সংক্ষিপ্ত

  • শেষ বেলায় ২০২০
  • দরজায় কড়া নাড়ছে নতুন বছর
  • গোটা বছরটাই লকডাউনে থমকে ছিল
  • দুনিয়ায় বহু ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটেছে এই বছরেই

তপন মল্লিক-  শেষ বেলায় ২০২০। দরজায় কড়া নাড়ছে নতুন বছর। কোভিডের কারণে প্রায় গোটা বছরটাই লকডাউনে থমকে ছিল। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর মিছিল ছাড়াও আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় বহু ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটেছে ২০২০-র বছরটিতে। হয়েছে সংঘাত,  রাজনৈতিক পালাবদল এবং নানা বিষয় নিয়ে তর্ক বিতর্ক। একনজরে তার  কয়েক ঝলক। 

অস্ট্রেলিয়ায় দাবানল
২০২০-র শুরুতেই প্রায় মাস দুই ধরে ভয়াবহ দাবানলে পুড়েছে অস্ট্রেলিয়া। তাতে প্রাণ হারিয়েছেন অন্ততপক্ষে ১৮ জন। মানুষ ছাড়াও  দাবানলে প্রাণ হারিয়েছে ছোট-বড় প্রায় ৫০ কোটি বন্যপ্রাণী। ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে অরণ্য সম্পদ ও বন্যপ্রাণের। এই ক্ষতির বিরাট প্রভাব পড়েছে বিশ্ব প্রকৃতি ও পরিবেশের ওপর।  

ঝাঁকে ঝাঁকে পঙ্গপাল
শুধু কি করোনা,  ভয়ঙ্কর আতঙ্কের মধ্যেই কেনিয়া ও পশ্চিম ভারতের একাধিক রাজ্যের ক্ষেতগুলতে ধেয়ে আসে পঙ্গপালের ঝাঁক। সেই সময় কৃষকদের দিন কেটেছে দুর্বিষহ আশঙ্কায়। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ছবিতে দেখা গিয়েছে, মাইলের পর মাইল থেকে উড়ে আসছে পঙ্গপালের দল। মেঘের মতো ঢেকে ফেলছে পুরো আকাশ। তারা খেয়ে ফেলছে ফসল।

ধুলোর ঝড়
এরপর আরেক বিপত্তি বাধে ধুলো ঝড়ে। পঙ্গপালের মতোই আফ্রিকার উপকূল থেকে সাহারা মরুভূমি ফেরত ধুলো বাতাস বয়ে আসে। নাসার একটি উপগ্রহ চিত্রে দেখা যায়,  দীর্ঘ দু’হাজার মাইল লম্বা ভয়ঙ্কর এক ধুলোর ঝড় ধেয়ে আসছিল। পরে অবশ্য তার দাপট শেষ হয়য় উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের উপরে ধুলোঝড়টি আছড়ে পড়লে।

কয়েকশো হাতির মৃত্যু
এই ধরণের প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যেই আফ্রিকার দেশ বতসোয়ানায় রহস্যজনকভাবে মাত্র ষাট দিনে মৃত্যু ঘটে শত শত হাতির। এইভাবে গণহারে হাতিদের মৃত্যুর ঘটনা বিগত কয়েক বছরের মধ্যে হয়নি বলে জানা যায়। আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ন্যাশনাল পার্ক রেস্কিউ’ সূত্রে জানা যায়, বতসোয়ানায় মে মাসের শুরু থেকে জুলাই মাসের মধ্যে ওই সংস্থার কর্মীরা বতসোয়ানার উত্তরাঞ্চলের ওকাভাঙ্গা বদ্বীপ থেকে সাড়ে তিনিশোটিরও বেশি মৃৎ হাতির দেহ উদ্ধার করে। খবরে বলা হয়, আফ্রিকা মহাদেশে ক্রমশই হাতির সংখ্যা কমছে। আফ্রিকা মহাদেশের ৩ ভাগের এক ভাগ হাতির বাস বতসোয়ানায়।

ভ্যামকো ও আমফান 
করোনাকালেই ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলার কাছাকাছি একটি উপকূলে ভয়াবহ আঘাত হানে টাইফুন ভ্যামকো। ভয়াবহ সে দুর্যোগে ৬৭ জনের প্রাণহানি ঘটে বলে জানা যায়। প্রায় একই সময় প্রবল ঘূর্ণিঝড় আমফানের আঘাতে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দক্ষিন ২৪ পগনার কয়েকটি অঞ্চল-সহ বাংলাদেশের একটা বিরাট অংশ।

জ্বালানি তেলের দর পতন
করোনাকালে লকডাউনে পৃথিবী প্রায় অচল ছিল। যানবাহন থেকে শুরু করে কল কারখানা সবই প্রায় ছিল বন্ধ। সেই পরিস্থিতিতে বিশ্বজুড়ে তেলের চাহিদা বিপুল পরিমাণে কমে যায়। এর ফলে তেলের যোগানও উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়ায় বিশ্বজুড়েই তেলের দাম হু হু করে কমে যায়। চলতি বছর ওই সময় তেলের দাম কমে এই শতকের সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছায়। গত ২২ এপ্রিল তেলের দাম দাঁড়ায় প্রতি ব্যারেল ১৬ ডলারে, যা ১৯৯৯ সালের পর সর্বনিম্ন।

চরম বেকারত্ব
করোনার কারণে তেলের দাম যেমন কমেছে, তেমনি বেকারত্ব  বেড়েছে চরম। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীনে এমন অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে যে সে দেশে বেকারত্ব বেড়ে গত ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ হয় চলতি বছরে। গত কয়েক বছরে পরিসেবার ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান বাড়ায় চীনের শ্রমবাজারে স্থিতিশীলতা আসে। কিন্তু করোনাভাইরাসের অতিমারির কারণে বেকারত্ব বাড়ায় শ্রমবাজারে নামে ধস। 

