সংক্ষিপ্ত
২০২১-এর পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের কিছুদিন আগে থেকে বারবার প্রকাশ্যে আসতে থাকে রুজিরা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী রুজিরাকে নিয়ে সেভাবে কোনও দিনই কোনও খবর হয়নি। ফলে সে সময় তাঁর নামে ওঠা অভিযোগের তালিকা সকলকেই অবাক করে দিয়েছিল।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পিসি শাশুড়ি। স্বামী অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। এমনই এক পরিবারের গৃহবধূ রুজিরা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেভাবে কোনওদিনই প্রকাশ্যে খবরের শিরোনামে আসতে দেখা যায়নি। বন্দ্য়োপাধ্যায় পরিবারের ঘনিষ্ঠদের দাবি, রুজিরা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেকে লো-প্রোফাইল রাখতে ভালোবাসেন। তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তথা ডায়মন্ড হারবারের তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী রুজিরার নাম খবরের শিরোনামে আসে ২০১৯ সালে কলকাতা বিমনাবন্দরে তৈরি হওয়া এক বিতর্কে। যে বিতর্কে রুজিরার বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে সোনা পাচারের অভিযোগ উঠেছিল। ভারতীয় শুল্ক বিভাগের অভিযোগ ছিল অবৈধভাবে মাত্রারিক্ত সোনা ব্যাগে করে থাইল্যান্ড থেকে কলকাতায় নিয়ে আসেন। যদিও পরে কলকাতা হাইকোর্ট রুজিরার বিরুদ্ধে আনা শুল্ক বিভাগের অভিযোগ খারিজ করে দেয়।
কে এই রুজিরা বন্দ্যোপাধ্যায়
রুজিরা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে সেভাবে বিস্তারিত কোনও তথ্য পাওয়া যায় না। তবে রুজিরার ঘনিষ্ঠদের সূত্রে যে তথ্য পাওয়া গিয়েছে তাতে জানা গিয়েছে রুজিরা ভারতীয় বংশোদ্ভূত হলেও থাইল্যান্ডের নাগরিকত্ব রয়েছে তাঁর। রুজিরার কাছে ওভারসিজ সিটিজেন অফ ইন্ডিয়া বা ওসিআই-এর কার্ড রয়েছে। বিয়ের আগে রুজিরা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম ছিল রুজিরা নারুলা। জানা গিয়েছে নারুলা পরিবারের ব্যাঙ্ককে হোটেল ব্যবসা ছিল। পরে আমদান-রফতানি-সহ অন্য আরও ব্যবসায় যুক্ত নারুলা পরিবার। সেই সঙ্গে অলঙ্কার ও সোনার ব্যবসাও রয়েছে তাঁদের। তবে রুজিরার নামেও রয়েছে বিভ্রাট। কারণ অনেকের মতে তাঁর নাম জসমিত আহুজা। পরে অবশ্য রুজিরার পরিবার দিল্লিতে চলে আসে। দিল্লির রাজৌরি গার্ডেন এলাকার বাসিন্দা ছিলেন বর্তমানে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পত্নী। সেখানে তাদের একটি পারিবারিক মোবাইলের দোকানের ব্যবসা ছিল। যা বেশ জনপ্রিয়। পরে রিয়েল এস্টেটের ব্যবসাও করত রুজিরার পরিবার। যাতায়াত ছিল থাইল্যান্ডেও। দিল্লিতে পড়তে গিয়ে রুজিরার সঙ্গে আলাপ হয় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। উচ্চমাধ্যমিকের পর আইআইপিএম থেকে বিজনেস ম্যানেজমেন্ট পড়তে দিল্লি গিয়েছিলেন অভিষেক। জানা যায় সেখানেই তাঁর সহপাঠী ছিলেন রুজিরা। বন্ধুত্ব থেকে ভালোবাসায় পরিণত হয়। কলেজ থেকে সুইজারল্যান্ডে ট্রেনিংয়ে গিয়ে অভিষেক-রুজিরার সম্পর্ক