সংক্ষিপ্ত

  • কোভিডের মধ্যেও বাঙালির শৃঙ্গ জয় 
  • হিমালয়ের বুকে চার শৃঙ্গ জয় দেবাশিসের
  • এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে কোভিডের হামলা
  • এই পরিস্থিতিতেও আমাদাবলাম জয় দেবাশিসের

এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে এখন কোভিডের ছড়াছড়ি। ৫ মে এভারেস্ট বেস ক্যাম্প থেকে ১৭ জনকে কাঠমাণ্ডু নিয়ে আসা হয়। এরা সকলেই প্রবল জ্বর-গা-হাত পা ব্যাঁথা এবং সর্দিতে ভুগছিলেন। এই ১৭ জন পর্বতারোহীর শরীরেই মিলেছে করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব। অথচ, এই এভারেস্ট বেস ক্যাম্পেও ১মে ছিলেন পর্বতারোহী দেবাশিস। ৫ মে কলকাতার বাড়িতে বসে এশিয়ানেট নিউজ বাংলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে যেন খানিকটা স্বস্তি। আর একটু হলেই যে তিনি করোনায় এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে আটকে যেতে পারতেন তা ভালমতোই ঠাহর করছেন দেবাশিস। তবে, কোভিড-কে ফাঁকি দিয়ে যেভাবে তিনি আমাদাবলাম-সহ চার শৃঙ্গ জয় করেছেন তা রীতিমত কৃতিত্বের দাবি রাখে। 

৫ মে এভারেস্ট বেস ক্যাম্প থেকে যে ১৭ জনকে কাঠমাণ্ডু নিয়ে আসা হয়েছে তাঁদের সকলেই দেবাশিসের পরিচিত। ৩০ তারিখ তিনি যখন আমাদাবলাম জয় করে এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে পা রেখেছিলেন তখন এদের সকলেই দেখেছিলেন প্রবল অসুস্থতা নিয়ে টেন্টে পড়ে থাকতে। দেবাশিসের মতে, পুরো বেস ক্যাম্পটাকে দেখেই মনে হচ্ছিল যেন করোনার আঁতুরঘর হয়ে গিয়েছে। একে ঠান্ডা। তারমধ্যে সকলেই কেমন যেন অস্বাভাবিক রকমের অসুস্থ। শ্বাস নিতে অনেকের কষ্ট হচ্ছিল। প্রমাদ গুণেছিলেন দেবাশিস। কারণ, বেশিক্ষণ এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে পড়ে থাকলে তিনি যে সংক্রামিত হবেন তাতে কোনও সন্দেহ ছিল না। তাই ৩০ তারিখটা রাতটা কোনওভাবে এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে কাটিয়েই ১ মে পা রেখেছিলেন কাঠমাণ্ডুতে। আর ২ মে পৌঁছে গিয়েছিলেন কলকাতার বাড়িতে। আফশোস একটাই চারটে শৃঙ্গ জয়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও একটি শৃঙ্গ জয়ের লক্ষ্য নিয়েছিলেন তাঁর এই অভিযানের মধ্যে। কিন্তু আবহাওয়া ও কোভিডের কারণে সেই লক্ষ্য পূররণ হল না। তবে দেবাশিসের আশা পরের অভিযান এভারেস্টের আশপাশে হলে ওই শৃঙ্গ তিনি জয় করবেন-ই করবেন। 

