২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ব্রিটেনের আদালতে শুরু হয়েছে চাঞ্চল্য ফেলে দেওয়া লোগান মওয়াঙ্গি হত্যাকাণ্ডের (Logan Mwangi) শুনানি। সরকারি আইনজীবী ক্যারোলিন রিস যখন লোগানের হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিচ্ছিলেন আদালতে তখন সেখানে উপস্থিত সকলের চোখেই জল (The Trial of Logan Mwangi Murder Case)।
বয়স তার মাত্র পাঁচ। আর দশটা-পাঁচটা ছোট্ট শিশুর মতো সেও দুরন্ত-ডানপিটে। তার দুষ্টুমিতে সে খিলখিলিয়ে হেসে উঠত। আর ওই সরলতায় ভরা হাসি এক নিমিষে ভুলিয়ে দিতে পারত সকলকে। কিন্তু, এই হাসি আর দুষ্টুমি কি চরম ঘৃণ্য পরিণতির দিকে ঠেলে দিক ছোট্ট লোগানকে (Logan Mwangi), না মা এবং সৎ-বাবার সম্পর্কের রসায়নে সে হয়ে পড়েছিল ব্রাত্য! সাউথ ওয়েলসের ব্রিড়ডেন্ড-এর সান শহরের পাঁচ বছরের লোগান মওয়াঙ্গি-র হত্যাকাণ্ডে এখন এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে ব্রিটেনবাসী (The Trial of Logan Mwangi Murder Case)।
২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ব্রিটেনের আদালতে (Britain Court) শুরু হয়েছে চাঞ্চল্য ফেলে দেওয়া লোগান মওয়াঙ্গি হত্যাকাণ্ডের শুনানি। সরকারি আইনজীবী ক্যারোলিন রিস যখন লোগানের হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিচ্ছিলেন আদালতে তখন সেখানে উপস্থিত সকলের চোখেই জল। সকলের ভিতরটা এক গভীর অনুশোচনা আর রিরিংসায় দগ্ধ হয়ে গিয়েছে ছোট্ট লোগানের সেই নরক যন্ত্রণার কথা শুনে। একজন মা-কতটা নৃশংস হলে এমনভাবে এক শিশুকে হত্যা করতে পারে। যদিও, লোগানের মা উইলিয়ামসন এবং তার সৎ বাবা কোলে এবং এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ১৪ বছরের এক নাবালক- কেউই হত্যার কথা স্বীকার করেননি ((5 Year Old Logan Mwangi Killed by Mother-Step father and a 14 year old boy)।
আরও পড়ুন- রাশিয়ার হামলা কি তাহলে সময়ের অপেক্ষা, ইউক্রেনের বিক্ষুব্ধ অঞ্চলে সেনা পাঠালেন পুতিন
পুলিশি তদন্ত, ফরেনসিক দলের রিপোর্ট এবং ময়নাতদন্তের রিপোর্টে যা সামনে এসেছে যে কোনও মানুষের ভিতরটাকে দুমড়ে-মুচড়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। আদালতকে দেওয়া বর্ণানায় সরকারি আইনজীবী ক্যারোলিন রিস জানিয়েছেন, পাঁচ বছরের শিশু লোগানের শরীরে ৫৬টি জখম চিহ্ন পাওয়া গিয়েছে ( Logan Mwangi had 56 catastrophic Wound in his body)। ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা তাদের রিপোর্টে উল্লেখ করেছেন যে দুরন্ত স্পিডে থাকা কোনও গাড়ি হাইওয়ের উপরে অ্যাক্সিডেন্ট করলে আরোহীদের শরীর যেমন দুমড়ে-মুচড়ে যায়, লোগানের দেহটাও তেমনি পর্যায়ে ছিল। শরীরে হাত দিলেই বোঝা যাচ্ছিল যে ভিতরে অস্থি-মাংসের গঠন ভেঙে এক্কেবারে গুড়োগুড়ো হয়ে গিয়েছে।
আরও পড়ুন- পুতিনের আমন্ত্রণ গ্রহণ পাক প্রধানমন্ত্রীর, মস্কো সফরে যাচ্ছেন ইমরান খান
কী দোষ ছিল লোগানের? যার জন্য তার এমন কঠোর পরিণতি হল? সরকারি আইনজীবীর দেওয়া তথ্য বলছে, ছোট্ট লোগান কোভিড পজিটিভ হওয়ার পর থেকেই উইলিয়ামসন ও কোলের সংসারের অশান্তি চরমে ওঠে। এমনিতেই উইলিয়ামসন মানসিকভাবে লোগানের অভিভাবকত্ব নিয়ে হতাশায় ভুগছিল। যার পরিণামে বারংবার লোগানকে মারধর করা এবং শারীরিকভাবে নিগ্রহ করত উইলিয়ামসন। লোগানের সৎ বাবা কোলেও মাঝে মাঝে উইলিয়ামসনের পথেই মারধর ও শারীরিক অত্যাচারে সঙ্গী হত। লোগান কোভিড আক্রান্ত হওয়ায় তার উপরে অত্যাচারের মাত্রা আরও বৃদ্ধি পেয়ে যায়। উইলিয়ামসন এবং কোলে বুঝে উঠতে পারছিল না কীভাবে এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করবে। যার জেরে তারা আরও বেশি করে লোগানের উপরে অত্যাচার করতে শুরু করেছিল। উইলিয়ামসন এবং কোলে-কে এই কাজে সাহায্য করে তাঁদের পরিচিত বছর ১৪-র এক নাবালক।
সরকারি আইনজীবী ক্যারোলিন রিস-এর বর্ণনা করা তথ্যে আরও জানা গিয়েছে যে ছোট্ট লোগান নিখোঁজ বলে ৩১ জুলাই, ২০২১-এ পুলিশের হেল্পলাইনে ফোন করেছিলেন উইলিয়ামসন। সে সময় বারবার ফোনে পুলিশের সামনে উইলিয়ামসন এবং কোলে এমন ভাব করেছিলেন যে তাদের ছেলেকে কেউ অপহরণ করে নিয়েছে। পুলিশের হেল্পলাইনে ফোন করার খানিকক্ষণ পরেই সান শহরের ওগমোরে নদীর থেকে লোগানের দেহ উদ্ধার হয়। হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। পুলিশের অনুরোধে ছেলের মৃতদেহ সনাক্ত করেছিলেন উইলিয়ামসন এবং কোলে। উইলিয়ামসন প্রথমে পুলিশকে বলেছিলেন যে কেউ বিছানা থেকেই লোগানকে রাতের বেলায় অপহরণ করেছিল এবং যাওয়ার সময় বাগানের দরজা খোলা রেখে দিয়েছিল। ময়না তদন্তের রিপোর্ট এবং চিকিৎসকদের প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে লোগানের সারা শরীরে একাধিক আঘাত পাওয়া যায়। ময়না তদন্তের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয় নদীতে নয় লোগানের মৃত্যু হয়েছিল তার আগে। পরে আততায়ীরা নদী দেহ ফেলে দিয়েছিল। ফরেনসিক রিপোর্টেও উল্লেখ করা হয় যে পাঁচ বছরের লোগানের কাঁধের হাড় বলে কিছু ছিল না। মনে হচ্ছিল কেউ হামানদিস্তা দিয়ে থেঁতলে দিয়েছে। এমনকী মাথার পিছনে একাধিক আঘাত পাওয়া যায়। ফরেনসিক রিপোর্টে এও বলা হয় যে এই সব আঘাত মৃত্যুর অনেকটা আগে। সেই সঙ্গে আরও উল্লেখ করা হয় যে লোগানের দেহ পর্যবেক্ষণ করে যে তথ্য মিলছে তাতে নিশ্চিত যে মৃত্যুর আগে তাকে ভয়ানক শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল।
এরপরই পুলিশের সন্দেহ জাগে লোগানের মা ও বাবা-কে নিয়ে। সিসিটিভি ফুটেজ পরীক্ষা করে দেখা যায় যে ২৯ জুলাই বাড়ির সামনে এক নাবালকের সঙ্গে উইলিয়ামসনের জোর বচলসা এবং হাতাহাতি হচ্ছে। ৩১ জুলাই ভোরবেলার সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায় যে নাবালকের হাতে একটি জামার মতো কি ধরা রয়েছে এবং কোলের দুইহাতে একটি কিছু ধরা রয়েছে। এরপরই পুলিশ দফায় দফায় কোলে, উইলিয়ামসন এবং ওই নাবালককে জেরা করতে শুরু করে। ইতিমধ্যে পুলিশ এক সমাজকর্মীরও বয়ান নথিভুক্ত করে। সেই সমাজকর্মী জানায় যে লোগানের কোভিড পজিটিভ-এর রিপোর্ট তাঁর হাতে এসেছিল। এরপর সরকারের পক্ষ তিনি লোগানের শারীরিক অবস্থার খোঁজ খবর নিতে উইলিয়ামসনের বাড়ি গিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল লোগানের শারীরিক অবস্থা খতিয়ে দেখা এবং কোভিড আক্রান্তদের ক্ষেত্রে সরকারি সুযোগ-সুবিধা এবং বিমার সুবিধা বিষয়গুলি পরিবারকে অবগত করা। ওই সমাজকর্মী পুলিশকে জানান, উইলিয়ামসন তাঁকে লোগানের সঙ্গে দেখা করতে দেননি। উল্টে বলেন লোগানকে পাওয়া যাচ্ছে না।
পরে পুলিশি জেরায় উইলিয়ামসন, কোলে এবং নাবালকরা স্বীকার করে নেন যে লাগাতার শারীরিক নিগ্রহে লোগান ২৯ জুলাই থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। লোগানের দেহ যখন নদী থেকে উদ্ধার হয়েছিল তখন তার পরণে ছিল শুধু মাত্র রাত পোশাকের পাজামা। আর রাত পোশাকের জামাাট নদীর জলে ভেসে বেড়াচ্ছিল। নৃশংস এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে এখন সরব ব্রিটেন। দোষীদের কড়া শাস্তির পক্ষেই সওয়াল করছেন সকলে। শুনানি আপাতত চলবে বলেই জানা গিয়েছে। যদিও, হত্যার দায়ভার নিতে অস্বীকার করেছেন উইলিয়ামসন-কোলে এবং অভিযুক্ত নাবালক। কিন্তু, নৃশংস শারীরিক অত্যাচারের পরিণতি যে ছোট্ট লোগানের মৃত্যুকে অনিবার্য করেছে তা ফরেনসিক এবং ময়নাতদন্তের রিপোর্টেই পরিস্কার। কোভিড অতিমারি মানব সভ্যতার উপরে কঠোর কুঠারাঘাত করেছে। ছোট্ট লোগানের হত্যাকাণ্ড এই অতিমারির সময়ে মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক কালো দাগ হয়েই থেকে যাবে।