সংক্ষিপ্ত
খোতান- ভারতীয় সংস্কৃতির পীঠস্থান। এটির সঙ্গে ভারতের অনেক যোগ ছিল। বর্তমানে এই এলাকা চিনের দখল। অতীত মুছে ফেলা হচ্ছে।
খোতান, প্রাচীন রাজ্য- যা বর্তমানে চিনের জিনজিয়াং অঞ্চলের হোতান এলাকায় অবস্থিত। কিন্তু একটা সময় ছিল যখন এই এলাকাটি ছিল ভারতীয় সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ পীঠস্থান। খ্রিষ্ট্রের জন্মের কয়েক শতাব্দী আগে থেকেই এই খোতান রাজ্য সমৃদ্ধি লাভ করেছিল। বিকাশ লাভ করেছিল এই রাজ্য। প্রথম সহস্রাব্দের সময় অভিবাস ও আক্রমণের যে পালা শুরু হয়েছিল তার ছোঁয়া পড়েনি এই রাজ্যে। পশ্চিম ও পূর্বের অনেক বেশি শক্তিশালী রাষ্ট্রের আধিপত্য বিস্তার লাভ করেছিল। কিন্তু খোতান ট্রান্স -ইউরেশিয়ান বাণিজ্য রুটে একটি মরুদ্যান হিসেবে পরিচিত ছিল। রেশম উৎপাদন ও জেডেদের জন্য বিখ্যাত ছিল।
মরুদ্যান শহরটি ১০০৬ সালে মুসলিম কারা-খানিদ খানা জয় করার আগে হাজার বাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে সমৃদ্ধ ছিল। যার ফলে জিনজিয়াংয়ের ইসলামিকরণ ও তুর্কীকরণ হয়েছিল। খাতান প্রদেশের মাধ্যমে ভারত থেকে চিনে পৌঁছে গিয়েছিল বৌদ্ধধর্ম। খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দিতে এই এলাকায় একাধিক বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
খোতানের শাসকরা ছিল মহাযান বৌদ্ধ ধর্মের অনুশীলনকারী। যা বৈদিক ও তান্ত্রিক ঐতিহ্যকে মিশিয়েছিল। ইন্দ্র, শিব, বিষ্ণ ও সরস্বতীর মতো দেবতাদের স্বীকার করে। বুদ্ধদেবই তাঁদের প্রধান আরাধ্য। যদিও খোতানিরা কৃষ্ণেরও উপাসনা করতেন। এমনতি তাদের মাতৃভাষায় রামায়নের একটি সংস্করণও ছিল। যা তিব্বতি ভাষায় পরে অনুবাদ করা হয়েছিল। ভারতীয় গ্রন্থে উত্তরাকুরু নামে একটি শব্দের সঙ্গে এই অঞ্চলের যোগাযোগ রয়েছে।
এর ভাষাগুলিতে গান্ধারীর মতো ভারতীয় প্রাকৃতগুলি অন্তর্ভুক্ত ছিল, যা কাশ্মীরি, সংস্কৃত এবং খোতানিজ সাকার সাঙ্গে কিছু মিল রয়েছে, যার পরবর্তীতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে সংস্কৃত শব্দভাণ্ডার রয়েছে। একজন চীনা তীর্থযাত্রী জুয়ানজাং এবং খোতানিজ নথির তিব্বতি অনুবাদ অনুসারে, খতান খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে অশোক মৌর্যের রাজত্বকালে উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে অভিবাসীদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই অভিবাসীদের মধ্যে সম্ভবত কাশ্মীরিও ছিল।
রাজ্যটি ভারতের উত্তর পশ্চিমে গান্ধার ও কাশ্মীরের প্রাচীন রা্জ্যের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। তৃতীয় শতাব্দীর প্রথম দিকে মহাযান সম্প্রদায়কে টিকিয়ে রেখেছিল। যে দুটি বৌদ্ধগ্রন্থ তর্তাতীতভাবে চিনা বৌদ্ধধর্মের উপর সবথেকে বেশি প্রভাব ফেলেছে- দ্যা পারফেকশন অব ইউজডম ইন টুয়েন্টি ফাইভ থাউজ্যান্ড লাইন ও বুদ্ধবতমসক সূত্র, প্রাপ্তগ্রন্থগুলি থেকে প্রথমে চিনা ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল খোতান- যাথাক্রমে তৃতীয় ও পঞ্চম শতাব্দীরে।