১৯ মার্চ আমাদাবলাম-সহ চার শৃঙ্গ জয়ের উদ্দেশে নেপাল রওনা হয়েছিলেন দেবাশিস। ২০ মার্চ শিলিগুড়িতে একটি সাংবাদিক সম্মেলন করেই কাঁকরভিটা হয়ে ভদ্রপুর বিমানবন্দর দিয়ে কাঠমাণ্ডু পৌঁছে যান। সেখানে তিন দিনের এক বিশ্রাম এবং কোভিড পরীক্ষা-সহ আরও কিছু কাজ সেরে ২৩ তারিখ লুকলা চলে গিয়েছিলেন দেবাশিস। ২৪ মার্চ সেখান থেকে আমাদাবলাম ও আরও তিন শৃঙ্গ- মাউন্ট মেরা, মাউন্ট আইল্যান্ড এবং মাউন্ট লোবুচ জয়ের উদ্দেশে অভিযান শুরু করেন। ২৫ মার্চ হিমালয়ের মাকালু রেঞ্জে প্রবেশ করে যান দেবাশিস। এরপর সেখান থেকে রওনা দেন প্রথম শৃঙ্গ মাউন্ট মেরা জয়ের জন্য। কিন্তু মেরা শৃঙ্গের কাছে পৌঁছতেই হাইক্যাম্প বলে একটি স্থানে আঠকে পড়েন দেবাশিস। তাঁর পথরোধ করে দাঁড়িয়ে পড়ে খারাপ আবহাওয়া। তুষারপাত ও প্রবল হাওয়ায় টেন্ট ছিঁড়ে বেরিয়ে যায়। সেই কঠিন পরিস্থিতিতেও তিনি শেরপাকে সঙ্গে করে দুর্যোগ কাটার অপেক্ষায় পড়েছিলেন। অবশেষে ২দিন হাইক্যাম্পে আটকে থাকার পর দুর্যোগ কাটে এবং ৪ এপ্রিল মেরা শৃঙ্গ জয় করেন দেবাশিস। 

মেরা জয়ের পরই হেলিকপ্টারে করে তিনি পৌঁছে যান টুকমুঙ্গে। ৭ এপ্রিল তিনি জয় করেন আইল্যান্ড শৃঙ্গ। এই শৃঙ্গের সঙ্গে বাঙালির একটা আবেগ জড়িয়ে রয়েছে। কারণ, ৭০ বছর আগে ভূপেন্দ্রমোহন দত্ত নামে এক পর্বাতোরাহী এই শৃঙ্গটি প্রথম বাঙালি হিসাবে জয় করেছিলেন। যদিও আইল্যান্ড শৃঙ্গের বর্তমান নাম ইমজা টিসে। বরাবরই এই শৃঙ্গের এই নামই ছিল। কিন্তু, ১৯৫৩ সালে এভারেস্ট জয়ে বের হওয়া ব্রিটিশ পর্বতারোহীদের দল এর নাম আইল্যান্ড শৃঙ্গ রাখে। সেই থেকে পর্বতারোহীদের মুখে জনপ্রিয় হয়ে যায় আইল্যান্ড শৃঙ্গের নাম। এর আইল্যান্ড শৃঙ্গ নামকরণের পিছনেও একটা কারণ রয়েছে। কারণ দূর থেকে দেখলে মনে হবে চারিদিকে বরফের সমুদ্রের মাঝে একটা শৃঙ্গের চাতাল ভেসে বেড়াচ্ছে। 

আইল্যান্ড শৃঙ্গ জয়ের পরই দেবাশিসের পরবর্তী গন্তব্য ছিল লোবুচ। ১৩ এপ্রিল লোবুচ জয় করে আমাদাবালম জয়ের উদ্দেশে অগ্রসর হন দেবাশিস। পৌছন এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে। সেখানে থাকার সময়ই আমাদাবালম জয়ের আগে আরও একটি শৃঙ্গ জয়ের পরিকল্পনা করেন। কিন্তু, আবহাওয়া খারাপ হয়ে পড়ায় তাঁকে সেই শৃঙ্গ জয়ের আশা ত্যাগ করতে হয় সাময়িকভাবে। দেবাশিস ২৭ এপ্রিল রওনা দেন আমাদাবলামের উদ্দেশে। পায়ে হেঁটে প্রথমে সেরিচ এবং সেখান থেকে প্যাংবেচ বলে আর একটি বেসক্যাম্প। সেখান থেকে রওনা দিয়ে ২৯ তারিখ আমাদাবলামের শীর্ষে পৌঁছন দেবাশিস। আর সেই সঙ্গে প্রথম বাঙালি হিসাবে আমাদাবলাম জয়ের গাঁথা লিখে ফেলেন। 

