সংক্ষিপ্ত
বাংলার উন্নয়ন থেকে শুরু করে প্রাকৃতিক দুর্যোগে কলকাতায় জল জমা, রাজ্যের অর্থনৈতিক বিকাশ- একাধিক বিষয়ে রাজ্য সরকারকে আক্রমণ করেছেন সুকান্ত মজুমদার। বাংলার রাজ্য বিজেপি-র নতুন সভাপতি তিনি। সুকান্ত মজুমদার পেশাগত হিসাবে একজন অধ্যাপক। রাজ্য সভাপতি হিসাবে তাঁর এই পড়ানোর দক্ষতা অনেকটা কাজে লাগবে বলেই মনে করছেন তিনি।
বিজেপি-র রাজ্য সভাপতির (New President in Bengal BJP) পদ থেকে যে দিলীপ ঘোষ (Dilip Ghosh) সরে যেতে পারেন তার আভাষ বেশকিছুদিন ধরেই পাওয়া যাচ্ছিল। কিন্তু কে হতে পারেন নতুন রাজ্য সভাপতি তা নিয়েই জোর আলোচনা চলছিল রাজনৈতিক মহলে। সোমবার সন্ধ্যায় আচমকাই বিজেপি-র (West Bengal BJP) অন্দরমহলে তৎপরতা শুরু হয়। অবশেষে রাত ৮টার মধ্যেই মেলে সেই চূড়ান্ত খবর। যা নিয়ে চলছিল জল্পনা। কেন্দ্রীয় বিজেপি-র পক্ষ থেকে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি-কে জানিয়ে দেওয়া হয় দলের নতুন রাজ্য সভাপতির নাম। আর তিনি হলেন ডক্টর সুকান্ত মজুমদার (Dr. Sukanta Majumder)। বালুরঘাট লোকসভার বিজেপি সাংসদ। এই খবর চাউর হতেই সাংসদ মহাশয়ের ফোন চরম ব্যস্ত। অবশেষে তাঁকে পাওয়া গেলে রাত পৌনে এগারোটা নাগাদ। মোবাইল ফোনে তাঁর এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকার (Exclusive Interview) নিলেন এশিয়ানেট নিউজ বাংলার এডিটর দেবজ্যোতি চক্রবর্তী (Debojyoti Chakraborty, Editor, Asianet News Bangla)।
দেবজ্যোতি, এডিটর, এশিয়ানেট নিউজ বাংলা- তপন শিকদারের পর ফের উত্তরবঙ্গ থেকে একজন এলেন রাজ্য বিজেপি-র সর্বোচ্চ পদে। বিষয়টাকে কীভাবে দেখছেন?
ডক্টর সুকান্ত মজুমদার, রাজ্য সভাপতি, বিজেপি- বিষয়টা উত্তরবঙ্গ বা দক্ষিণবঙ্গের প্রতিনিধি এভাবেই দেখছি না। তপন শিকদার রাজ্য বিজেপি-র সভাপতি ছিলেন। তিনি মালদহের বুলবুলচণ্ডীর লোক ছিলেন। ভালো লাগছে। তবে, আমি যে দায়িত্ব পেয়েছি সেটা সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের জন্য। আমাদের সমগ্র বাংলার জন্য কাজ করতে হবে। বিজেপি-কে সমগ্র বাংলার জন্যে নেতৃত্ব দিতে হবে। এটাই এখন আমার প্রধান কর্তব্য। আমার উপরে যে গুরু দায়িত্ব এসেছে- এখন সেটাকে আমি এভাবেই দেখছি।
আরও পড়ুন- ফুলের মালা, মিষ্টিমুখ-সম্বর্ধনায় ভাসলেন নতুন বিজেপি রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার
দেবজ্যোতি, এডিটর, এশিয়ানেট নিউজ বাংলা- দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়নের ৯৫ শতাংশই কলকাতা কেন্দ্রীক বলে বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ উঠেছে, বিজেপি বাংলার সামগ্রীক উন্নয়নের কথা বলছে, এই উদ্দেশে আপনি কীভাবে দলকে পরিচালনা করবেন?