ভ্যান গগের ছবি চুরি
করোনা কালে লকডাউন চলাকালীন নেদারল্যান্ডসের লরেন নগরের সিংগার লরেন জাদুঘর থেকে চুরি হয়ে যায় ভিনসেন্ট ভ্যান গগের একটি ছবি। নেদারল্যান্ডস পুলিশ জানায়, চোরেরা গভীর রাতে জাদুঘরের সামনের কাচের দেয়াল ভেঙে জাদুঘরে ঢুকে ভ্যান গগের ‘স্প্রিং গার্ডেন’ নামের ছবিটি চুরি করে। ওই সময় অ্যালার্মের শব্দ শুনে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছায় কিন্তু ততক্ষণে চোরেরা ছবি নিয়ে পগার পার। 

বেরুত বন্দরে ভয়াবহ বিস্ফোরণ
গত ৪ আগস্ট লেবাননের রাজধানী বৈরুত বন্দরে ভয়াবহ এক বিস্ফোরণে প্রাণ হারায় প্রায় দেড়শো মানুষ। ওই দুর্ঘটনায় আহত হয় আরও ৫ হাজার মানুষ। ওইদিন সন্ধ্যায় ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে বেরুত। ধোঁয়ায় ছেয়ে যায় গোটা শহরের আকাশ।

উইগুর মুসলিমদের ওপর নির্যাতন
করোনার বছরে নিন্দনীয় ঘটনা চীনে সংখ্যালঘু উইগুর মুসলিমদের ওপর নির্যাতন।  সম্প্রতি এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, ‘ফেস রিকগনেশন’ অ্যাপ ব্যবহার করে ওই অঞ্চলের সংখ্যালঘুদের নজরদারিতে রেখেছে চীন। বিশ্বজুড়ে সমালোচিত হওয়ার পরেও চীন উইগুর মুসলিমদের দিকে নজর রাখতে ফেস রিকগনেশন অ্যাপের ব্যবহার অব্যাহত রেখেছে।

নাইজেরিয়ায় গণহত্যা
গত ২৮ নভেম্বর নাইজেরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে কৃষকদের ওপর নারকীয় অত্যাচার চালায় সশস্ত্র একদল দুষ্কৃতী। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ওই গণহত্যায় অন্তত ১১০ জনের মৃত্যু হয়। নাইজেরিয়ার জেরে বোরনো অঙ্গরাজ্যের মাইদুগুরি এলাকার কাছে কোশবে গ্রামের স্থানীয়দের ওপর ওই হত্যাযজ্ঞ চালায় মোটরসাইকেলে চেপে আসা দুষ্কৃতীরা। তখন নারী ও পুরুষ কৃষকরা ক্ষেতে কাজ করছিল। হামলায় বহু কৃষক আহত হন।

প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের আগুন
করোনার বছরে পৃথিবীর বেশ কিছু দেশে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভও দেখা গিয়েছে। জুন মাসে হংকঙে চীন বিরোধী বিক্ষোভ দমন করতে নতুন জাতীয় নিরাপত্তা আইন আনার প্রস্তাব করলে হংকঙে ব্যাপক প্রতিবাদ বিক্ষোভ শুরু হয়। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ চলে প্রতিবাদকারীদের। গ্রেপ্তার হয় শত শত মানুষ। এরপর চীন দেশদ্রোহিতা, বিচ্ছিন্নতাবাদ, নাশকতা নিষিদ্ধ করে নতুন জাতীয় নিরাপত্তা আইন পাশ করে। সমালোচকরা বলেন, হংকঙের সংবিধানে দেশটিকে যে স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে তা ওই আইন তা খর্ব করে। 
গত জুলাই মাসে থাইল্যান্ডের রাজতন্ত্র আর রাজনৈতিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটানোর দাবিতে হাজার হাজার বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-ছাত্রী রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ শুরু করে। থাইল্যান্ডের রাজার ক্ষমতা খর্ব করার দাবি জানায় তারা। রাজার জন্য জনগণের অর্থ ব্যয়েরও সীমা বেঁধে দিতে চায় তারা। থাইল্যান্ডের আধুনিক ইতিহাসে রাজাকে এরকম প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ করার এরকম উদাহারণ আর নেই। বিক্ষোভ দমনে সরকার সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা  জারি করে।  

বেলারুশে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন

গত ৯ আগস্ট বেলারুশে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল প্রত্যাখান করে বিক্ষোভ শুরু করে বিরোধীরা। ২৬ বছর একনাগাড়ে ক্ষমতায় থাকা প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কোর পদত্যাগের দাবিতে এই বিক্ষোভে যেভাবে দেশটির মানুষ অংশ নেয় তা ছিল অভূতপূর্ব। করোনার ঝুঁকি উপেক্ষা করে লাখো লাখো মানুষ পথে নামে। তারা নির্বাচনে বিরোধী প্রার্থী স্ভেৎলানা তিখানোভস্কায়াকেই বিজয়ী ঘোষণার দাবি জানায়। হাজার হাজার মানুষকে আটক করা হয়। 

বেরুতের ভয়াবহ বিস্ফোরণ

বেরুতের বন্দর এলাকায় ভয়াবহ বিস্ফোরণের জন্য সরকারকে দায়ী করে রাস্তায় নামে বেরুতবাসী। গণ অসেন্তোষের মুখে পদত্যাগ করেন প্রধানমন্ত্রী হাসান দিয়াব। ইতোমধ্যেই দেশের রুগ্ন অর্থনীতি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বেকারত্ব, দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের দাবিতে বিক্ষোভ চলে।