বোমের শব্দের মতোই দূর দুরান্তে ছড়িয়ে পড়তে থাকে তাঁর নাম। সেই সময় তাঁর দোকানে যাঁরা বাজি কিনতে আসতেন অন্নপূর্ণা দেবীকে ডাকতেন বুড়িমা বলে। এভাবেই তার নাম ছড়ায় বুড়িমার চকলেট বোম নাম হয়।
ছোটবেলায় চকলেট বোমা মানেই হল বুড়িমার চকলেট বোমা। একাল আর সেকাল সবেতেই বুড়িমার চকলেট বোমা বিখ্যাত। সে সময় কালীপুজোয় বুড়িমার চকলেট বোমা ছাড়া যেন পুজোটা পূজো মনে হতো না। কালীপুজো বা দীপাবলির সময় যত এগিয়ে আসে, ততই আমাদের মনে পড়ে এই বুড়িমার কথা।আর শব্দবাজি নিষিদ্ধ হলেও আতশবাজিও কিন্তু তৈরি করে এই ‘বুড়িমা’। তিনি আমার-আপনার কাছেও বুড়িমা, আবার আমাদের বাবা-কাকার কাছেও বুড়িমা। সকলের কাছেই তার পরিচয় বুড়িমা।
'বুড়িমার চকলেট বোমা'-র আসল পরিচয় হলো তিনি অন্নপূর্ণা দাস, যিনি বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার বাসিন্দা ছিলেন এবং দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন। তিনি শূন্য থেকে বাজি বিক্রির ব্যবসা শুরু করেন এবং তাঁর পণ্যের প্যাকেটে নিজের ছবি ব্যবহার করে এক অসাধারণ ব্র্যান্ডিং কৌশল তৈরি করেন।যার ফলে তিনি 'বুড়িমা' নামেই পরিচিতি লাভ করেন।
* জানা যাক অন্নপূর্ণা দাসের বিস্তারিত বিবরণ:
* তাঁর নাম: অন্নপূর্ণা দাস। তিনি 'বুড়িমা' নামে পরিচিত কারণ যারা তাঁর দোকানে বাজি কিনতে আসতেন, তারা তাঁকে এই নামেই ডাকতেন।
* উৎস: তিনি বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন।
* দেশভাগ ও নতুন জীবন: দেশভাগের সময় তিনি ভিটেমাটি ছেড়ে ভারতে চলে আসেন এবং পশ্চিম দিনাজপুর জেলার জলদিঘি সরকারী ক্যাম্পে আশ্রয় নেন। সেই সময় তিনি নিঃসম্বল ছিলেন।
* ব্যবসার শুরু: পেটের দায়ে বাজি বিক্রির একটি ছোট ব্যবসা শুরু করেন, যা পরবর্তীকালে এক বিশাল শিল্পে পরিণত হয়।
* ব্র্যান্ডিং: তিনি তাঁর বাজি ব্যবসার জন্য নিজের বুড়ো বয়সের ছবি ব্যবহার করেন এবং এই কৌশলটিই তাঁর পণ্যের পরিচিতি বাড়াতে সাহায্য করে। 'বুড়িমার চকলেট বোম' একটি পরিচিত ব্র্যান্ডে পরিণত হয়, যা মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে।
* সাফল্য: তাঁর সাফল্য শুধুমাত্র বাজি ব্যবসার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তিনি একজন সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তাঁর নামেই একটি সফল ব্র্যান্ড তৈরি হয়েছিল, যা বাঙালি উৎসব, বিশেষ করে কালীপুজো এবং ক্রিকেট ম্যাচের সময় বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করে।
* বর্তমান: হাওড়ার বেলুড়ে তাঁর পিয়ারিমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের পোড়ো কুটির এখন অট্টালিকায় পরিণত হয়েছে এবং তাঁর ব্যবসার ঐতিহ্য আজও বিদ্যমান।
** কীভাবে এই ব্যবসার শুরু করেন তিনি ?
ওপার বাংলায় থাকাকালীনই মৃত্যু হয় স্বামী সুরেন্দ্রনাথের। তারপর দেশভাগ। এপারে এসে সরকারি ক্যাম্প থেকে তিনি চলে যান দক্ষিণ দিনাজপুরের গঙ্গারামপুরে। সেখানে থাকাকালীনই সংসারের হাল ধরার জন্য শিখলেন বিড়ি বাঁধার কাজ। ছোট একটা কারখানাও গড়ে তোলেন তিনি, জানা যায় এমন কথাই।
তবে বেশি দিন গঙ্গারামপুরে থাকা হয়নি তাঁর। সেখানে থাকতেই এক মেয়ের বিয়ে দেন হাওড়ার বেলুড়ে। আর সেই সূত্রেই বেলুড়ের প্যারীমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে একটা দোকানঘর ভাড়া নিয়ে শুরু করেন নতুন ব্যবসা। প্রথমে আলতা-সিঁদুরের ব্যবসা করতেন তিনি। তার পাশাপাশি বিশ্বকর্মা পুজো থেকে নবান্নের সময় ঘুড়ি, দোলের সময় রঙ বা কালীপুজোর সময় বাজির ব্যবসা শুরু করেন তিনি। তখন বাজি তৈরি করতেন না তিনি। বাজি কিনে এনে বিক্রি করতেন তিনি।
তারপর যখন তিনি দেখলেন বাজির ব্যবসায় ভালই লাভ তখন তিনি বাজি বানানো শিখলেন এবং নিজেই শুরু করেন বাজি উৎপাদন। জানা যায়, বাঁকড়ার আকবর আলি নামের এক ব্যক্তি হাতে ধরে তাঁকে চকলেট বোম বানানো শেখান। তারপর বোমের শব্দের মতোই দূর দুরান্তে ছড়িয়ে পড়তে থাকে তাঁর নাম। সেই সময় তাঁর দোকানে যাঁরা বাজি কিনতে আসতেন অন্নপূর্ণা দেবীকে ডাকতেন বুড়িমা বলে। আর সেখান থেকেই তিনি তাঁর বাজির ব্যবসার নামকরণ করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বুড়িমা হয়ে ওঠে একটা ব্র্যান্ড।


