উত্তমকুমার-পরবর্তী বাংলা ছবির হাল ধরেছিলেন তিনি দাদার কীর্তির অভিনয় আজও ভুলতে পারেনি বাঙালি কিন্তু রাজনীতির পাকেচক্রে নায়ক থেকে খলনায়ক হয়ে গেলেন তিনি মমতার হাত ধরে রাজনীতিতে আসাই কি তাহলে কাল হল তাঁর

১৯৮০ সালের জুলাই মাসে চলে গেলেন উত্তমকুমার খুব ছোটবেলায় ল্য়ান্সডাউন রোডের ওপর দাঁড়িয়ে থেকে সেই শেষযাত্রায় সাক্ষী হয়েছিলামচারপাশে তখন এক বিষণ্ণ হা-হুতাশটালিগঞ্জ পাড়ায় গেল গেল রব-- 'বাংলা ছবির হাল ধরার মতো আর কেউ রইল না'

ওই বছরই পুজোর পর মুক্তি পেল তরুণ মজুমদারের দাদার কীর্তিনবাগত তাপস পালের লিপে হেমন্ত মুখোপাধ্য়ায়ের গলায় শোনা গেল 'চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে' তরুণ মজুমদারের ক্য়ারিশমায় তখন অপেক্ষাকৃত কম জনপ্রিয় ওই রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষিত মধ্য়বিত্তের মুখেমুখে আর সেই সঙ্গে বাংলা ছবির দর্শকদের মধ্য়ে তখন তুমুল কৌতূহল, কে এই নবাগত অভিনেতা তাপস পাল?

চন্দননগরের যুবক সেই তাপস পালই পরবর্তী একদশক ধরে কার্যত দাপিয়ে বেড়িয়েছিলেন বাংলা ছবির জগৎকখনও মুনমুন সেনের সঙ্গে জুটি বেঁধে, কখনও দেবশ্রী রায়ের সঙ্গে, আবার কখনও-বা মহুয়া রায়চৌধুরীর বিপরীতে চুটিয়ে অভিনয় করে গিয়েছেন'দীপার প্রেম', 'ভালোবাসা ভালোবাসা', 'পারাবত প্রিয়া', 'অনুরাগের ছোঁয়া', 'বৈদুর্য রহস্য়', 'কেনারাম বেচারাম', 'আগমনী', 'আপন আমার আপন', একের-পর-এক ছবিতে নায়কের ভূমিকায় চুটিয়ে অভিনয় করে এসেছেন তিনি২০০০ সালে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের উত্তরা ছবিতে অভিনেতা হিসেবে তিনি তাঁর জাত চিনিয়েছিলেন বুদ্ধদেববাবুর 'মন্দ মেয়ের উপাখ্য়ান'-এও তাঁর অভিনয় নজর কেড়েছিলএর মধ্য়েই তিনি জড়িয়ে পড়েছিলেন নানা বিতর্কেচন্দননগর থেকে কলকাতায় চলে এলেও নিজের সম্পত্তি নিয়ে তিনি নাকি বঞ্চিত করেছিলেন ভাইবোনেদের, অভিযোগ উঠেছিল এমনটাই এমনকি নিজের মায়ের সঙ্গে তাঁর দুর্ব্য়বহারের খবরও ফলাও করে ছাপা হয়েছিল কাগজে তবু দোষেগুণে মানুষসবকিছু সত্ত্বেও দাদার যাবতীয় কীর্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতেই দেখেছিলেন মধ্য়বিত্তবাঙালি কিন্তু 'কাল' হল তার ঠিক পরেই যখন মমতার হাত ধরে রাজনীতিতে প্রবেশ করলেন তরুণ মজুমদারের এই নায়কযখন তাঁর মুখ থেকেই শিক্ষিত বাঙালি শুনল, "ঘরে ছেলে ঢুকিয়ে রেপ করিয়ে দেব", তখন যেন রাতারাতি নায়ক থেকে খলনায়ক হলে গেলেন তাপস পাল

অবশ্য় তাপস পাল যখন তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন, তখনও তৃণমূল রাজ্য়ের ক্ষমতায় আসেনি তাঁর কথায়, "আমি যখন দলটা করতে এসেছিলাম, তখনও কেউ জানতো না তৃণমূল ক্ষমতায় আসবে আমি শাসকের সঙ্গে থাকব বলে রাজনীতি করতে আসিনি, শাসককে চ্য়ালেঞ্জ জানাতে তৃণমূলে এসেছিলাম"

কিন্তু অসৎসঙ্গে নরকবাস ফলে যা হওয়ার তাই হল চিটফান্ডকাণ্ডে তাঁর নাম জড়াল রোজভ্য়ালিকাণ্ডে তাঁকে গ্রেফতার করা হল দীর্ঘদিন জেলে কাটাতে হল তাঁকেতৃণমূল-রাজনীতির পাকেচক্রে থাকতে থাকতে 'রেপ' তুলে গালাগাল দেওয়ার সংস্কৃতিও গ্রাস করল তাঁকে সেদিন বিধানসভায় তৃণমূলের এক মহিলা বিধায়ক যেমন সিপিএমের এক মহিলা বিধায়কের উদ্দেশে রেপ করিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে শিরোনাম হলেন, সেরকমই এক বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন তাপস পালওযখন প্রকাশ্য়ে তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছিল, "আমি চন্দননগরের মাল, ঘরে ছেলে ঢুকিয়ে রেপ করিয়ে দেব"

সোশাল মিডিয়ার দিনভর নেটিজেনদের পোস্টে আজ তাই মিশ্র প্রতিক্রিয়া তাপস পালকে নিয়ে কেউ মনে করছেন, মাথায় মাফলার দেওয়া সিনেমার সেই ২২ বছর বয়সি চন্দননগরের সেই নিষ্পাপ তরুণকে কেউ বা মনে করছেন, রাজনীতির পাঁক-ঘাঁটা সেই 'চন্দননগরের মাল'কে আর যে মানুষটা ভোররাতে আমাদের ছেড়ে চলে গেল, সে নিজে কী বলছে? সম্ভবত-- "এই করেছো ভালো নিঠুর হে..."