সংক্ষিপ্ত
রাজনৈতিক হিংসার বলিতে পশ্চিমবঙ্গ বরাবরই শীর্ষে
পিছনে পড়েছে বিহার, উত্তরপ্রদেশও
মমতার শাসনে এই গ্রাফ আরও ঊর্ধ্বমুখী
কী বলছে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকডস ব্যুরোর সর্বশেষ রিপোর্ট
শমিকা মাইতি: ন্যাশনাল ক্রাইম রেকডস ব্যুরোর সর্বশেষ রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে ২০১৮ সালে রাজনৈতিক হিংসার কারণে ভারতে ৫৪ জনের মৃত্যুর খবর নথিভুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ১২টি পশ্চিমবঙ্গের। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে যথাক্রমে বিহার (৯) ও মহারাষ্ট্র (৭)। বস্তুত, জাতপাতের দাঙ্গা অথবা সাম্প্রদায়িক হিংসা বিহার, উত্তরপ্রদেশে বেশি হতে পারে, কিন্তু রাজনৈতিক হিংসায় পশ্চিমবঙ্গ সবসময শীর্ষে। লালকৃষ্ণ আদবানী যখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তখনও, আবার সুশীল শিন্ডে-চিদম্বরমের সময়ও। তৃণমূল জমানায় হিংসার এই গ্রাফ আরও উর্ধ্বমুখী। ২০২১ সালের বিভানসভা ভোটকে ঘিরে যা চরমে উঠেছে।
গত কয়েকবারের ভোটে ‘গুড়-বাতাসা’, ‘চড়াম-চড়াম’, ‘ভ্যানিশ’ করে দেওয়ার মতো শব্দবন্ধের প্রবক্তা বীরভূমের তৃণমূল নেতা অনুব্রত মণ্ডল এবার দলীয় কর্মীদের শেখাচ্ছেন কাকে-কতটা ‘পাচন বাড়ি’ দিতে হবে। গত কয়েক মাসে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে বিজেপি কর্মীদের উপরে হামলার অভিযোগ উঠছে। কোচবিহারের দিনহাটায় বিজেপির মণ্ডল সভাপতি অমিত সরকার, নদিয়া জেলার শান্তিপুরের দীপঙ্কর বিশ্বাস ও প্রতাপ বর্মন, পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনির যুবক লালমোহন সরেন, কেশিয়াড়িতে বিজেপির সক্রিয় কর্মী মঙ্গল সরেন, বীরভূমের দুবরাজপুর ব্লকের ফকিরবেরা গ্রামের বি জেপি কর্মী পতিহার ডোম, হুগলির গোঘাটের বদনগঞ্জ এলাকায় বিজেপি সমর্থক পরিবারের কর্ত্রী মাধবী আদক- রাজনৈতিক হামলায় মৃতের তালিকা বাড়ছে বিজেপির। নিমতায় বিজেপি কর্মীর ৮৫ বছরের মায়ের মৃত্যুর পর অভিযোগ উঠেছে, তৃণমূলের গুন্ডাদের বেধড়ক মার খেয়েই তিনি মারা গিয়েছেন। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বলেন, ‘বিজেপি কর্মীর মা-কে তৃণমূলের গুন্ডারা কী নির্মম ভাবে পিটিয়েছে। প্রশাসনের উচিত, অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া, তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা। তার বদলে তৃণমূলের হয়ে কাজ করছে পুলিশ-প্রশাসন।‘
‘গুড়-বাতাসা’, ‘চড়াম-চড়াম’, ‘ভ্যানিশ’ করে দেওয়ার মতো শব্দবন্ধের প্রবক্তা বীরভূমের তৃণমূল নেতা অনুব্রত মণ্ডল
নিমতায় বিজেপি কর্মীর ৮৫ বছরের মায়ের মৃত্যুর পর অভিযোগ উঠেছে রাজনৈতিক হিংসার
বস্তুত, রাজনৈতিক প্রয়োজনে পুলিশকে বরাবরই এ রাজ্যে ব্যবহার করে এসেছে শাসকদল। কংগ্রেস জমানায় সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের আমলে বাংলা দেখেছে পুলিশের নির্মমতা। জ্যোতি বসুর আমলে যুব কংগ্রেসের মহাকরণ অভিযানে পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয়েছিল ১৩ জনের। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের শাসনকালে নন্দীগ্রামে পুলিশি অভিযানে মৃত্যু হয়েছিল ১৪ জনের। তৃণমূল জমানাতেও সেই ছবির খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। ২০১৭ সালে পাহাড়ে আন্দোলনের সময় সিংমারিতে পুলিশের ভূমিকার তীব্র সমালোচনা হয়েছে। মারা গিয়েছে ৩ জন। মাসখানেক আগে কলকাতার রাস্তায় বাম আন্দোলনকারীদের উপরে পুলিশ যে ভাবে লাঠি-জলকামান চালিয়েছে, তা যথেষ্ট নিন্দনীয়। আন্দোলনে যোগ দিতে আসা বাঁকুড়ার বাম যুবনেতা মইদুল মিদ্যার মৃত্যু হয়েছে পুলিশের গুঁতো খেয়ে। উল্টোদিকটাও আছে। গত দশ বছরে শাসকদল তৃণমূলের হাতে বারবার আক্রান্ত হয়েছে পুলিশ। ২০১৪ সালের নভেম্বরে এক ধৃতকে ছাড়ানোর দাবিতে আলিপুর থানায় হামলা