সংক্ষিপ্ত
- সুপ্রাচীন শহর কলকাতা
- সেই শহরের বুকেই ঘটে গিয়েছিল পালকি নিয়ে ধর্মঘট
- কবে ও কেন হয়েছিল সেই ধর্মঘট
- জেনে নিন সেই সংক্রান্ত কিছু চমকপ্রদ তথ্য
কলকাতা শহরের প্রথম ধর্মঘট কবে? ১৮২৭ সালে কলকাতায় হয়েছিল প্রথম ধর্মঘট। অন্তত সরকারী দস্তাবেজ তেমনটাই বলছে। এই ধর্মঘট হয়েছিল পালকি নিয়ে, কারণ পালকি বেয়ারারা এই ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিলেন।
এই কাহিনি পুরনো কলকাতার যখন কলকাতায় আস্তে আস্তে ভিড় বাড়ছিল জনবসতির। দলে দলে জাহাজে করে ব্রিটিশ সাহেব-মেমরা এসে নোঙর ফেলছিলেন চাঁদপাল ঘাটে। সেই সময় কলকাতার বেশ কিছু অঞ্চল ছিল জঙ্গলে ভর্তি। বিশেষ করে দক্ষিণ মধ্য ও উত্তর কলকাতা বিস্তৃত ছিল এই জঙ্গল। এতে ভর্তি ছিল খুনে ডাকাত ও বন্য জন্তু। লাল পাগড়ি মাথায় বেঁধে, লাল তিলক কপালে এঁকে হাতে লাঠি ও বল্লম নিয়ে এই ডাকাতদের দল সাধারণ মানুষের পথ আটকে দাঁড়াত। চলত লুঠপাঠ, এমনকী খুন করা হত মানুষকে।
আরও পড়ুন- শুভ জন্মদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা
ব্রিটিশদের সময়কার এই কলকাতায় কালিঘাট ছিল এক পূণ্যস্হান। কিন্তু উত্তর কলকাতায় বসবাসকারী সাহেব- মেমদের কালিঘাট অঞ্চলে যেতে হলে পার করতে হত চৌরঙ্গির অঞ্চলে থাকা এক বিশাল জঙ্গল। সেই সময় কলকাতার বুকে চৌরঙ্গি বলে কোন জায়গা ছিল না। যাতায়াতের অন্যতম বাহন ছিল পালকি। কিন্তু খুনে ডাকাতদের ভয়ে জঙ্গলের পথ মাড়াতে চাইতেন না পালকি বেয়ারারা। যদিও বা তাঁরা এই পথে পালকি নিয়ে যেতেন তাহলে বিশাল অর্থ দাবি করতেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাজের জন্য সাহেবদের প্রায়শই জঙ্গলের ভিতর দিয়ে কালীঘাটে যেতে হত। কিন্তু পালকি বেয়ারারা অত্যাধিক ভাড়া দাবি করায় সাহেবরা ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েন।
পালকি বেয়ারাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে কোম্পানি এক নিয়ম লাগু করে। কোম্পানি জানিয়ে দেয় পালকি বইতে গেলে বেয়ারাদের নিতে হবে লাইসেন্স, হাতে পরতে হবে কোম্পানির নম্বর দেওয়া ব্যাজ। যাতায়াতের মাশুল হবে ঘন্টাপিছু। কোম্পানির ফতোয়া মানতে রাজি ছিল না বেয়ারারা। তাঁরা মনে করছিলেন হাতে ব্যাজ পরা মানে জাত খোয়ানো। এর ফলে তাঁরা সমাজে অপাঙক্তেয় হয়ে যাবেন বলে আশঙ্কা করেছিলেন। উপরন্তু ব্যাজের জন্য কোম্পানিকে কোনও অর্থ দিতেও রাজি ছিলেন না পালকি বেয়ারারা।
ফলে পালকি বেয়ারারা একসঙ্গে পালকি বওয়া বন্ধ করে দেন। পালকি না পেয়ে বিপাকে পড়েন সাহেবরা, পরিস্হিতি মোকাবিলায় তৎপর হয় কোম্পানি। ইতিমধ্যে কলকাতার ময়দানে মিটিং করে প্রায় ১২০০০ পালকি বেয়ারা। তাঁরা মিটিং করে দল বেঁধে হাজির হন ম্যাজিস্ট্রেটের দরবারে। সব কথা শুনে ম্যাজিস্ট্রেট ব্যাজের দাম মকুব করে দেন। এরপর পালকি বেয়ারারা লালবাজারের সুপ্রিম কোর্টের সামনে হই হুল্লোড় করতে থাকেন। লোকে ভাবল পালকি বেয়ারারা হয়ত কাজে ফিরতে চলেছেন। কিন্তু পরের দিন থেকে রাস্তায় কোনও পালকির দেখা পাওয়া যায়নি। কোম্পানি বুঝতে পারে পালকি বেয়ারারা আদপেও কাজে ফেরেনি ধর্মঘট চালিয়ে যাচ্ছে। ১৮২৭ সালের এই ঘটনা কলকাতা শহরের প্রথম এই ধর্মঘট নিয়ে তর্কের অন্ত নেই। একদল মানুষ পালকি বেয়ারারাদের পক্ষে জোর সওয়াল করেছিল। এই সব মানুষদের দাবি ছিল পালকি বেয়ারাদের কোনও ভাবে ঠকানো যাবে না। তাঁরা যেভাবে বিপদ সংকুল জঙ্গলে পালকি বয়ে নিয়ে যান তাতে জীবনের ঝুঁকি থাকে। এই পালকি ধর্মঘট ওঠার পেছনে চমকপ্রদ কাহিনি রয়েছে। এই সময় কলকাতার পালকি বেয়ারাদের অধিকাংশ ছিল ওড়িয়া। ধর্মঘটে যে পালকি বেয়ারারা গিয়েছিলেন তাঁরা সকলেই ছিলেন ওড়িয়া। এই ধর্মঘটের সুযোগ নিয়ে কলকাতায় প্রবেশ ঘটে বিহারের হিন্দুস্হানী রাউনিদের। এরা এসে ওড়িয়া বেয়ারাদের না ছোঁয়া পালকি চওড়া কাঁধে তুলে নিয়েছিল। কলকাতায় ফের সরগরম হয়েছিল পালকি বেয়ারাদের ডাক। এক ঘুমন্ত শহর থেকে ফের যেন জেগে উঠেছিল কলকাতা।
[তথ্য সহায়তা প্রখ্যাত সাহিত্যিক সাংবাদিক প্রয়াত পূর্ণেন্দু পত্রী-র বিভিন্ন লেখা]