সংক্ষিপ্ত

আল-কায়দা সন্ত্রাসীরা টুইন টাওয়ার এবং পেন্টাগন আক্রমণ করার কিছুক্ষণ পর থেকেই, ভারতীয়-আমেরিকান সহ অনেক মুসলমান মানুষ রাগ এবং বর্ণবিদ্বেষের শিকার হন। কিন্তু, প্রকৃত তথ্য এটাই যে, ৯/১১ হামলায় যাঁরা প্রাণ হারিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে ৩১ জন ছিলেন মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ। 

২০০১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর, আমেরিকার ব্যস্ততম  শহর নিউ ইয়র্ক সিটির উপর আকাশ সেদিন ঝলমলে। ম্যানহাটনের টুইন টাওয়ারের খুব কাছে একটি বিল্ডিংয়ে কাজ করার সময় শহরের অন্যান্য অনেক ভারতীয়ের মতো অপূর্ব বর্মাও ভাবছিলেন, একজন পাইলট কীভাবে এমন পরিষ্কার দিনে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের একটি টাওয়ারের দিকে ছুটে যেতে পারে। তিনি তাঁর স্ত্রী আনুশাকে জানাতে বাড়িতে ফোন করেছিলেন। গগনচুম্বী দালান থেকে ধোঁয়া বেরোতে দেখে সে তার ছোট ছেলেকে নিয়ে ছুটে গিয়েছিল।

রুজভেল্ট দ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তে দাঁড়িয়ে যেখানে পরিবারটি তখন বাস করত, ম্যানহাটনের স্কাইলাইনের দিকে তাকিয়ে সেখান থেকেই তিনি দ্বিতীয় টাওয়ারটিকে আঘাত করা দেখতে পেয়ে শিউরে উঠেছিলেন। তিনি জানতেন যে, তাঁর স্বামী ওই এলাকার খুব কাছাকাছি ছিল। এরপর ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। "এটি প্রচণ্ড উদ্বেগের ছিল, ভীষণ উদ্বেগ। অপূর্ব কোথায় তা আমরা জানতাম না। তিনি আমাকে ফোনে জানিয়েছিলেন যে, তাঁদের বিল্ডিংয়ের ভেতরে থাকতে বলা হয়েছে!” স্মরণ করে স্থির হয়ে থাকেন অনুষা শ্রীবাস্তব। 

তীব্র সাইরেনের শব্দ, আতঙ্ক, বিভ্রান্তি, বিশৃঙ্খলা এবং অনিশ্চয়তা শহরটাকে সেদিন ঘিরে ফেলেছিল।  তিনি আরও বলেন, "তিন ঘণ্টা পর তিনি বাড়িতে পৌঁছানো পর্যন্ত আমরা তার অবস্থান সম্পর্কে জানতাম না। তিনি শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে দুটি সেতু পার হয়ে বাড়ি ফিরে আসার জন্য লম্বা রাস্তা হেঁটে এসেছিলেন। শহর তখন ধুলোয় আচ্ছন্ন, ধসে পড়া টাওয়ারের ধ্বংসাবশেষ থেকে!"

আরেকটি বিমান ওয়াশিংটন ডিসির পেন্টাগনে উড়েছিল। একটি চতুর্থ বিমান, সম্ভবত হোয়াইট হাউস বা ইউএস ক্যাপিটলের দিকে যাচ্ছিল যাত্রীদের নিয়ে, অত্যন্ত তৎপরতা এবং কৌশলের সাথে সেটির মুখ ঘুরিয়ে দেওয়া হয় এবং পেনসিলভানিয়ার একটি খালি মাঠে অবতরণ করা হয়।

৯/১১ স্মারক স্থানে ব্রোঞ্জে ৩,০০০টি নাম খোদাই করা আছে, যেখানে একসময়ে উত্তর এবং দক্ষিণ টুইন টাওয়ার ছিল। ৯/১১ হামলায় আহত এবং মারা যাওয়ার সময় তাঁরা কোথায় ছিলেন এবং কে কার সাথে ছিলেন, সেই অনুসারে এই নামগুলি প্যানেলে সাজানো হয়েছে। 

স্মৃতিসৌধের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুসারে, এই নিহতদের মধ্যে ৩২ জনেরও বেশি মানুষ ভারতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁদের অনেকেই টুইন টাওয়ারে কাজ করতেন এবং কয়েকজন সেই বিমানের ভেতরেই ছিলেন যেগুলো সন্ত্রাসী হামলায় ব্যবহার করা হয়েছিল, এমনকি একজন ডাক্তারও ছিলেন। আমেরিকান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ১১-এ চড়া শেষ ব্যক্তিদের মধ্যে একজন ছিলেন ভামকৃষ্ণ পেন্ডিয়ালা, লস অ্যাঞ্জেলেসে তাঁর স্ত্রী কালহস্তী প্রসন্নের সাথে দেখা করতে উড়ে এসেছিলেন তিনি। এটিই প্রথম বিমান যা ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের দিকে লক্ষ্য করে উড়েছিল। তিনি তার স্বামীকে হারানোর ক্ষতি সহ্য করতে প্রচণ্ড লড়াই করেছিলেন এবং ৩৭ দিন পর প্রাণ ত্যাগ করেন।