আরও গভীর হয় বলে জানা যায়। তারপর তারা বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন। ২০১২ সালের ফেব্রয়ারি মাসে রুজিরাকে বিয়ে করেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। জানা যায় দিল্লিতে অভিষেক ও রুজিরার বিয়ের এলাহি আসর বসেছিল। সেই সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উপস্থিত থাকতে না পরালেও তাঁর দলের অনেক নেতাই হাজির হয়েছিলেন সেই রাজকীয় বিয়ের অনুষ্ঠানে। অভিষেকের বিয়ের খরচ নিয়েও বারবার তোপ দাগেন বিরোধীরা।
অভিষেক ও রুজিরার সম্পর্ক শুরুতে মেনে নিতে পারেননি মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়
এমনও শোনা যায় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ও রুজিরা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পর্ক শুরুতে মেনে নিতে পারেননি মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়। পরে অবশ্য প্রিয় ভাইপোর জেদের কাছে নতি স্বীকার করতে হয়েছিল পিসিকে। তবে বর্তমানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে রুজিরার সম্পর্ক মধূর। রুজিরা তার পরিবারের কাছে খুবই প্রিয়। অভিষেককেও খুবই ভালোবাসেন শ্বশুর বাড়ির লোকেরা। মেয়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য দক্ষিণ কলকাতার রাসবিহারীতে একটি বাড়িও রুজিরার পরিবার কেনে বলে জানা যায়। এমনকী অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও একাধিকবার ব্যাঙ্ককে গিয়েছেন বলে জানা গিয়েছে। নানা বিতর্কে জড়ানোর আগে সুখেই সংসার চলছিল রুজিরার। দুটি সন্তানও রয়েছে তাদের। রুজিরা ও অভিষেকর পরিবারে প্রথম হয় কন্যা সন্তান। নাম আজানিয়া। ২০১৯ সাল ফের তাদের পুত্র সন্তান হয়। ছেলের নাম আয়ানাশ।
রুজিরা বন্দ্যোপাধ্যায় নিয়ে বিতর্কিত বিষয়
এবার আসা যাক রুজিরা বন্দ্যোপাধ্যায় নিয়ে বিতর্কিত বিষয়ে। রুজিরার বাবার নাম নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। ২০০৯ সেলের ১৪ নভেম্বর প্যানকার্ড পান রুজিরা। বিয়ের পর ওভারসিজ সিটিজেন অফ ইন্ডিয়া কার্ডের (ওসিআই) জন্য আবেদন করেন তিনি। তবে ২০১০ সালের ৮ জানুয়ারি রুজিরার পিআইও কার্ড দিয়েছিল থাইল্যান্ডের ভারতীয় দূতাবাস। সেখানে তাঁর বাবার নামের জায়গায় লেখা আছে নিফন নারুলা। কিন্তু কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তরফ থেকে জানানো হয়, নিয়মমাফিক ওসিআই কার্ড পাওয়ার জন্য বিয়ের সার্টিফিকেট জমা দিয়েছিলেন রুজিরাবন্দ্যোপাধ্যায়ের। সেই সার্টিফিকেটে আবার দিল্লির বাসিন্দা গুরশরণ সিং আহুজা নামে এক ব্যক্তিকে বাবা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। দু জায়গায় বাবার নাম ভিন্ন হওয়ায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের শোকজের মুখে পড়তে হয় রুজিরা বন্দ্যোপাধ্য়ায়কে।
কয়লাপাচারকাণ্ডে কীভাবে নাম জড়াল রুজিরার