দেবাশিসের কথায় আমাদাবলাম এবং এভারেস্টের মধ্যে সবচেয়ে পড় পার্থক্য হল সৌন্দর্য। আর এর জন্যই আমাদাবালমকে বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দরীতম শৃঙ্গ বলে ধরা হয়। দূর থেকে দেখলে মনে হয় কোনও মহিলা গলায় হার পরে রয়েছেন। আসলে শৃঙ্গের চারপাশে থাকা হিমবাহগুলো এমনভাবে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে তাতে হার পরা মহিলার মতোই তাকে দেখায়। আমাদাবালমের সবচেয়ে বড় দুর্গমতা এই শৃঙ্গ এক্কেবারে খাড়া। হিমবাহের গা বেয়ে বেয়ে ঝুলে ঝুলে উঠতে হয়। 

২০২০ সালে কোভিড পরিস্থিতি শীথিল হতেই আমাদাবলাম জয়ে নেমেছিলেন দেবাশিস। তাঁর সঙ্গে ছিলেন আরও দুই পর্বতারোহী সত্যরূপ সিদ্ধান্ত ও মলয় মুখোপাধ্যায়। কিন্তু, আমাদাবালম জয়ের মাত্র কয়েক গজ দূর থেকে তাঁদের ফিরে আসতে হয়েছিল সেই যাত্রায়। কারণ আবহাওয়া এবং তার সঙ্গে অসুস্থতা। সেবার আর মাত্র আধ ঘণ্টা হাঁটতে পারলেই আমাদাবলাম জয় করে ফেলতেন দেবাশিসরা। 

আমাদাবলাম অভিযানের সেই অভিজ্ঞতাকে এবার বেশ কাজে লাগিয়েছেন দেবাশিস। বরফের উপরে পা ফেলার টেকনিকে সামান্য কিছু বদল এনেছিলেন। শ্বাস ধরে রাখা ও ছাড়ার মধ্যেও কিছু কৌশল নিয়েছিলেন। এমনকী শৃঙ্গে আরোহণের পথটাও সামান্য বদলে ফেলেছিলেন। দেবাশিসের দাবি, আর এর জেরেই ২৯ এপ্রিল বেলা সাড়ে বারোটার মধ্যে আমাদাবলাম জয় করে ফেলেছিলেন তিনি। 

আমাদাবলাম জয় করে যখন ক্যাম্প টু হয়ে ক্যাম্প থ্রি-তে দেবাশিস ফেরেন তখন রাত সাড়ে এগারোটা বেজে গিয়েছিল। দীর্ঘ অভিযানের ক্লান্তি শরীরটাকে যেন নিংরে নিচ্ছিল। এই অবস্থাতেই ৩০ তারিখ এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে পৌঁছন তিনি। তখনও মনের মধ্যে আরও একটি শৃঙ্গ জয়ের প্রবল ইচ্ছে। কিন্তু, আবহাওয়ার পর এবার দীর্ঘ অভিযানে ক্লান্ত দেবাশিসের সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় এভারেস্ট বেস ক্যাম্পের কোভিড পরিস্থিতি। কোভিডের এই পরিস্থিতিতে ফের কবে সুযোগ মিলবে পর্বতারোহণের- এই খেদ নিয়েই কালবিলম্ব না করে কাঠমাণ্ডু ফিরে এসেছিলেন দেবাশিস। কলকাতার বাসার বসে এশিয়ানেট নিউজ বাংলা-কে একান্ত সাক্ষাৎকার দিতে দিতেও দেবাশিসের গলায় ঝরে প়ড়ছিল খেদোক্তি। কিন্তু, কানের পাশ দিয়ে কোভিড সংক্রমণ যে বেরিয়ে গিয়েছে তাও মানছেন এই বাঙালি পর্বাতোরোহী। করোনা অতিমারির এই সঙ্কটেও যেন ঝুলিতে আমাদাবলাম-সহ আরও চার শৃঙ্গ জয়ের নজির তা আপাতত উপভোগ করছেন তিনি।