শান্তি নামিয়েমের বাবা জুপিটার ছিলেন একজন ভারতীয়, যিনি ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের নর্থ টাওয়ারের ১০৭ তলায় অবস্থিত একটি রেস্তোরাঁ উইন্ডোজ অন দ্য ওয়ার্ল্ডের ভোজ ব্যবস্থাপক ছিলেন। তিনিও সেদিনের দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। জুপিটার লোয়ার ম্যানহাটনের প্রশংসিত রেস্তোরাঁয় নিজের কাজের জন্য সুপরিচিত ছিলেন, সেলিব্রিটি এবং রাষ্ট্রপতিরা সেখানে ঘন ঘন আসেন। তিনি এবং তার আমেরিকান স্ত্রী ন্যান্সি একটি ঐতিহ্যবাহী মণিপুরী বিয়ের অনুষ্ঠানও করেছিলেন। স্ত্রী এবং মেয়েকে ছেড়ে রেখে তাঁকে যখন ১১ সেপ্টেম্বর চলে যেতে হল, শান্তির বয়স তখন মাত্র ৫ বছর। শান্তি এবং তাঁর মা নিজেদের বাড়িতে প্রতি বছর স্মরণীয় অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে জুপিটারের জীবনকে সম্মান জ্ঞাপন করেন। মণিপুরে জুপিটারের ভাইরা দিনটিকে আচার-অনুষ্ঠান এবং ঐতিহ্যবাহী ভোজের সাথে শোক পালন করে।

৯/১১-এ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নজিরবিহীন আক্রমণ শুধুমাত্র আমেরিকান এবং বিদেশী নাগরিকদের জীবনকে প্রভাবিত করেনি, এটি আমেরিকাকে দুঃখ এবং দেশপ্রেমের বন্ধনে একত্রিত করে রেখেছে। ৯/১১-র এই হামলা ক্ষোভ ও ঘৃণার উদ্রেক করে। 

আল-কায়দা সন্ত্রাসীরা টুইন টাওয়ার এবং পেন্টাগন আক্রমণ করার কিছুক্ষণ পর থেকেই, ভারতীয় আমেরিকান সহ অনেক মুসলমান মানুষ রাগ এবং বর্ণবিদ্বেষের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন। কিন্তু, প্রকৃত তথ্য এটাই যে, ৯/১১ হামলায় যাঁরা প্রাণ হারিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে ৩১ জন ছিলেন মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ।  বিমানের যাত্রীদের মধ্যে মুসলিম ছিলেন ৩ জন।

“আমরা ৯/১১-এর পর শিখ এবং অন্যান্য কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক অপরাধ ব্যাপকভাবে বাড়তে দেখেছি। শিখরা এই বিদ্বেষের সহজ টার্গেট ছিল, কারণ আমাদের পাগড়ি দেখে সহজেই চিহ্নিত করা যায়। আমরা ৯/১১-এর এই প্রতিক্রিয়ার বড় ধাক্কা খেয়েছিলাম”, বলেছেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল কমল সিং কালসি, বর্তমানে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিখদের পক্ষে একজন বিশিষ্ট আইনজীবী, SAVA (শিখ আমেরিকান ভেটেরান্স অ্যালায়েন্স) এর প্রতিষ্ঠাতা, মার্কিন সামরিক বাহিনীতে তিনিই প্রথম শিখ, যাঁকে পাগড়ি পরার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। 

৯/১১ দুর্ঘটনার পর সাধারণ আমেরিকাবাসীর বর্ণবিদ্বেষের শিকার হয়েছিলেন পশুচিকিৎসক সত হনুমান সিং খালসাও।  তিনি চিকিৎসার কারণে ম্যাসাচুসেটস থেকে এসেছিলেন। "পার্কিং লটের লোকেরা আমাদের দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছিল। রাস্তার লোকেরা আমার দিকে রাগের চোখে তাকাচ্ছিল।" তিনি আরও বলেন, "যখন আমরা আমার বন্ধুর বাড়িতে ফিরে যাই, আমি সামনের লনে ফোনে আমার পরিবারের সাথে কথা বলছিলাম, তখন আমার মনে হচ্ছিল যে, আশেপাশের সব লোকজন সর্বক্ষণ আমাকে নজর করছে।"

ব্যথিত মাতৃভূমির প্রতি করুণা আর ভালোবাসা যে আচমকাই ভিন্ন প্রকৃতির মানুষদের প্রতি ভালোবাসা আর মানবিকতাকে ক্ষীণ করে তুলবে, ৯/১১-র সন্ত্রাসী হামলা আমেরিকার সাধারণ মানুষের মনে পুঁতে দিয়েছিল সেই ঘৃণার বীজ। যুগে যুগে সেই দেশে কৃষ্ণাঙ্গরা আক্রান্ত হয়েছেন শ্বেতাঙ্গদের হাতে। কিন্তু, প্রাচ্যের মানুষের ওপর সন্ত্রাসী তকমা এঁটে দেওয়া শুরু হয়েছিল সাদা পাগড়ি পরিহিত এবং একই সঙ্গে ইসলাম ধর্মাবলম্বী  ওসামা বিন লাদেনের ছবি দেখতে দেখতে। 

আচার্য বিনোবা ভাবের জন্মদিনে নরেন্দ্র মোদীর টুইটবার্তা, একই সঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দকে স্মরণ
গলার নলি কেটে জঙ্গলে ফেলে দেওয়া হল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্রকে, নৃশংস হত্যাকাণ্ডে শিহরিত বীরভূমের চৌপাহাড়ি