চালায় একদল দুষ্কৃতী। প্রাণ বাঁচাতে টেবিলের তলায় ঢুকে ফাইল দিয়ে মাথা ঢেকে রেখেছিলেন এক পুলিশকর্মী। রাজনৈতিক গুন্ডাগিরির কাছে পুলিশ যে কতটা অসহায় এই ছবিই তার প্রমাণ। এই সরকারের আমলে বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক হিংসার বলিও হয়েছে পুলিশ। ২০১৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি গার্ডেনরিচের একটি কলেজে ভোটের ডিউটি করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান পুলিশ অফিসার তাপস চৌধুরী। ওই ঘটনায় নাম জড়ায় শাসকদলের নেতা মুন্না ইকবালের। বিচার হওয়ার আগেই মৃত্যু হয়েছে মুন্নার। ২০১৫-তে গিরিশপার্কে কলকাতা পুরভোটের ডিউটি করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন পুলিশ অফিসার জগন্নাথ মণ্ডল। সেই ঘটনাতেও শাসকদলের এক বিধায়ক ও তাঁর স্বামীর নাম জড়িয়েছিল এবং যথারীতি তাঁরা ছাড়ও পেয়ে গিয়েছেন।
"
সাধারণ মানুষ, পুলিশের পাশাপাশি এ রাজ্যে রাজনৈতিক হিংসার বলি হয়েছে ছাত্রেরাও। বাম শাসনকালে জেলার প্রায় সমস্ত কলেজে টানা ক্ষমতায় ছিল এসএফআই (কলকাতার ছবি কিছুটা আলাদা)। পালাবদলের পরে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ জেলার কলেজগুলোর দখল নিলে নিত্য অশান্তি শুরু হয়। ছাত্র সংসদের দখল নিয়ে এসএফআই ও টিএমসিপি-র মধ্যে এমন গণ্ডগোল হতে থাকে যে, কলেজের পঠন-পাঠন শিকেয় উঠে। এই প্রেক্ষিতে ২০১৭ সালে ছাত্র সংসদের নির্বাচন তুলে দিয়ে অরাজনৈতিক ছাত্র কাউন্সিলের প্রস্তাব দেয় রাজ্য সরকার। এদিকে, গত লোকসভা ভোটের পর এ রাজ্যে বিজেপির ছাত্র সংগঠন এবিভিপি মাথা চাড়া দেয়। যে সব কলেজে টিএমসিপি-র গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ছিল, সেখানে এবিভিপি-তে চলে যাচ্ছে বিক্ষুব্ধরা। তবে, এখনও গণ্ডগোল বেশি হচ্ছে টিএমসিপি-র বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে। ২০১৯ সালে দিনহাটা কলেজের ছাত্র যুব তৃণমূল কর্মী অলোকনিতাই দাসকে পিটিয়ে খুনের অভিযোগ ওঠে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের পাল্টা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে।
আরও পড়ুন - বঙ্গের কোন কোন কেন্দ্রে সহজে জিতবে বিজেপি, কোথায় লড়াই কঠিন - কী বলছে দলের গোপন বিশ্লেষণ
আরও পড়ুন - 'তৃণমূলকে ভোট না দিলে উচ্ছেদ' - প্রচারে বেরিয়ে হুমকি গৌতম দেবের, ভাইরাল হল ভিডিও
আরও পড়ুন - কৃষি না শিল্প - একদশক পর নির্বাচনে ফিরে এল পুরোনো প্রশ্ন, কী বলছে সিঙ্গুর
আসলে, শিক্ষা-স্বাস্থ্য থেকে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে বামেরা যে ভাবে রাজনীতির শিকড় ঢুকিয়ে দিয়েছে তা থেকে মুক্তি দিতে পারেনি তৃণমূল। বরং বামেদের ছত্রছায়ায় থাকা ‘মাসল-ম্যান’রা একে-একে চলে এসেছে তৃণমূলের ছাতার তলায়। ২০১৫-তে বিধাননগর পুরসভা নির্বাচন বা ২০১৮ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনে ব্যাপক সন্ত্রাস দেখেছে এ রাজ্য। সম্প্রতি রাজ্যের বেশ কিছু এলাকা রাজনৈতিক কারণে অশান্ত হয়ে উঠেছে। যেমন, ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চল। এখানকার বাহুবলী নেতা অর্জুন সিংহ তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর নিত্য বোমাবাজি চলছে ভাটপাড়া-কাঁকিনাড়া জগদ্দল এলাকা। দোকানপাট বন্ধ। মৃত্যু হয়েছে অন্তত ১০ জনের। গত জুলাই মাসে দুষ্কৃতীদের গুলিতে খুন হন টিটাগড়ের বিজেপি নেতা মণীশ শুক্ল। সেই নিয়ে তৃণমূল-বিজেপিতে চাপানউতোর চলছে এখনও। তৃণমূল নেতা শুভেন্দু অধিকারী বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পরে রাজনৈতিক ভাবে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে দুই মেদিনীপুর। বীরভূমের নানুরে বোমাবাজি হচ্ছে নিত্য। পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক কারণে মৃত্যুর সংখ্যা তিনের ঘরে উঠল বলে।