সংক্ষিপ্ত
আফগানিস্তানের তাকিয়ে আছে গোটা বিশ্বের মানুষ। কিন্তু, সেখানে তালিবানি শাসন কায়েম হল না শান্তি থাকল, তাতে আন্তর্জাতিক মহলের বিশেষ করে ভারকের কী?
আফগানিস্তানেনিয়ে বর্তমনে অগহী গোটা বিশ্বের মানুষ। কিন্তু, দীর্ঘ দুই দশক পর আফগানিস্তান থেকে সরছে মার্কিন সেনা, ফের বাড়ছে তালিবানি ছায়া। কেন আফগানিস্তানে ব্যর্থ হল মার্কিন সেনা, বাকি বিশ্বেই বা এর কী প্রভাব পড়বে - লিখলেন সৈয়দ আতা হাসনাইন।
আফগানিস্তান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো সরে যাওয়ার পর কী হবে - এই অনিশ্চয়তা এখন গোটা বিশ্বের আলোচনার বিষয়। তালিবানরা ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তান শাসন করেছিল। তারপর মার্কিন সেনা তাদের বাস্তুচ্যুত করেছিল। এখন সেনা সরতেই তারা একের পর এক জায়গা দখল করতে শুরু করেছে। শেষ পর্যন্ত কাবুলে রাজত্ব করা তাদের লক্ষ্য। কিন্তু আফগানিস্তানে শান্তি না থাকলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং বিশেষ করে ভারতে আমরা কেন এতটা উদ্বিগ্ন? আমাদের কি আদৌ উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত?
আরও পড়ুন - আফগানিস্তানে কেন ব্যর্থ হল মার্কিন সেনা, বাকি বিশ্বে এর কী প্রভাব পড়বে
কোনও দেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব নির্ভর করে সেই দেশের ভূ-তাত্ত্বিক অবস্থানের উপর। আফগানিস্তানের ভূ-তাত্পর্যপূর্ণ তাত্পর্য হ'ল, এই দেশ মধ্য এশিয়া, ইরানের সঙ্গে চিন এবং পাকিস্তানের এবং পরোক্ষভাবে ভারতেরও সংযোগ রক্ষাকারী পথের ঠিক কেন্দ্রে অবস্থান আফগানিস্তান নিয়ে বিভিন্ন দেশের আগ্রহের মূলে রয়েছে এই কেন্দ্রীয় অবস্থান। এশিয়া, মধ্য প্রাচ্য এবং ইউরোপের মধ্যে যোগাযোগের সম্প্রসারণ, চরমপন্থী মতাদর্শের প্রজননের সম্ভাব্য ক্ষেত্র, বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের নিরাপদস্থল। আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। ফলে বিশ্বের যে কোনও ভৌগলিক অঞ্চলের তুলনায় এই অঞ্চলটির নেতিবাচক সম্ভাবনাকে অনেক বেশি।
অর্ধ আলোচ্য চুক্তি এবং অলিখিত লিখিত প্রতিশ্রুতিগুলির মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তালিবানদের বৈধতা দিয়েছে। তবে তাদের আলোচনায় কখনই তেমন কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উত্থিত হয়নি। যেটচা বোঝা যাচ্ছে এই বিপজ্জনক অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর তার সৈন্যদের উপস্থিতি চায়নি। কারণ তারা বুঝেছে একান থেকে আর কোনও ইতিবাচক ফলাফল আসবে না। তারা জানত, মার্কিন সেনা সরলেই তালিবানরা ফের সক্রিয় হবে। তবে তারা আশা করেছিল যে আৎগান জাতীয় বাহিনী তাদের ঠেকাবে এবং এর মধ্য থেকে একটি সমঝোতার সূত্র বের হবে।
আরও পড়ুন - আফগানিস্তান যুদ্ধ- ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যু, আমেরিকার একটি অকাল যুদ্ধের অবসান
আফগান সরকার ও তালিবানকে একত্রিত করার চেষ্টা করেছে ইরানও। যদিও ক্ষমতা ভাগাভাগির কোনও সূত্র তারা বের করতে পারেনি। আপাতভাবে তা সম্ভবও নয়। তালেবানরা অনেক বেশি স্মার্ট। ২০ বছর ধরে তারা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেছে। এখন কতার লাভ ঘরে তুলতে মরিয়া তারা। খুব শীঘ্রই কাবুলে হামলা চালাবে তারা। যদি আফগান সেনাবাহিনী কাবুল ধরে রাখতে পারে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন অব্যাহত থাকে, তবে এখানে সিরিয়ার ধরণের একটি পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। শহরগুলি পরিত্যক্ত শহরে পরিণত হবে। বাস্তুচ্যুত মানুষের দল একটি গুরুতর মানবিক সমস্যা হিসাবে উদ্ভূত হবে। সমস্যা হ'ল রাষ্ট্রসংঘের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং বড় বড় শক্তির মধ্যে ঐক্যমত নেই। প্রত্যেকেরই আলাদা আলাদা স্বার্থ রয়েছে।
পাকিস্তান যেমন সবসময় তালিবানদের সমর্থন করে। চিন, রাশিয়া বা ইরান বা তাদের জোট মার্কিন সেনার শূন্যতা ভরাট করুক এটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চায় না। এফএটিএফ, আইএমএফ-এর ঋণ এবং উন্নত অস্ত্রের কারণে পাকিস্তানের উপর কিছুটা হলেও আমেরিকার প্রভাব রয়েছে।
