সংক্ষিপ্ত

ডক্টর মহম্মদ আহমেদ নঈমি- ধর্মশিক্ষায় এক পরিচিত নামে বলেই শিক্ষা জগতে বিবেচিত হন। বর্তমানে তিনি নয়াদিল্লির হামদর্দ ইউনিভার্সিটির থিওলজি বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসাবে কর্মরত। কাজের ফাঁকে ফাঁকে মাদ্রাসাতে গিয়ে অনুপ্রেরণামূলক ভাষণও দেন তিনি। 

 

পেশাদারিত্বের অভাবে ধুকছে ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে থাকা মাদ্রাসাগুলি। এর পাঠ্যক্রম কোনওভাবেই বর্তমানের সময়োপোযোগী নয়। অবিলম্বে মাদ্রাসাগুলির পাঠ্যক্রমের খোলনলচে এক্কেবারে বদলে ফেলার সময় এসে গিয়েছে বলেই মনে করছেন ধর্মশিক্ষার অধ্যাপক ড. মহম্মদ আহমেদ নঈমি। নয়াদিল্লির হামদর্দ ইউনিভার্সিটির থিওলজি বিভাগের এই সহকারী অধ্যাপকের মতে, একটা সময় ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় এক উজ্জ্বল এবং বর্ণময় উপস্থিতি ছিল মাদ্রাসাগুলির। উদার শিক্ষা ব্যবস্থার অন্যতম পীঠস্থান ছিল বলা যায়। কিন্তু, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর পাঠ্যক্রমের কোনও আধুনিকীকরণ হয়নি। ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। নঈমির মতে, এর জেরে মাদ্রাসাগুলি এখন ধুকছে।

আওয়াজ দ্য ভয়েস নামে এক ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে মাদ্রাসাগুলি নিয়ে নিজের উদ্বেগ গোপন করেননি নঈমি। কাজের ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন মাদ্রাসায় যাওয়া এবং সেখানে গিয়ে অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য পেশ করাটা তাঁর নেশার মধ্যে পড়ে। এর মূল উদ্দেশ্যই হল যাতে নতুন করে ছাত্রদের মনের মধ্যে মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে আগ্রহ এবং আকর্ষণ তৈরি করা যায়।

ড. মহম্মদ আহমেদ নঈমির মতে, ভারতের বুকে থাকা মাদ্রাসগুলির একটা সময় বর্ণময় অধ্যায় ছিল। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় এক মূল্যবান অবদান তৈরি করেছিল মাদ্রাসাগুলি। কারণ, মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার মূল লক্ষ্যই ছিল সামগ্রিক শিক্ষার আধারে মানুষকে তৈরি করা। যার জন্য মাদ্রাসাগুলিতে শুধু যে ধর্মশিক্ষার পাঠ দেওয়া হত এমনটা নয়, এর সঙ্গে সঙ্গে অত্যাধুনিক শিক্ষার দিকগুলোকেও চিনিয়ে দেওয়া হত। মাদ্রাসা থেকে যারা শিক্ষিত হতেন তাদের শিক্ষাক্রমের শেষে জামিয়া উলম বলে ডাকা হত। এরা অত্যাধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষা থেকে চিকিৎসাবিজ্ঞান এবং জ্যোতিষচর্চা, মহাকাশ বিজ্ঞান, অঙ্ক, দর্শন এবং তত্ত্ব শাস্ত্রেও পারদর্শী হতেন। কিন্তু, বর্তমান সময়ে মাদ্রাসাগুলিতে আর এই ধরনের শিক্ষা দেওয়া হয় না, আর দেওয়া হলেও তাতে সময়োপোযোগী বিষয়গুলি ব্রাত্য হয়েই থেকে গিয়েছে বলে মনে করছেন নঈমি।

ধর্মশিক্ষার এই অধ্যাপকের মতে, বর্তমান সময়ের মাদ্রাসাগুলির অধিকাংশ ছাত্র একটা নির্দিষ্ট গণ্ডীর মধ্যেই আবদ্ধ থাকছে। মাদ্রাসা থেকে বেরিয়ে এদের মধ্যে খুব কম সংখ্যকই পরবর্তী শিক্ষার ধাপে পা রাখতে পারছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পা-টাই রাখতে পারছে না। মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে আজ দেশে কুনজরে দেখা হয়। কারণ, এই মাদ্রাসা শিক্ষাকে এতটাই সঙ্কীর্ণ করে ফেলা হয়েছে যে এখান থেকে শিক্ষার পরবর্তী ধাপে বা পরবর্তী উন্নত শিক্ষার আঙিনায় প্রবেশের সুযোগটাই তৈরি হচ্ছে না। এর মূল কারণ অবশ্যই পাঠ্যক্রম বলে মনে করছেন ড. মহম্মদ আহমেদ নঈমি। 