২০২০-র ২৭ নভেম্বর সিবিআই-এর দুর্নীতি দমন শাখা বেআইনি কয়লা পাচার নিয়ে একটি মামলা দায়ের করে। এই মামলা দায়ের হয়েছিল ইস্টার্ন কোলফিল্ডস লিমিটেডের আওতাধীন সমস্ত কয়লা খনিতে। এই মামলায় মূল অভিযুক্ত হিসাবে নাম ওঠে অনুপ মাঝি ওরফে লালার, যাকে সকলে কয়লা মাফিয়া বলে আসানসোল অঞ্চলের মানুষ চেনেন এবং পুলিশের খাতাতেও তাঁর অপরাধ নথিভুক্ত রয়েছে। এছাড়াও এই কেসে ইসিএল-এর জেনারেল ম্যানেজার অমিতকুমার ধর, জয়েশচন্দ্র রাই, ইসিএল-এর চিফ সিকিউরিটি অফিসার তন্ময় দাস এবং সিকিউরিটি ইন্সপেক্টর কুনুসতোরিয়া ধনঞ্জয় রাই এবং এসএসআই ও সিকিউরিটি ইনচার্জ দেবাশিস মুখোপাধ্যায়-এর নামে অভিযোগ দায়ের করে সিবিআই। এই মামলার তদন্তে নেমে সিবিআই দাবি করে এমন কিছু তথ্য প্রমাণের যাতে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রুজিরা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম জুড়ে গিয়েছে। সিবিআই-এর দাবি ছিল, লালার কাছে থেকে বেআইনি কয়লা পাচারের মোটা অর্থ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে যাচ্ছে। আর এই টাকা জমা পড়ছে রুজিরা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে। সিবিআই এমন অভিযোগ করেছিল। এরপর থেকেই এই বেআইনি কয়লাপাচারকাণ্ডে লাগাতার নানা সময়ে অভিষেক ও রুজিরাকে জেরা করেছে সিবিআই। এই কেসের হাত ধরে প্রবেশ করে ইডি। তারা বেআইনিভাবে অর্থ তচ্ছরূপের অভিযোগ নিয়ে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রুজিরা বন্দ্যোপাধ্যায়কে জেরার জন্য সমন পাঠায়।
আরও পড়ুন, 'যাবজ্জীবন মানে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত কারাবাস', খুনের মামলায় স্পষ্ট করল এলাহবাদ হাইকোর্ট
কেন রুজিরার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা
কয়লাপাচারকাণ্ডে দিল্লিতে জেরার জন্য রুজিরাকে ডেকে পাঠিয়েছিল সিবিআই। কিন্তু বারবার জেরা এড়িয়ে গিয়েছেন রুজিরা। দিল্লিতে থাকলেও তিনি জেরার জন্য কেন্দ্রীয় সংস্থার তদন্তকারী অফিসারদের সামনে আসেননি বলেও অভিযোগ। এরপর রুজিরার বিরুদ্ধে পাতিয়ালা হাউস কোর্টে হাজির হয় সিবিআই। জেরায় যাতে রুজিরা আসেন তার জন্য আদালতে আবেদন করা হয়। এই মামলায় আদালতে শুনানি হলেও একবার রুজিরা হাজির হননি। এমনকী বিচারক বলার পরেও তিনি শুনানিতে যাননি। তাই একে আদালত অবমাননা বলেই মনে করছে পাতিয়ালা হাউস কোর্ট। আর সেই কারণে রুজিরাকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যদিও এই গ্রেফতারি জামিনযোগ্য।
কত টাকার মালিক রুজিরা বন্দ্যোপাধ্যায়
সামপ্রতিক কোনও বিশ্বাসযোগ্য তথ্য এই নিয়ে প্রকাশ্যে নেই। তবে ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় যে এফিডেভিট জমা করেছিলেন তাতে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। সেখানে দেখা যাচ্ছে, রুজিরা একটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ৫০১৬৪৪টাকা ৪৮ পয়সা রয়েছে। এছাড়াও ৮৭ হাজার টাকার মতো নগদ অর্থ সে সময় তাঁর কাছে মজুত ছিল। এর বাইরে ২২ লক্ষ টাকার সোনার গয়না এবং ৩ লক্ষ টাকার পেইনটিং তাঁর কাছে ছিল। এই সম্পত্তির মোট হিসাব সেই সময় ছিল ৩৫.৫৫ লক্ষ টাকা।