রাজ্য প্রতিষ্ঠা নিয়ে পৌরানিক কাহিনিহুলি বুদ্ধ শাক্যমুনির নির্দেশে একটি হ্রদ নিষ্কাশনকে কেন্দ্র করে ও অতীতের বুদ্ধদের দ্বারা পরিকল্পিত।। এই পৌরানিক কাহিনিতে পরিদর্শনের ও আশীর্বাদের ভূমিকা রয়েছে। পৌরাণিক কাহিনিগুলি কাঙ্গিউরে সংরক্ষিত দুটি সূত্র ও টেঙ্গিউরে দুটি ভবিষ্যদ্বাণীমূলক ইতিহাসের আকারে তিব্বতি ভাষায় ক্যানোনিক্যাল ধর্মগ্রন্থ হিসেবে স্বতন্ত্রভাবে সংরক্ষিত। এগুলি ১৩ শতকের তিব্বতি পণ্ডিত চোমডেন রিকপাই রালট্রিত তালিকাভুক্ত প্রায় বিশটি গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে , যা খোতানিজ থেকে তিব্বতিতে অনুবাদ করা হয়েছে।
এই দুটি সূত্রের একটির অনুবাদ, দ্য প্রফেসি অন মাউন্ট গোশ্রিংগা, সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। এই সূত্রটি বর্ণনা করে যে বুদ্ধ একটি বিশাল দল নিয়ে খোটানে উড়ে এসেছিলেন এবং সেই মহান হ্রদে বসবাসকারী প্রাণীদের আশীর্বাদ করেছিলেন যা এখনও পর্যন্ত ল্যান্ডস্কেপ পূর্ণ করেছে। তিনি দেশের অন্যান্য বৈশিষ্ট্য, এর পবিত্র পর্বত, স্তূপ এবং স্থানগুলিকে পবিত্র করেন; সেখানে শিক্ষা দেয়; এবং ধর্মের অনুশীলন এবং সংরক্ষণের জন্য একটি জমি হিসাবে এর ভবিষ্যতের গুরুত্ব সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করে। সূত্রের শেষে, বুদ্ধ শিষ্য শরীপুত্র এবং ঐশ্বরিক রাজা বৈশ্রবণকে তাদের অলৌকিক শক্তি স্থাপন করতে এবং মহান হ্রদটিকে একটি নদীপথে নিষ্কাশন করতে বলেন। তারা একটি পর্বতকে দুটি বড় টুকরো করে কেটে ফেলে এবং এটিকে পথ থেকে সরিয়ে দেয় যাতে হ্রদটি গাইশো নামক একটি নিকটবর্তী নদীতে প্রবাহিত হতে পারে, যা সম্ভবত বর্তমানে কারাকাক্স নামে পরিচিত নদী বলে মনে করা হয়।
খোতানের প্রতিষ্ঠার পৌরাণিক কাহিনীতে আরেকটি পাহাড়ী স্থানের সাথে একটি ভাগ করা থিম পাওয়া যায়, কাঠমান্ডু উপত্যকা, একটি হ্রদ নিষ্কাশনের ফলে তৈরি হয়েছে বলেও বলা হয়। কাশ্মীরকে সতিসার নামে একটি পাহাড়ি হ্রদ থেকে জন্ম বলেও বলা হয়। কাঠমান্ডুর কিংবদন্তী- স্বয়ম্ভূর পবিত্র পাহাড় একটি মুখ্যভূমিকা পালন করে। স্বয়ম্ভু পুরাণ থেকে নেওয়া। সেখানেও বৌদ্ধ পাঠের বর্ণনা রয়েছে।
গল্পগুলির মধ্যে অনেক সময় সামঞ্জস্য রয়েছে। অনেক সময় নেই। কিন্তু তারপরেই দেশের ভাগ্য কিন্তু আলাদা হতে পারে না। নেপালের অনেক সমস্যা থাকা সত্ত্বেও কাঠমান্ডু উপত্যকাটির একটি ধর্মীয় গুরুত্ব রয়েছে। যাকে কেন্দ্র করে সেটি অনেক দূর ছড়িয়েছে। কিন্তু খোতানে তা হয়নি। ইতিহাসের অনেক কথাই হারিয়ে গেছে। কিন্তু এই এলাকার ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম ছিল।
দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে খোতানে বৌদ্ধ অতীতের সামান্যই অবশিষ্ট ছিল। চিনের শক্তির বেড়েছে - কমেশে। তিব্বতের সাম্রাজ্যের নাগাল তা অনেক সময়ই পায়নি। তাই দিনে দিনে সিল্ক রোডের গুরুত্ব কমে গেছে।
কিন্তু আজও খোতান ট্রান্স ইউরেশিয়ান বাণিজ্য রুটের একটি গুরুত্বপূর্ণ ল্যান্ডমার্ক। তবে এটি মনে করিয়ে দেয় চিনের ওপর ভারতীয় সংস্কৃতির প্রভাব দীর্ঘ দিনের।