এই সমস্যা নির্মূল করার ক্ষেত্রে মাদ্রাসগুলিকে ইংরাজি শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার বিষয়টিকেও মাথায় রাখতে হবে বলে মনে করছেন নঈমি। তিনি জানিয়েছেন, যখনই কোনও মাদ্রাসাতে তিনি বক্তব্য রাখতে যান সেখানে ইংরাজি শিক্ষা নিয়ে একটা উৎসাহ তৈরি করার চেষ্টা তিনি করেন। তিনি মনে করেন, মাদ্রাসা থেকে শিক্ষিত হওয়া বর্তমান সময়ের ছাত্রদের মধ্যে ইংরাজি ভাষা জ্ঞানের বড্ড অবহেলা রয়েছে। যার পরিণতি পরবর্তী উন্নত শিক্ষার সুযোগে বাধা তৈরি হচ্ছে। কারণ শুধুমাত্র উর্দু বা আরবিকেই উন্নত শিক্ষার সুযোগে নিজেকে লালিত করা জায়গাটা এক্কেবারেই সঙ্কীর্ণ। নঈমির মতে ইংরাজির প্রতি এই বৈরাগ্য মাদ্রাসা থেকে বের হওয়া পরিশ্রমী এবং প্রতিভাবান ছাত্রদের মনে হতাশা তৈরি করছে। আবার এদের মধ্যে যারা নিজেদেরকে বদলে ফেলে কলেজ এবং ইউনিভার্সিটির আঙিনায় পা রাখতে পারছে তারা কিন্তু পরবর্তী সময়ে উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থায় নিজের প্রতিভাকে কাজে লাগাতে সমর্থও হচ্ছে। সুতরাং, মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার পিছনের পরিচালন ব্যবস্থায় থাকা মানুষগুলোকে ভাবতে হবে। যদি কাঙ্খিত বদল সম্ভব হয় তাহলে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার ভোল শুধু বদলে যাবে না সেই সঙ্গে এইখান থেকে বের হওয়া ছাত্রদের অধিকাংশই পরবর্তী শিক্ষায় পা রেখে এক উন্নত জীবনের দিক খুঁজে পাবে বলেই ধারনা পোষণ করেছেন নঈমি।

শুধুই যে ধর্মশিক্ষার আধারে ছাত্রদের শিক্ষিত করলে হবে না তাও দ্ব্যর্থহীনভাবে বলে দিয়েছেন নঈমি। তাঁর মতে, ইসলামের অন্যতম বাণী হল যে মানুষকে স্বনির্ভর হতে হবে। মানুষ স্বনির্ভর হতে পারলে তবেই সমাজ এগোবে, তবেই দেশের উন্নতি হবে এবং সেই মানুষটিও দেশ ও সমাজের জন্য কোনও অবদান রাখতে পারবে। তাই মাদ্রাসাগুলিতে ধর্মীয় শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে স্বনির্ভরতামূলক কর্মমূখী শিক্ষারও দরকার রয়েছে। এর ফলে মাদ্রাসার সেই ছাত্রটি নিজেকে কর্মজীবনেও প্রতিষ্ঠা করার সুযোগগুলোকে ঝালিয়ে নেওয়ার দিশা পাবে বলেই মনে করেন নঈমি। এই একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি আরও জানিয়েছেন কিছু মাদ্রাসা ইতিমধ্যেই এই ধরনের ভোকেশনাল শিক্ষার আয়োজন করেছে। আর এদের ছাত্ররা বর্তমান সময়ে কেউ হাসপাতাল বা অন্যত্র কর্মসংস্থানের সুযোগও পেয়েছে।

মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় কী কোনওভাবে প্রথাগত শিক্ষার সুযোগগুলোকে সংযুক্ত করা যায় না? একান্ত সাক্ষাৎকারে এমন প্রশ্নেও জবাব দিয়েছেন ড. মহম্মদ আহমেদ নঈমি। তাঁর মতে, অবশ্যই করা যায়। এর ফলে মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্ররা তাদের হাইস্কুল পাশ করার সমতূল্য বা কলেজ পাশ সমতূল্য ডিগ্রিরও অধিকারী হওয়ার সুযোগ পাবে। নঈমি জানিয়েছেন, তামিলনাড়ু এবং কেরলের কিছু মাদ্রাসা ইতিমধ্যেই এমন শিক্ষা ব্যবস্থার চল শুরু করেছে এবং তারা এতে সফলও হয়েছে। এর ফলে উপকৃত হচ্ছে মাদ্রাসায় থাকা ছাত্রদের দল। কিন্তু, এটা শুধুমাত্র কয়েকটি রাজ্য বা অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না, এমন শিক্ষা ব্যবস্থার ধারণাটা দেশজুড়েই সমস্ত মাদ্রাসগুলিকে লালন করতে হবে। আর অবশ্যই ভুললে চলবে না যে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার যে বিষয়গুলো অচল হয়ে পড়েছে পাঠ্যক্রম থেকে তাকে বাদ দিতে হবে এবং সেই স্থানে বর্তমান সময়োপোযোগী বিষয়গুলোকে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে বলেই ফের একবার স্মরণ করিয়েছেন নঈমি। 
আরও পড়ুন- 
শিক্ষা থেকে ব্যবসা- যে ৭টি উপায়ে ভারতীয় মুসলমানরা দেশের সেবা করছে ও করতে পারে 
লিথিয়াম আবিষ্কার হলেও কি হাল ফিরবে জম্মু-কাশ্মীরের সালাল গ্রামের মানুষদের? চাকরি না পেয়ে হতাশ শিক্ষিত যুবকরা 
লাদাখ থেকে অরুণাচল প্রদেশ পর্যন্ত চিনা সেনার মোকাবিলা, কতটা মজবুত ভারতের অবস্থান