ডক্টর সুকান্ত মজুমদার, রাজ্য সভাপতি, বিজেপি- কলকাতা কেন্দ্রিক উন্নয়নে আজ বাংলার দুর্দশা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিনিয়ত জনসমাগমের চাপ বাড়ছে কলকাতায়। অধিকাংশ মানুষকেই শিক্ষা হোক বা কর্মসংস্থান- সবসময়ে কলকাতামুখী হতে হয়। এর পরিণামে আজ তিলোত্তমায় জন বিস্ফোরণ। অত্যাধিক জনসংখ্যার চাপে ভেঙে পড়েছে অর্থনৈতিক কাঠামো, ভেঙে পড়েছে কলকাতার নিকাশি ব্যবস্থা। যার জেরে আজ কলকাতা লন্ডন হতে না পারলেও ভেনিস হয়ে গিয়েছে। আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন আজ এই প্রাকৃতিক দুর্যোগে কীভাবে বিপাকে পড়েছে কলকাতা ও তার শহরতলির মানুষ। উন্নতমানের নিকাশি ব্যবস্থা নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে একাধিক প্রতিশ্রুতি দিলেও মানুষ যে প্রতারিত হয়েছেন তা চারিদিকে দেখা যাচ্ছে। কর্মসংস্থান থেকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য সর্বত্র বেহাল ছবিটা ফুঁটে উঠছে। বাংলার উন্নয়নকে তাই শুধু আর কলকাতামুখী করে রাখা যাবে না। জেলায় জেলায় ছড়িয়ে দিতে হবে। দক্ষিণবঙ্গ থেকে উত্তরবঙ্গ সবখানেই উন্নয়নের মধ্যে একটা সামাঞ্জস্য আনতে হবে। জঙ্গলমহল থেকে শুরু করে পাহাড়- সবখানেই উন্নয়নকে নিয়ে যেতে হবে। আর এর জন্য বঙ্গ বিজেপি লড়াই চালিয়ে যাবে এবং বাংলার মানুষকে সামগ্রিক উন্নয়নে প্রবেশ করানোটাই আমাদের দলের মূল লক্ষ্য। স্বাধীনতার পর থেকে যারা পশ্চিমবঙ্গের বুকে সরকার তৈরি করেছে তারা বারবার উন্নয়নের প্রশ্নে সমগ্র বাংলার সঙ্গে একটা বৈমাত্রেয়সুলভ আচরণ করেছে।
দেবজ্যোতি, এডিটর, এশিয়ানেট নিউজ বাংলা- বিজেপি সাংসদ জন বার্লা পৃথক উত্তরবঙ্গ রাজ্যে পক্ষে সওয়াল করছেন, রাজ্য সভাপতি হিসাবে আপনি কি এই এই দাবি-কে সমর্থম করছেন?
ডক্টর সুকান্ত মজুমদার, রাজ্য সভাপতি, বিজেপি- দেখুন, এই বিষয়ে দিলীপদা একটা কথা পরিস্কার করে দিয়েছেন। রাজ্য সভাপতি-র পদে থেকে তিনি বলে দিয়েছিলেন যে বিজেপি এই দাবি-কে সমর্থন করে না। বিজেপি বাংলা ভাগের বিরোধী। বঙ্গের অখণ্ডতা রক্ষা করাটাই আমাদের কাছে অন্যতম নীতি। তবে, যদি বলি উত্তরঙ্গকে পৃথক রাজ্য করার কোনও দাবি নেই- তাহলে এটা ভাবের ঘরে চুরি করার মতো হবে। কারণ এই দাবি ওঠার মূলেই রয়েছে অনুন্নয়ন এবং রাজ্য সরকারের ব্যর্থতা। জনদা যেটা বলেছেন সেটা তাঁর ব্যক্তিগত মত। তিনি দীর্ঘদিন ধরেই রাজনীতি করছেন এবং তিনি উত্তরবঙ্গের একটি এলাকার সাংসদ। তিনি এলাকাবাসীর উন্নয়নের স্বার্থ রক্ষার্থে একটা কথা বলেছেন। সেটা রাজ্য সরকারের উন্নয়নের ব্যর্থতার জন্যই তিনি বলতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ মানুষ এই রাজ্য সরকারের কাছ থেকে অনেক কিছু আশা করলেও নূন্যতম উন্নয়নের দরজা খোলা যায়নি। একজন সাংসদ তাঁর এলাকার মানুষের দাবিকে সরকারের কাছে পৌঁছে দিতে পারে। জনদা সেটাই করেছেন। আসলে উত্তরবঙ্গকে পৃথক রাজ্য করার দাবি কোনও পরিকল্পিত বিষয় নয়, একটা কথা মানতে হবে বাংলার বুকে উন্নয়নকে সামগ্রিকভাবে পৌঁছে দেওয়া যায়নি বলেই আজ দিকে দিকে এমন আওয়াজ উঠছে। বিজেপি-র কাজ হবে বাংলার সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য মানুষের লড়াইকে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বাংলার বুকে যে বিভাজনের আওয়াজ উঠেছে তাকে থামিয়ে অখণ্ডতা রক্ষার জন্য কাজ করে যাওয়া। উন্নয়নের নামে যে বৈমাত্রেয়সুলভ আচরণ জেলাগুলোকে পেতে হয় তাকে থামানো।
দেবজ্যোতি, এডিটর, এশিয়ানেট নিউজ বাংলা- বৈমাত্রেয়সুলভ আচরণের কথা যখন বললেন, তখন আপনার জেলা দক্ষিণ দিনাজপুরের নাম সবার আগে আসা উচিত, যেদিন থেকে পশ্চিম দিনাজপুর ভেঙে দক্ষিণ দিনাজপুরের জন্ম হয়েছে তারপর আরও বেশি করে অনুন্নয়নের ঘেরাটোপে আবদ্ধ হয়ে গিয়েছে এই জেলা, কী বলবেন?
