ডেস্ট্রয়ার, ফ্রিগেটস এবং অ্যাম্ফিবিয়ান জাহাজ সহ দশটি যুদ্ধজাহাজ দ্রুত তরল মেডিকেল অক্সিজেন, কনসেন্ট্রেটর, পিপিই, কোভিড পরীক্ষার কিট, ভেন্টিলেটর এবং অন্যান্য চিকিৎসা সরঞ্জামে ভরা কন্টেইনারগুলি নিতে পশ্চিম এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে পৌঁছেছিল।

৫ মে, যখন কর্ণাটকের কোভিড পরিস্থিতি দারুণ চ্যালেঞ্জিং ছিল আইএনএস তলওয়ার বাহারিন থেকে ৫৫ মেট্রিক টন তরল অক্সিজেন নিয়ে এসেছিল ম্যাঙ্গালোরে। এতে করে অগণিত মানুষের জীবন রক্ষা পেয়েছিল। ঘটনাচক্রে, ওই সময় জলদস্যুদের বিরুদ্ধে ব্যবসায়ী জাহাজগুলিকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য আইএনএস তলওয়ার পশ্চিম আরব সাগরে মোতায়েন ছিল। জাহাজটি অবিলম্বে নতুন প্রয়োজনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে সেই অভিযান সফল করেছিল। এটা,  'হর কাম দেশ কে নাম' - নৌবাহিনীর এই অন্তর্নিহিত নমনীয়তা এবং কর্মের দৃঢ় সংকল্পের প্রমাণ।
 
তলওয়ার যখন রুক্ষ আবহাওয়ায় বাড়ির পথে আসছিল অক্সিজেন সরবরাহের জন্য, সেই সময়ের সমুদ্রের বিপজ্জনক দিনগুলির কথা বর্ণনা করেছেন জাহাজটির এক নাবিক। তিনি বলেছেন, জাহাজটি চলার সময় প্রতি মুহূর্তে ডেকের উপর নজরদারি চালাতে হচ্ছিল, যাতে সবকিছু নিরবচ্ছিন্নভাবে বাঁধা থাকে। জোরালো বাতাস এবং জোর ঢেউ-এর মধ্যে সবকিছু সুরক্ষিত আছে কি না, তা পরীক্ষা করার জন্য তিনি একটি হার্নেস পরে অক্সিজেন কনটেইনারগুলির উপরে উঠতেন। কাজটা চ্যালেঞ্জিং হলেও দেশের জন্য তা অত্য়ন্ত গুরুত্বপূর্ণ জানতেন বলেই ভয় পাননি কখনও।
 
পরের কয়েকদিনে, আরও চারটি জাহাজ ৯ টি কনটেইনার, প্রায় ২০০০ টি অক্সিজেন সিলিন্ডার এবং অন্যান্য স্টোরেজে ২৫০ টন মেডিকেল অক্সিজেন নিয়ে মুম্বই এবং নিউ ম্যাঙ্গালোরে পৌঁছেছিল। প্রতিটি জাহাজ থেকে সেইসব সহায়তা নামিয়ে পরবর্তী দৌড়ের জন্য ফের মোতায়েন করা হয়েছিল। পরবর্তী অভিযানগুলিতে সৌদি আরব, ওমান এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহি থেকে সহায়তা এনেছিল। এরমধ্যে, পূর্ব সমুদ্রে নৌবাহিনীর জাহাজগুলি ব্রুনেই, সিঙ্গাপুর এবং ভিয়েতনামের কাছ থেকে সহায়তা পরিবহণ করে এনেছিল চেন্নাই এবং বিশাখাপত্তনমে।

সব মিলিয়ে সমুদ্র সেতু ২-এর জন্য মোতায়েন করা জাহাজগুলি মহামারির বিরুদ্ধে জাতীয় লড়াইয়ে প্রয়োজনীয় সহায়তা আনতে প্রায় ৯০,০০০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ১৪টি ভ্রমণ করেছিল। সাত সপ্তাহ ধরে অন্যান্য গুরুতর চিকিত্সা সহায়তা ছাড়াও ১০৫০ টন তরল মেডিকেল অক্সিজেন এবং ১৩,৮০০ টি অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে এসেছিল। নিকটবর্তী নৌ ঘাঁটি থেকে জাহাজগুলি লাক্ষাদ্বীপ এবং মিনিকয় দ্বীপপুঞ্জের জন্য একটি অক্সিজেন এক্সপ্রেসও স্থাপন করেছিল। স্থানীয় জনগণের সহায়তার জন্য অক্সিজেন সহ চিকিত্সা সহায়তা নিয়ে নিয়মিত এই দ্বীপপুঞ্জগুলিতে নিয়ে যাওয়া হত। তাউকতে ঘূর্ণিঝড় ওই অঞ্চলে ধ্বংস চালিয়ে যাওয়ার পরও স্থানীয় প্রশাসনকে সমস্ত প্রয়োজনীয় সরবরাহ অব্যাহত রেখেছিল নৌবাহিনী।

প্রতিটি অভিযানে করোনাভাইরাস সতর্কতা মানা হয়েছিল। নৌ-বাহিনীর সদস্যরা নিজেদের এবং সহায়তা সরবরাহকারীদের নিরাপদ রাখতে কোনও সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিতে বাকি রাখেনি। বাহিনীর অনেক পুরুষ ও মহিলা সদস্যদের পরিবারের লোকজন করোনাভাইরাসে সংক্রামিত হয়েছিল। তারপরও তারা তাদের কর্তব্য পালন করা বন্ধ করেনি। ব্যক্তিগত জীবনের পরিস্থিতি নির্বিশেষে সকলেই তাদের দায়িত্ব পালন করেছেন।
 
ভারতীয় নৌবাহিনীর মূল মন্ত্র 'সাইলেন্ট সার্ভিস' অর্থাৎ 'নিঃশব্দ পরিষেবা', সেটা যে শুধু কথার কথা নয়, তা এই সমুগ্র সেতু -২ অভিযানের সময় আবারও প্রমাণ হয়েছে।