সংক্ষিপ্ত
- বইপাড়ায় এবার নজিরবিহীন পয়লা বৈশাখ
- বেরোবে না কোনও নতুন বই
- লেখকে-পাঠকে আলাপ হবে না
- বাঙালির ঘোর দুর্দিনেও এমন ছবি দেখা যায়নি
সবুজ মুখোপাধ্য়ায়: গত পঞ্চাশ বছরে যা হয়নি, এবার তা-ই হতে চলেছে। পয়লা বৈশাখে এবার বইপাড়ায় দেখা যাবে না লেখক আর পাঠকদের আড্ডা। লকডাউনের কারণে খাঁ-খাঁ করবে গোটা কলেজ স্ট্রিট।
দে`জ প্রকাশনার কর্ণধার সুধাংশু দে তো বলেই ফেললেন, "প্রায় ৫০ বছর হতে চলল প্রকাশার জগতে রয়েছি। এমন অভিজ্ঞতা কোনওদিন হয়নি। অনেক সময়ে রবিবারেও পয়লা বৈশাখ পড়েছে। কিন্তু লেখক আর পাঠকদের সে কী ভিড়। দেখে বোঝার উপায় নেই যে দিনটা রবিবার।" এবার পয়লা বৈশাখ পড়েছে ১৪ এপ্রিল। সেদিন অবধি লকডাউন। তাই কলেজ স্ট্রিটে বইপাড়ার সেই জমায়েত আর হবে না। নতুন কোনও বইও প্রকাশিত হবে না। অতীতে বাঙালির ঘোর দুর্দিনেও এমন ছবি দেখা গিয়েছে বলে কেউ মনে করতে পারছেন না।
একটা সময় ছিল, যখন পয়লা বৈশাখে বই পাড়া ম-ম করতে রথী-মহারথীদের ভিড়ে। সাহিত্য়িকদের সেদিন নেমন্তন্ন করতেন প্রকাশকরা। ছোট-বড় সব কমবেশি সব প্রকাশনাতেই একই রেওয়াজ। এদিন যেন সবাই রাজা। আর তাদের রাজত্ব বসত কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়া জুড়ে। সেই ট্র্য়াডিশন আজও রয়ে গিয়েছে। প্রকাশকরা আজও পয়লা বৈশাখের দিন আমন্ত্রণ জানান কবি-লেখকদের। তাঁরা আসেন। তাঁদের নতুন বইও প্রকাশিত হয়। আসেন পাঠকরাও। তাঁদেরকেও সমান যত্নে মিষ্টিমুখ করানো হয়। বাংলা প্রকাশনা জগতের এই রেওয়াজ যে ঠিক কতদিন, তা হয়তো গবেষকরাই বলতে পারবেন। তবে তা ৫০ থেকে ৬০-৭০ বছরের কম যে নয়, সে কথা হলফ করে বলা যায়। বাঙালির বহু দুর্দিনেও এই এর ব্য়তিক্রম হয়নি। কিন্তু এবার তা হচ্ছে। করোনা-আতঙ্ক আর তৎজনিত লকডাউনের জন্য়।
দে`জ থেকে এবারে একটা বইও বেরোচ্ছে না পয়লা বৈশাখে। সুধাংশুবাবুর কথায়, "কমপক্ষে দশ-বারোটা বই বেরনোর কথা ছিল। প্রুফ দেখা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কাজ বন্ধ। পয়লা বৈশাখ তো বেরোচ্ছেই না। তারপরেও যে আদৌ কবে বেরুবে তা বলতে পারছি না। লকআউট উঠে গেলেও যে সব ঠিক হয়ে যাবে রাতারাতি তা তো নয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে অনেক সময় লাগবে। দেখুন বইয়ের ব্য়বসাটা তো অন্য় ব্য়বসার মতো নয়। তাই এই সময়টা যে বিক্রি হতো, তা আর পরে হবে না।"
খোয়াবনামা প্রকাশনার কর্ণধার রাজা পোদ্দারের মুখেও শোনা গেল ঠিক একই কথা, "লকডাউন উঠলেই যে বই বিক্রি হবে তা তো নয়। লোকে আগে চালডাল তেলনুন কিনবে। প্রয়োজনয়ীয় জিনিস কিনবে। তারপর হাতে টাকা থাকলে তবেই বই কিনবে। ফলে বইয়ের ব্য়বসায় যে ক্ষতি হয়ে গেল তা কীভাবে সামাল দেওয়া যাবে জানি না।"
আর নতুন বই? "কী করে আর বেরোবে", বললেন রাজা, "পয়লা বৈশাখ থেকে বুদ্ধ পূর্ণিমা পর্যন্ত আমাদের আমাদের চার-পাঁচটা বই বেরনোর কথা ছিল। বেরোবে না। শুধু তাই নয়। কবে বেরোবে তা-ও বলা যাচ্ছে না। অর্থনীতির অবস্থা এমনিতেও খারাপ ছিল। এবার তা আরও খারাপ হবে। আমরা যারা নিত্য় প্রয়োজনীয় জিনিসের ব্য়বসা করি না, তাদের অবস্থা খুবই খারাপ হবে।"
সেতু প্রকাশনীর বই শুধু বাঙালি পাঠককের কাছেই নয়, দেশ-বিদেশের পাঠককেও নাড়া দিয়েছে। মূলত প্রবন্ধধর্মী নন-ফিকশন বই ছাপে সেতু। সেইসঙ্গে বেশ কিছু অন্য়রকমে বইও, যেমন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বা ইতিহাসের বই। যেগুলোর মান খুব ভালো হওয়ায় বিভিন্ন কলেজে পড়ুয়া রেফারেন্স বই হিসেবে কেনেন। "এবারে পুরো ব্য়বসাটাই মার খেয়ে গেল। এই সময় যে বইগুলো বিক্রি হওয়ার কথা, সেগুলো কিন্তু আর পরে হবে না। এদিকে ঘরে টাকা ঢুকছে না। কর্মীদের মাইনে দেবো কোথা থেকে জানি না। কবে যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে তা-ও কেউ বলতে পারি না। " এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বললেন সেতু-র কর্ণধার সুব্রত দাস। পয়লা বৈশাখে এবার কি তাহলে খাঁ-খাঁ করবে বই পাড়া? বিষণ্ণ গলায় সুব্রত বললেন, "উপায় কী। এই তো এবারেই আমাদের টার্গেট ছিল বেশ কয়েকটা বই। যেমন নীলয় কুমার সাহা-র বাংলা 'পঞ্জিকায় পুরনো কলকাতা'। খুব ইনটারেস্টিং কাজ ছিল। কিন্তু বার করতে পারবো না। এছাড়াও বেশ কয়েকটা বই বার করার কথা ছিল। কিছুই হবে না। বড় খারাপ লাগছে এবার। এমনটা কোনও বছর হয় না।"