ডক্টর সুকান্ত মজুমদার, রাজ্য সভাপতি, বিজেপি- আমি বালুরঘাট লোকসভার সাংসদ। একজন সাংসদ হিসাবে যা যা করা সম্ভব আমি চেষ্টা করে যাই মানুষের কাছে উন্নয়ন পৌঁছে দেওয়ার। কিন্তু, অনুন্নয়নের মূল কাণ্ডারি হল রাজ্য সরকার। তাঁরা জেলার উন্নয়নের কাঠামোকে মজবুত করতে ইচ্ছুক নন। যার জন্য দক্ষিণ দিনাজপুর আজও এক সঙ্কীর্ণ অর্থনীতির মধ্যে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে। এটা শুধু দক্ষিণ দিনাজপুর বা বালুরঘাট বলে নয়- এই হাল সারা বাংলা জুড়ে।
আরও পড়ুন- বাংলা বিজেপির নতুন সভাপতি সুকান্ত মজুমদার কে, কেনই বা তাঁকে বেছে নিলেন মোদী-শাহ জুটি
দেবজ্যোতি, এডিটর, এশিয়ানেট নিউজ বাংলা- বালুরঘাট লোকসভা কেন্দ্রের আর্থিক বিকাশে আত্রেয়ী নদীর ভূমিকা বিশাল রকমের, কিন্তু সেই নদীর বেহাল দশা নিয়ে রাজ্য সরকার নিরুত্তর, বিশবাঁও জলে পড়ে হিলি-বাংলাদেশ-তুরা করিডর। রাজ্য সভাপতি পদে আসিন হওয়াতে কি এবার এই বিষয়গুলোতে আরও একটা সদর্থক ফল প্রত্যক্ষ করা যাবে?
ডক্টর সুকান্ত মজুমদার, রাজ্য সভাপতি, বিজেপি- আত্রেয়ী নদীর বুকে যাতে জল আনা যায় তার জন্য অনেক ধরনের উদ্যোগ নিয়েছি। কিন্তু, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকারের উদাসিনতায় এই কাজ এগোচ্ছে না। আত্রেয়ীকে বাঁচানোর যে লড়াইটা করছি তাকে আরও গতি দেওয়ার অবশ্যই চেষ্টা করবো। হিলি-বাংলাদেশ-তুরা করিডরকে কার্যকর করা শুধু বিজেপি-র দাবি নয়, এটা নিয়ে বহু সামাজিক সংগঠন আন্দোলন করে চলেছে। সন্দেহ নেই বালুরঘাট অঞ্চলের অর্থনৈতিক বিকাশে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে এই করিডর। কিন্তু, এখানেও রাজ্য সরকারের সদিচ্ছা এই করিডরের বাস্তবায়নের পক্ষে অন্তরায় হয়ে রয়েছে।
দেবজ্যোতি, এডিটর, এশিয়ানেট নিউজ বাংলা- গত এক মাসের মধ্যে ৪ বিধায়ক এবং ১ সাংসদ তৃণমূল কংগ্রেসে, বিজেপি-র এই রক্ত ক্ষরণ বন্ধ করবেন কীভাবে?
ডক্টর সুকান্ত মজুমদার, রাজ্য সভাপতি, বিজেপি- যারা চলে গিয়েছে তাঁরা নিজ সিদ্ধান্তেই অন্য দলে গিয়েছেন। দলের সঙ্গে নূন্যতম আলোচনাটুকুও করেননি। করলে একটা বোঝানো যেত। এটা সম্পূর্ণরূপে একজনের নীতি ও আদর্শের বিষয়। তবে, যাঁরা অন্য দলে গিয়েছে তাঁরা না গেলেই ভালো করতেন। আলোচনা করে সমস্যা মিটিয়ে নেওয়া যেত। দলের সকলের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করাটাই আমার লক্ষ্য। দিলীপদার মতো নেতারা রয়েছেন। তাঁদের পরামর্শ অবশ্যই কাজে লাগবে। সকলের সঙ্গে বসতে হবে, কথা হবে। যাঁরা গিয়েছে আশা করি কোনও না কোনও একদিন ফের আমরা একসঙ্গে কাজ করবো। তাঁরা হয়তো তাঁদের ভুল বুঝতে পারবেন।