সংক্ষিপ্ত
আজও এই পুজো নিষ্ঠা সহকারে করেন শেঠ পরিবারের সদস্যরা। কথিত আছে ওই দুর্গাপুজো দেখতে ওই বাড়ী এসেছেন শরৎচন্দ্র চট্ট্যোপধ্ধ্যয়, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় , জগদীশ চন্দ্র বসু।
চন্দননগরের কথা মনে আসতেই প্রথমেই যেটা মনে ভাসে সেটা হল জগদ্ধাত্রী পুজো। কিন্তু জগদ্ধাত্রী পুজোর জন্য চন্দননগর প্রসিদ্ধি লাভ করলেও, শেঠ বাড়ির দুর্গা পুজো দেখতে এখনও রাজ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষজন আসেন। হরিহর শেঠের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার চন্দননগরের পালপাড়ায়। পিতার নাম নিত্যগোপাল শেঠ আর মায়ের নাম কৃষ্ণভবানী দেবী। তৎকালীন শিক্ষিত বঙ্গসমাজে হরিহর শেঠ ছিল অন্যতম একটি নাম। 'প্রবাসী', 'ভারতবর্ষ', 'মাসিক বসুমতী' 'বঙ্গবাণী', 'ভারতী', 'বিচিত্রা' 'প্রদীপ' প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন তিনি।
হুগলি জেলায় প্রচুর ধরনের পুজো হয়। তার মধ্যে বেশ কিছু প্রাচীন জমিদার বাড়ীর পুজোও আছে । আমরা যদি চন্দননগরের কথা বলি, তবে সেখানে পাবো শেঠ বাড়ীর ঐতিহ্যশালী দুর্গাপুজো । যে একটু ইতিহাসের পাতা ওলটালে দেখা যাবে চন্দননগরের রূপকার ছিলেন হরিহর শেঠ। একদিকে ব্যবসায়ী , অন্যদিকে সাহিত্যিক , সমাজসেবী। আধুনিক চন্দননগর গঠনে যার ভূমিকা অনস্বীকার্য। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে চন্দননগরে প্রথম মহিলা উচ্চ বিদ্যালয় 'কৃষ্ণভবানী নারীশিক্ষা মন্দির' গঠন করেন। বিশাল পাঠাগার সঙ্গে নাট্যমঞ্চ নিয়ে 'নিত্যগোপাল স্মৃতি মন্দির', অঘোরচন্দ্র শেঠ প্রাইমারি স্কুল-সহ দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয় তিনি স্থাপন করেন।
আধুনিক চন্দননগর গঠনে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাঁকে যোগ্য সংগতি দিয়েছিলেন তাঁর ভাই স্বাধীনতা সংগ্রামী তথা বিপ্লবী অনুশীলন সমিতির সদস্য দুর্গাচরণ শেঠ। আজও এই পুজো নিষ্ঠা সহকারে করেন শেঠ পরিবারের সদস্যরা। কথিত আছে ওই দুর্গাপুজো দেখতে ওই বাড়ী এসেছেন শরৎচন্দ্র চট্ট্যোপধ্ধ্যয়, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় , জগদীশ চন্দ্র বসু।
১৯৪৯ সালের ২৯ জুন গণভোটে চন্দননগর স্বাধীন হয়। ফরাসি সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করে সেই সময় স্বাধীন চন্দননগরের প্রথম অ্যাডমিনিস্ট্রেটর ছিলেন হরিহর শেঠ । ফরাসি সরকারের তরফ থেকে তিনি পেয়েছিলেন দেশের সর্বোচ্চ অসামরিক সন্মান ' লিজিয়ন ওফ অনার'। হরিহর শেঠের দান চন্দননগরের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে । তাঁর বিখ্যাত অট্ট্যলিকা আজ হেরিটেজ সম্পত্তি। শোনা যায় বৈবাহিক সূত্রে শ্বশুরবাড়ী থেকে পালপাড়া এলাকায় ওই পুজোর দায়িত্ব পেয়েছিলেন হরিহর শেঠ।
পুজোর আচার আয়োজন বাড়ির মহিলারা করতেন। ওই বাড়ির দুর্গাদালানে বাড়ির মহিলারা বিভিন্ন খাবার করে রেখে আসতেন । কারণ প্রচুর বিপ্লবী লুকিয়ে ওই দুর্গাদালানে আসতেন। আর শেঠ বাড়ির মহিলাদের গোপন দায়িত্ব ছিল তাঁদের জন্য রান্না করে খাদ্যের যোগান দেওয়া। এই পুজোর বিশেষ বৈশিষ্ট হল ডাকের সাজে মায়ের স্নিগ্ধ মূর্তি। প্রতি বছর কাঠামো একই থাকে, তার ওপর মাটি দিয়ে মূর্তি গড়া হয়। প্রচলিত প্রথা পুজোর উপকরণ জোগাড় করা এবং নৈবেদ্য সাজানো সবই করেন বাড়ির মহিলারা। সিঁদুর খেলার জন্য বিখ্যাত এই পুজো।
হরিহর শেঠের বংশে তৎকালীন সমাজে পর্দাপ্রথা ছিলো বাড়ির মহিলাদের। তাই অনেক কিছু বিধি-নিষেধ ছিল। হরিহর শেঠ ছিলেন মুক্ত মনের মানুষ। তিনি ঠিক করেছিলেন বাড়ির মহিলারাই থাকবেন এই দুর্গাপুজোর পুরোভাগে । দুর্গাপুজোয় অষ্টমীতে হত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। রেওয়াজ ছিল, বিসর্জনের দিন জেলেরা এসে মাকে কাঁধে করে নিয়ে গিয়ে গঙ্গায় বিসর্জন দেবেন। তবে একালে আর ওই নিয়ম চলে না, পাড়ার লোকেরাই কাঁধে করে নিয়ে গিয়ে প্রতিমা নিরঞ্জন করেন।