জাম খেলেই কমবে এইসব রোগ ব্যধি! এই ফলের অজানা গুণাগুণ জেনে নিন
জাম, বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে পাওয়া যায় এমন একটি অসাধারণ ফল। এটি শুধুমাত্র সুস্বাদুই নয়, অসংখ্য স্বাস্থ্য উপকারিতা এবং গভীর সাংস্কৃতিক গুরুত্ব বহন করে। জাম কেন আপনার খাদ্যতালিকায় থাকা উচিত তার অনেক কারণ রয়েছে। আমরা প্রায়শই বাজারে পাওয়া যায় এমন কৃত্রিম স্বাদের খাবার খুঁজি। কিন্তু আমাদের ঐতিহ্যবাহী ফল জামের প্রাকৃতিক পুষ্টিগুণ এবং এর ঔষধি গুণাগুলি ভুলে গেলে চলবে না।
ডায়াবেটিসের জন্য উপকারী:
জাম ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য খুবই উপকারী। এর বীজে 'জ্যাম্বোলিন' এবং 'জ্যাম্বোসাইড' এর মতো বিশেষ যৌগ রয়েছে যা রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। প্রতিদিন জাম খাওয়া ইনসুলিন সংবেদনশীলতা উন্নত করে এবং রক্তে শর্করার মাত্রা স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে। জামের রস এবং গুঁড়ো ডায়াবেটিস চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। এর টক এবং তিতা স্বাদ রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। সিদ্ধ এবং আয়ুর্বেদ চিকিৎসায়, জামের বীজের গুঁড়ো ডায়াবেটিসের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
পাচনতন্ত্রের স্বাস্থ্য উন্নত করে:
জামে প্রচুর পরিমাণে আঁশ থাকে, যা কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়রিয়া (বিশেষ করে ফলের তিতা স্বাদের কারণে), বদহজম এবং অন্যান্য পাচন সমস্যা প্রতিরোধে সাহায্য করে। এটি অন্ত্রের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করে এবং মল ত্যাগ সহজ করে। এটি ক্ষুধা বৃদ্ধি করে এবং পাচনশক্তি উন্নত করে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়:
ভিটামিন সি এবং 'অ্যান্থোসায়ানিন' এর মতো শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট জামে প্রচুর পরিমাণে থাকে। এগুলি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং সাধারণ সংক্রমণ যেমন জ্বর, সর্দি এবং গুরুতর রোগ থেকে শরীরকে রক্ষা করে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট কোষের ক্ষতি রোধ করে এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
হৃদয়ের জন্য উপকারী:
এতে থাকা পটাশিয়াম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, যার ফলে হৃদরোগ, হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে। এছাড়াও, জামে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট খারাপ কোলেস্টেরল (LDL) কমায় এবং ভালো কোলেস্টেরল (HDL) বাড়ায়। এটি রক্তনালীকে সুস্থ রাখে এবং হৃদয়ের স্বাভাবিক কার্যকারিতা নিশ্চিত করে।
রক্ত তৈরিতে সাহায্য করে:
জামে লোহার পরিমাণ উল্লেখযোগ্য। এটি রক্তে লোহিত কণিকার উৎপাদন বৃদ্ধি করে এবং রক্তাল্পতা প্রতিরোধে সাহায্য করে। বিশেষ করে গর্ভবতী মহিলা, শিশু এবং ঋতুস্রাবকালীন মহিলাদের জন্য এটি খুবই উপকারী। ক্লান্তি, দুর্বলতা போன்ற রক্তাল্পতার লক্ষণ কমাতে সাহায্য করে। রক্ত শোধন করার ক্ষমতার জন্যও জাম বিখ্যাত।
ত্বকের জন্য উপকারী:
জামে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ভিটামিন ত্বককে উজ্জ্বল করে তোলে এবং ব্রণ, কালো দাগ, বলিরেখা போன்ற সমস্যা কমাতে সাহায্য করে। শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ বের করে ত্বককে তরুণ রাখে। এতে থাকা ভিটামিন সি, কোলাজেন উৎপাদন বৃদ্ধি করে ত্বকের স্থিতিস্থাপকতা বাড়ায়।
হাড় মজবুত করে:
ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস போன்ற খনিজ জামে থাকে, যা হাড় মজবুত করে এবং অস্টিওপোরোসিস போன்ற রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। বর্ধনশীল শিশু এবং বয়স্কদের জন্য এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মাড়ি এবং দাঁতের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী:
জামের কষ মাড়িকে শক্তিশালী করে। এটি মুখের দুর্গন্ধ কমায় এবং মাড়ি থেকে রক্তপাত প্রতিরোধ করে। জাম গাছের পাতা এবং ছালও মুখের স্বাস্থ্যের জন্য ব্যবহৃত হয়।
ওজন কমাতে সাহায্য করে:
জামে ক্যালোরি খুব কম, কিন্তু আঁশ প্রচুর পরিমাণে থাকে। এটি দীর্ঘক্ষণ ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণ করে এবং অতিরিক্ত খাওয়া প্রতিরোধ করে। ওজন কমানোর চেষ্টা করছেন এমন লোকদের জন্য এটি একটি ভালো খাবার।
সিদ্ধ চিকিৎসায় জাম:
সিদ্ধ চিকিৎসায় জামের সব অংশ (ফল, বীজ, ছাল, পাতা) ঔষধি উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। বিশেষ করে, ডায়াবেটিস, ডায়রিয়া, রক্তাল্পতা, লিভারের রোগ এবং মাড়ির রোগের জন্য জাম ব্যবহৃত হয়। জামের ছালের কাঁড়া রক্ত শোধন করতে এবং তিতা পাতা ক্ষত স্থানে লাগাতে ব্যবহৃত হয়।
জাম খাওয়ার সহজ উপায়:
জাম সরাসরি খাওয়া যায়। এর মিষ্টি এবং সামান্য তিতা স্বাদ অনন্য। কখনও কখনও ফলের রঙ হাতে লেগে থাকে এবং জিহ্বা বেগুনি রঙ হয়ে যায়, এটি ফলের প্রাকৃতিক গুণের একটি চিহ্ন।
জামের বীজ বের করে, সামান্য জল দিয়ে ব্লেন্ড করে ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে রস হিসেবে পান করা যায়। এতে চিনি না মিশিয়ে পান করাই ভালো। বিশেষ করে ডায়াবেটিস রোগীদের চিনি ছাড়া পান করা জরুরি।
সকালের নাস্তায় দই বা ছানার জল মিশিয়ে জামের স্মুদি হিসেবে পান করা যায়। এটি তাজা লাগে।
জ্যাম, জেলি, সিরাপ এবং ভিনেগার (জামের ভিনেগার স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ভালো, এটি রান্নায় স্বাদ বাড়ায় এবং স্বাস্থ্যের জন্যও উপকারী) তৈরিতেও এটি ব্যবহৃত হয়।
এর বীজ শুকিয়ে, গুঁড়ো করে একটি বায়ুরোধী পাত্রে রাখা যায়। ডায়াবেটিস রোগীরা প্রতিদিন এক চা চামচ এই গুঁড়ো গরম জলে মিশিয়ে পান করতে পারেন। এটি রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এটি দীর্ঘদিন ধরে খারাপ হয় না, তাই বছর ব্যাপী জামের উপকারিতা পেতে এটি একটি ভালো উপায়।
জামের এত উপকারিতা থাকা সত্ত্বেও, এটি অতিরিক্ত খাওয়া উচিত নয়। এটি একটি মৌসুমি ফল, তাই যখন পাওয়া যায় (সাধারণত মে শেষ থেকে আগস্ট পর্যন্ত বেশি পাওয়া যায়) তখন এর সম্পূর্ণ উপকারিতা নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। আমরা প্রায়শই সুপারমার্কেটে পাওয়া রাসায়নিক ফলের প্রতি আকৃষ্ট হই। কিন্তু আমাদের স্থানীয়, প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন এই ধরণের পুষ্টিকর ফল, বিশেষ করে জাম ভুলে গেলে চলবে না।
আমাদের ঐতিহ্যবাহী এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ফিরিয়ে আনা গুরুত্বপূর্ণ। কৃত্রিম মিষ্টি এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার পরিহার করে, প্রকৃতির দান জামের মতো ফল আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করি।
তাই, পরের বার বাজারে গিয়ে জাম দেখলে, শুধু এর স্বাদ নয়, এর অসাধারণ স্বাস্থ্য উপকারিতা এবং আমাদের ঐতিহ্যের সাথে এর সম্পর্ক স্মরণ করুন। নিয়মিত জাম খেয়ে আপনার স্বাস্থ্য রক্ষা করুন, এটি শুধু রোগের ঔষধ নয়, রোগ প্রতিরোধের একটি অসাধারণ খাবার।