আরও পড়ুন - অস্ত্র হিসাবে ড্রোনের ব্যবহার, একটা সম্পূর্ণ নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি ভারত
রাশিয়ার স্বার্থগুলি কোনওভাবেই সিআরএসকে আদর্শগতভাবে প্রভাবিত হতে বাধা দেওয়া। আদর্শিক ইস্যুগুলির ভিত্তিতে অস্থিরতার বিস্তার হওয়ার ভয় পাচ্ছে তারা। তালিবানের উপর তাদের কোনও আস্থা নেই।
ইরানের আগ্রহ তার সীমানাগুলির স্থিতিশীল রাখা। অন্যান্য দিকে এই দেশ এমনিই যথেষ্ট সমস্যায় রয়েছে। সেইসঙ্গে আফগানিস্তানের হাজারা (মূলত শিয়া) জনগোষ্ঠীর সুরক্ষাও নিশ্চিত করতে চায় তারা। এই হাজদার গোষ্ঠিই পাকিস্তান-তালিবান জোটের প্রথম লক্ষ্যবস্তু হবে, তা তারা জানে। এই জন্য তারা আফগান বালুচদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করছে।
চিনের লক্ষ্য বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআরআই-এর কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। বিআরআই হল পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং ইরান হয়ে পশ্চিম চিন থেকে মধ্য প্রাচ্যে যাওয়ার একটি অবিচ্ছিন্ন নেটওয়ার্ক। আফগানিস্তানে অশান্তি মানে এই কাজে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হওয়া। আফগানিস্তানের অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য চিন সামান্য কিছু বিনিয়োগ করলেও, পরে সেগুলি উপেক্ষাই করেছে। আফগানিস্তানে চিনের সেনা মোতায়েন করার সম্ভাবনা খুবই কম। কোনও দেশে, বিশেষ করে যে দেশটি তাদের ভালভাবে জানা নেই, সেখানে গৃহযুদ্ধের মতো পরিস্থিতিতে জড়িত হতে চাইবে বনা তারা। চিন এর আগে আফগানিস্তানে মার্কিন উপস্থিতি তাদের সুবিধা বলে মনে করত। তবে এখন আফগানিস্তান থেকে মার্কিন অংশীদারিত্বকে সরাতে চাইছে তারাও। যদিও বেজিং-এর মূল স্বার্থ তালিবানরা যাতে শিনজিয়াং প্রদেশের উইঘুরর সমর্থন না করে, সেটা নিশ্চিত করা।
অন্যদিকে আফগানিস্তানের সঙ্গে দীর্ঘ সীমানার কারণে আপগানিস্তানে প্রভাব বিস্তারের সবথেকে বেশি সম্ভাবনা রয়েছে পাকিস্তানেরই। পশতুনরা ঐতিহ্যগতভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে হাত মেলাবা না। তার উপর ইতিমধ্যেই পাকিস্তানি তালিবানরা খাইবার পাখতুনখুনা অঞ্চলে ফের প্রবেশ করা এবং সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড চালাতে শুরু করেছে। পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে গত ২০ বছর ধরে লুকিয়ে থাকার পর, তালিবান নেতৃত্ব এখন আর পাকিস্তানি নেতাদের কথা মেনে চলতে চাইছে না। তারা ক্রমেই নিজেদের অধিকার প্রয়োগ করা শুরু করছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে পাকিস্তান ও তালিবান স্বার্থ এক নয়।
পিওকে ছাড়া আফগানিস্তানের সঙ্গে ভারতের কোনও সাধারণ সীমান্ত না থাকা সত্ত্বেও, আফগানিস্তানে ভারত অনেক বেশি সম্মান পায় এবং ভারতেরও সেখানে গভীর আগ্রহ রয়েছে। এর মধ্যে সিএআর, আন্তর্জাতিক উত্তর-দক্ষিণ ট্রানজিট করিডোর (আইএনএসটিসি) এর সংযোগ এবং ঐতিহাসিক সম্পর্কের পাশাপাশি, আফগানিস্তানে উন্নয়ন ও সামাজিক শৃঙ্খলা আনতে ভারত সেই দেশে ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে। সাধারণ স্বার্থের কারণে ভারত দিয়ে আমেরিকার সঙ্গে জোট বেঁধেছিল। কিন্তু আমেরিকা একতরফাভাবে ভারতীয় স্বার্থ প্রত্যাহার করেছে।
ভারত একদিকে যেমন আফগান সরকারকে সমর্থন করে চলেছে, তার পাশাপাশি তালিবানদের সঙ্গেও আলোচনা শুরু করেছে। ভারতকে আফগানিস্তানের পরিবর্তনের গতিাকে ধরতে হবে। সাবধানতার সঙ্গে বাছতে হবে অংশীদারদের। পরিস্থিতিটির উপর নির্ভর করে যতটা সম্ভব চুপচাপ আফগান সরকার এবং সেনাবাহিনীকে সমর্থন দেওয়া উচিত। ভারককে এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করতে বিশাল অভিজ্ঞ কূটনৈতিক সম্পদগুলির মধ্যে থেকে বিশেষ দূত কাজেলাগাতে হবে। চেষ্টা করতে হবে উহ্ভূত পরিস্থিতির থেকে যেন ভারতএগিয়ে থাকেয চেয়ে এগিয়ে থাকে।
লেখক - সৈয়দ আতা হাসনাইন (অবসরপ্রাপ্ত) লেফট্যানেন্ট জেলারেল, শ্রীনগর কর্পস-এর প্রাক্তন কমান্ডার, কাশ্মীরের কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর