সংক্ষিপ্ত
ট্রেকিং করার মজা পেতে হলে যেতে হবে টেনডং পাহাড়ের জঙ্গলে
সিকিমে যাওয়া মানেই নতুন নতুন পথ খুঁজে পাওয়া
নিরিবিলি জঙ্গলে গা ছমছমে পথে ট্রেক করার অভিজ্ঞতা অন্যরকম
রাভাংলার অনতিদূরে এই অল্প পরিচিত ট্রেক পথ ঘিরে আছে নানা গাছ গাছালি ও বরফে ঢাকা পাহাড়চূড়া
পাহাড়প্রেমী মানুষকে সারা বছর ধরেই পাহাড় টানে। আর পাহাড়কে ছুঁতে পারার নেশায় মানুষ ছুটি জমায়, টাকা জমায় একটু একটু করে। যাঁরা বড়ো বড়ো পর্বত অভিযান করতে পারেন না অথচ পাহাড় স্পর্শ করার আনন্দ পেতে চান তাদের জন্য ছোটো একটি ট্রেকের সুলুকসন্ধান রইল।
সিকিমের রাভাঙলার নিকটস্থ দুটি ট্রেক খুব জনপ্রিয়- মিনাম হিল ট্রেক ও টেনডং হিল ট্রেক । তবে দুটি ট্রেক এর মধ্যে দ্বিতীয়টি অপেক্ষাকৃত সহজ। তাই দ্বিতীয় ট্রেকটির কথাই আজ থাকুক পাঠকদের জন্য। টেনডং হিল ট্রেক শুরু হয় ডামথ্যাং বাজার থেকে। ডামথ্যাং বাজারের নিকট দর্শনীয় কোন স্থান না থাকায় এটা এখনও তথাকথিত পর্যটন মানচিত্রে জায়গা পায়নি। তাই হোমস্টে বা হোটেল সেভাবে এই জায়গায় গড়ে ওঠেনি বা কিছু যদি থেকেও থাকে তার সংখ্যা নগণ্য। তাই রাভাংলার যেকোনও হোটেলে থেকে বাকি গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো ভ্রমণ করতে হবে পরিকল্পনামাফিক।
রাভাঙলা থেকে খুব ভোর ভোর যাত্রা শুরু করে আধ ঘন্টায় পৌছে যাওয়া যায় ডামথ্যাং বাজার। এখান থেকে একটা ফুটব্রিজ অতিক্রম করে শুরু হয় টেনডং হিল ট্রেক। এটি একটি বৌদ্ধ তীর্থস্থান বলে মোটামুটি সমগ্র রাস্তাতেই ধাপ কাটা সিঁড়ি রাস্তা। তীর্থযাত্রীরা এই পথ দিয়ে যাতায়াত করেন। তাই বেশিরভাগ পথটাই কম দুর্গম। এই সিঁড়ি-পথ ধরে হেঁটে হেঁটেই পৌছে যাওয়া যাবে টেনডং হিলটপ। গাইডের প্রয়োজন তেমন নেই এ পথে। তবে পুরো রাস্তাটাই গা ছমছমে গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। আদিম অরণ্যের ঘ্রাণ পাবেন এই জঙ্গল পথে। আলো-আঁধারি-মাখা মায়াভরা এ পথে যুগ যুগান্ত ধরে তীর্থযাত্রীরা আসছেন বৌদ্ধদের এই পবিত্র তীর্থস্থানে। অনেক গল্পগাঁথা জড়িয়ে আছে এই জায়গার সঙ্গে। শোনা যায় প্রাচীনকালে এক ভয়াবহ বন্যার সম্মুখীন হয় এখানকার মানুষ। সমস্ত চরাচর ভেসে যায় সেই বন্যায়। তখন এই পাহাড়ের মাথায় উঠে প্রাণ বাঁচায় এখানকার আদিবাসীরা। লেপচা উপকথা অনুসারে টেনডং শব্দের অর্থ উত্থিত শৃঙ্গ। এই জঙ্গলের রাস্তায় নানারকম পাখি, রেড পান্ডা, লেপার্ড ইত্যাদি দেখতে পাওয়া যায়। শুকনো পাতায় ঢাকা, কোথাও রোদ-মাখা, কোথাও স্যাঁতসেঁতে এই রাস্তা ধরে পাহাড় চড়তে চড়তে পাখির ডাক ও জঙ্গলের শান্ত সমাহিত পরিবেশ মনটাকে কয়েক লহমার জন্য হলেও এখনকার সময় থেকে, আধুনিক বৃত্ত থেকে সরিয়ে পৌঁছে দেবে আদিতে, যখন জঙ্গলের বিস্তার ছিল আরও অনেক বেশি, যখন কোলাহল, সভ্য জগতের ভালো-মন্দ অনুষঙ্গ ছিলই না। এই পথে গাছেদের আকার, লতাগুল্ম, ঝোপ সব দেখে ইংরেজি ছবির রোমহর্ষক ছবির সেট বলে মনে হতেই পারে।
ট্রেক শেষ হওয়ার পর পাহাড়ের মাথায় আছে একটা ছোট্ট গুম্ফা, একটা স্থানীয় দোকান, ছোটো একটা স্কুলঘর , আর একটা ত্রিতলবিশিষ্ট ওয়াচটাওয়ার। ওয়াচটাওয়ার থেকে সিকিমের যে ৩৬০ ডিগ্রি দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়, তা দেখার পর পর্যটকদের সব ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে নিমেষেই। নীল আকাশের নীচে কাঞ্চনজঙ্ঘা ও অন্যান্য তুষারাবৃত শৃঙ্গের ঝলমলে উপস্থিতি মনের স্মৃতিকোঠায় চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে সবার। ছোট্ট সুন্দর বৌদ্ধ গুম্ফা, স্মারক স্তূপ, নানা গাছে ঘেরা আদিগন্ত চরাচর ছেড়ে ফিরে আসতে চাইবে না মন।
ডামথ্যাং বাজার থেকে হেঁটে টেনডং পাহাড় উঠতে মোটামুটি ঘন্টাতিনেক সময় লাগবে। ভাগ্য ভালো থাকলে কোন এক পাহাড়ি কুকুর হয়তো আপনাকে সঙ্গ দিতে পারে সমগ্র রাস্তায় পথপ্রদর্শক হয়ে। আর তেমন লোকজনের দেখা নাও মিলতে পারে এই ট্রেকিং পথে। তবে বৌদ্ধদের উৎসবের দিনগুলোয় হয়তো লোক সমাগম হয়।
রাভাঙলা থেকে সূর্য ওঠার আগে বেরিয়ে পড়লে মাঝরাস্তায় রেয়ং সানরাইস ভিউপয়েন্ট থেকে সূর্যোদয়ের শোভা বেশ মনোরম। রাভাঙলা থেকে টেনডং হিল ট্রেক যাওয়া আসা মিলিয়ে মোটামুটি ৮-৯ ঘন্টা সময় রাখতে হবে হাতে।
বিভিন্ন বাজেটের নানা ধরণের হোটেল আছে রাভাঙলায়। নিউ জলপাগুড়ি থেকে সরাসরি গাড়ি বুক করে চলে আসতে পারেন রাভাঙলা। গাড়িভাড়া পড়বে ৪০০০-৫০০০ টাকা। অল্প খরচে ভ্রমণ করতে চাইলে শিলিগুড়ি থেকে নামচি শেয়ার জিপে এসে, সেখান থেকে আবার রাভাঙলার শেয়ার জিপ পাওয়া যায়। নামচি থেকে রাভাঙলা যাওয়ার রাস্তায় রাভাঙলার ১৩ কি.মি। আগে আসবে ডামথ্যাং বাজার। এখান থেকে ডানদিকের রাস্তায় ৮-৯ কি.মি গেলে পাওয়া যায় আর একটি দ্রষ্টব্য স্থান - টেমি টি গার্ডেন।
সামনের কোনও ছুটিতে ঘুরে আসতেই পারেন সিকিমের রাভাংলা আর সেখান থেকে টেনডং পাহাড়।