সংক্ষিপ্ত
- 'যশোদা ভবন'-এ মাঝরাতে পুলিশের হানা
- ছাত্ররা তাদের হস্টেলে নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখল সলিল চৌধুরীকে
- রেকর্ডে কথা ও সুর নাম দিয়েছেন শুধু সলিল চৌধুরি
- ঠিক কী ঘটেছিল সেদিন
তপন মল্লিকঃ গড়িয়াহাটের 'যশোদা ভবন'-এ মাঝরাতে পুলিশের হানা। তাদের কাছে খবর আছে দেশজুড়ে নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির দু-একজন রয়েছে ওই বাড়িতে। তাছাড়া ওই বাড়িটিতে আরও এক যুবক আশ্রয় নিয়েছে যার বিরুদ্ধে তিনটে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। তবে সে রাতে ওই যুবক ওরফে বাচ্চু বেঁচে গেল গৃহকর্তী বা অন্য দুই কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ভূপতি-সুরপতির মায়ের জন্যই। তিনি পুলিসকে বোঝাতে সমর্থ হয়েছিলেন, যুবকটি তাঁর ছেলে, নাম নৃপতি, সেদিনই সে নবদ্বীপ থেকে এসেছে। তখন ঠিকানা প্রমানের জন্য আধার কার্ড ছিল না কারণ; সময়টা গত শতাব্দীর মাঝামাঝি।
বাচ্চু অসমের নওগাঁ থেকে এ শহরে এসেছে পড়াশোনা করতে। থাকত ওই বাড়িতে কমরেড ভূপতি আর সুরপতি-র কাছে, দুজনেই সে রাতে পুলিসের জালে ধরা পড়লেন। বাচ্চু কেবল সে রাতেই নয়, আগেও বার দুয়েক গ্রেপ্তার হতে হতে বেঁচে গেছেন। মহম্মদ আলি পার্কে ছাত্র সমাবেশে গান গাওয়ার পর। কোনওরকমে মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা তাদের হস্টেলে নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখল তাঁকে। আরেকবার ট্রামে করে ফিরছেন, তখন থাকেন সার্কুলার রোডের এক ডেরায়, মাঝপথে ট্রাম থেকে নামিয়ে নিলেন এক কমরেড কৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়, খবর দিলেন ওই ডেরায় পুলিস 'রেইড' করেছে, বসে আছে তাঁকে ধরবে বলে।
বাচ্চুকে তখন অনেকে বাচুও বলতেন। আসল নাম সলিল চৌধুরী।ওর লেখা ও সুর করা গান 'ঢেউ উঠছে কারা টুটছে', 'বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা', 'হেই সামালো ধান হো' ততদিনে ছড়িয়ে পড়েছে বাংলা ও অসমের পথে প্রান্তরে। উল্লেখ্য, যশোদা ভবনের ওই ঘটনার পরই কাণ্ড সলিল সন্দেশখালির ভাঙড়ে গা ঢাকা দেন।
প্রায় বছরখানেক পরে পুজোর সময় সলিল কলকাতা ফিরলেন। ফিরেই এক আশ্চর্য ঘটনা। শুনলেন রেকর্ড-এ বাজছে, ‘কোনো এক গাঁয়ের বধূর কথা তোমায় শোনাই শোনো রূপকথা নয় সে নয়’। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় নিজের দায়িত্বে রেকর্ড করেছেন! মনে পড়ল যশোদা ভবনের ঘটনার কয়েকদিন আগে ভূপতি নন্দী তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন হেমন্তর কাছে। অনেক গানের মধ্যে একটা-দুটো গান পছন্দ হয় হেমন্তর। ওঠার পর রাস্তায় বেরিয়ে সলিলের মনে পড়ল আধখানা লেখা-সুর করা একটা গানের কথা। 'কোনো এক গাঁয়ের বধূ'। ফিরে গিয়ে হেমন্তকে শোনাতে পছন্দ হল তাঁর। কিন্তু বাকি আধখানা? দু'দিনের মধ্যেই সলিল লিখে সুর করলেন। আর যে সন্ধেয় তা হেমন্তর গলায় তুলে দিয়ে এলেন, সেদিন রাতে যশোদা ভবনে পুলিস এল। সলিল সুর করলেও অর্কেস্ট্রেশন করা হয়নি। সে কাজ হেমন্ত নিজেই করেছেন! রেকর্ডে কথা ও সুর নাম দিয়েছেন শুধু সলিল চৌধুরির।
এরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি অবশ্য পরেও ঘটে। সলিলকে ফের আন্ডারগ্রাউন্ড-এ যেতে হয়। এবার সলিলের নিজের কথা নয় সুকান্ত-র কবিতা 'রানার' সুর করে হেমন্তের হাতে তুলে দিয়ে গেলেন। এবারও অর্কেস্ট্রেশন করতে হল হেমন্তকে। সলিলের দিয়ে যাওয়া সামান্য 'হিন্টস' সূত্রে। আরও অবাক করা ঘটনা ঘটল সুকান্তের অনুভব কবিতা 'অবাক পৃথিবী অবাক করলে তুমি' গানটি যখন রেকর্ড হয়ে বেরল। রেকর্ডের আগে গানটি আইপিটিএ মঞ্চে গাইতেন দেবব্রত বিশ্বাস ও প্রীতি সরকার। একদিন হেমন্ত ও সলিল দুজনেই এলেন ১৭৪ই রাসবিহারী এভিন্যুতে জর্জ বিশ্বাসের বাড়িতে। তাঁদের অনুরোধ যাতে জর্জদা 'অবাক পৃথিবী’ গানটি রেকর্ড করেন। কিন্তু জর্জদা বললেন, ‘হেমন্ত তুমিই এই গানটা রেকর্ড করো। আমাকে তো ওরা (রেকর্ড কোম্পানি) গাইতে দেবে না।' সেই কথা অনুযায়ী হেমন্ত গানটি রেকর্ড করেন।
যে কমিউনিস্ট পার্টি-র জন্য সলিলের বিরুদ্ধে তিনটে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছিল, আন্ডারগ্রাউন্ড-এ যেতে হয়েছিল তারাই একদিন কিন্ত সলিল চৌধুরির কথা ও সুর নিয়ে অভিযোগ তুলেছিলেন। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় কন্ঠে রেকর্ড করা 'আয় বৃষ্টি ঝেঁপে' গানটির একটি জায়গায় ছিল, ‘হায় বিধি বড়ই দারুণ, পোড়া মাটি কেঁদে মরে ফসল ফলে না’। 'হায় বিধি' কথাটা তো 'ঈশ্বরবাদ' ও 'ভাগ্যবাদ'-কে প্রচার করা হচ্ছে! উত্তরে সলিল বলেছিলেন, ‘তাহলে 'আল্লা মেঘ দে, পানি দে' কীভাবে গাওয়া হয়?' উত্তর, ‘ওটা প্রচলিত গান’। গাঁয়ের বধূকেও সাংস্কৃতিক সেলের নেতারা ‘নেতিবাচক’ বা ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ ঘোষণা করেছিলেন। আসলে সলিলের গানের সাফল্য মন থেকে মানতে পারেন নি গোঁড়া হিঁদু মনোভাবাপন্ন কমিউনিস্ট নেতারা। আবার অনেক বছর পর চীন সফরকালে প্রমোদ দাশগুপ্ত সলিলের কাছে চেয়ে পাঠান তাঁর গণসঙ্গীত ও আধুনিক গানের ক্যাসেট।