সংক্ষিপ্ত
মাছ বিক্রেতা যখন তাঁর মাছ কাটেন তখন তাঁরও কিন্তু মনোযোগ নিখুঁত মাছ কাটায়। আমার কাছে তাই প্রতিমার চক্ষুদান আর মাছ কাটায় কোনও পার্থক্য নেই।
তিনি মা তাঁর একজনই, জন্মদাত্রী। দেবী দুর্গা আসলে তাঁরই শিল্পী সত্ত্বা! প্রতি বছর প্রতিমার মধ্যে দিয়ে তাই নবজন্ম হয় তাঁর। এশিয়ানেট নিউজ বাংলার প্রতিনিধি উপালি মুখোপাধ্যায়কে একান্ত সাক্ষাৎকারে জানালেন শিল্পী সুশান্ত পাল।
উপালি মুখোপাধ্যায়, প্রতিনিধি, এশিয়ানেট নিউজ বাংলা- বাঙালির কাছে মহালয়া মানে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, দেবীপক্ষের সূচনা। প্রতিমা শিল্পীদের কাছে কি?
সুশান্ত পাল, শিল্পী- আমরা যাঁরা শিল্পচর্চা করে দুর্গাপুজোর সঙ্গে যুক্ত হয়েছি তাঁদের কাছে দুর্গাপুজোয় ধর্মীয় মাহাত্ম্য কম। অনেক বেশি শিল্পচর্চার ক্ষেত্র। ফলে, পিতৃতর্পণ, স্ত্রোত্রপাঠ, পিতৃপক্ষের শেষ, দেবীপক্ষের সূচনা— এ সব কিছুই না। বলতে পারেন, এটা আমাদের ব্যস্তকাল। সারা ক্ষণ তাড়া, নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করতে হবে। তার পরেও, বাকি বাঙালির মতোই এ দিনের ভোরে রেডিয়োর ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’ এখনও অন্য আবেগ তৈরি করে। এ বছরেও সেটা হয়েছে।
উপালি মুখোপাধ্যায়, প্রতিনিধি, এশিয়ানেট নিউজ বাংলা- পাশাপাশি মনখারাপও হয়? তিলে তিলে গড়া প্রতিমা সর্বজনীন সংগঠনের হাতে তুলে দিতে হবে...
সুশান্ত পাল, শিল্পী- আমি মন্ডপেই একেবারে প্রতিমা গড়ি। তাই আমায় প্রতিমা পাঠাতে হয় না। এবং মনখারাপ নয়। খুব আনন্দ হয়। এত দিন আমি একা সৃষ্টিসুখের উল্লাসে ডুবেছিলাম। এ বার আমার সেই কাজ ছোট-বড় সবাই দেখবেন। আমিও তাঁদের সামনে থাকব। তাঁদের মুখ-চোখের খুশি, তৃপ্তি টানা ১৫ দিনের রাতাজাগার ক্লান্তি ভুলিয়ে দেবে। আপাতত তারই অপেক্ষা।
উপালি মুখোপাধ্যায়, প্রতিনিধি, এশিয়ানেট নিউজ বাংলা- এ বছর কোথায়, ক’টি প্রতিমা গড়লেন?
সুশান্ত পাল, শিল্পী- এ বছর পুজোর ভাবনা, ব্যবস্থাপনা মিলিয়ে তিনটি প্রতিমা গড়েছি। টালা প্রত্যয়, যোধপুর পার্ক ৯৫ পল্লি, বিবেকানন্দ পার্ক অ্যাথলেটিক, হরিদেবপুর।
উপালি মুখোপাধ্যায়, প্রতিনিধি, এশিয়ানেট নিউজ বাংলা- তিনটি পুজোয় এ বছরে আপনার থিম কী?
সুশান্ত পাল, শিল্পী- টালা প্রত্যয়-এ দেখবেন ‘ঋতি’ বা গতিময়তা। ব্রহ্মাণ্ড থেকে কুমোরের চাকা— এই গতির উদাহরণ। এবং মানুষের স্পর্শ ছাড়া এই গতিময়তা প্রাণহীন। করোনা-কালে আমাদের জীবন থমকে গিয়েছিল। তার পরে আবার নতুন জীবন শুরু হয়েছে। বলতে পারেন নতুন গতিময়তা। দু’বছরের থমকে থামা পুজোকে উৎসবে রূপান্তরিত করেছে। এ বছর আমরা দুর্গা উৎসব পালন করছি। এই পুজোয় তারই ছায়া। যোধপুর পার্ক ৯৫ পল্লি-তে ধরা দেবে ‘ত্রিকাল’। অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ নিয়ে গড়া। আমরা হয় অতীত না হয় ভবিষ্যতে বাঁচি। ঘটমান বর্তমানে বাঁচি না। ফলে, অতীত সারা ক্ষণ ভবিষ্যতে ছায়া ফেলে। নতুন কিছুই তৈরি হয় না। এই পুজো সেই দিক তুলে ধরবে। বিবেকানন্দ পার্ক অ্যাথলেটিক, হরিদেবপুর দেখাবে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ। একটি বস্তু প্রত্যেকে ভিন্ন ভাবে দেখেন। এই ভিন্নতাই আমার এই পুজোর ভাবনা।
উপালি মুখোপাধ্যায়, প্রতিনিধি, এশিয়ানেট নিউজ বাংলা- প্রতিমার চক্ষুদান বোধহয় সবচেয়ে সূক্ষ্ম কাজ? এক চুল এ দিক ও দিক হলেই মাটি...!
সুশান্ত পাল, শিল্পী- অবশ্যই। তবে এ বছরের চক্ষুদান সব বছরের থেকে আলাদা। কেন জানেন? গত ২৩ বছরে আমি রং, তুলি দিয়ে প্রতিমার চোখ এঁকেছি। ২৪তম বছরে তার জায়গায় বেশি ব্যবহার করেছি স্যান্ড পেপারের। যা সাধারণত রং ঘষে তোলার কাজে ব্যবহৃত হয়। এই বিশেষ ধরনের আঁকা ছাপের বৈশিষ্ট্য কি? জানতে গেলে সবাইকে মন্ডপে যেতে হবে। তবে বাকি দুই প্রতিমার চক্ষুদান আগেই হয়ে গিয়েছে। টালা প্রত্যয় ঐতিহ্যে বিশ্বাসী। প্রতি বছর এখানকার প্রতিমার চক্ষুদান এই বিশেষ দিনে হয়। এ বছরেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
উপালি মুখোপাধ্যায়, প্রতিনিধি, এশিয়ানেট নিউজ বাংলা- চক্ষুদানের সময় কোনও অলৌকিক ঘটনা?
সুশান্ত পাল, শিল্পী- চক্ষুদানের সময় আমার চারপাশে কী হচ্ছে কোনও হুঁশ থাকে না। এ বছর তো আরও। টালা প্রত্যয়ে প্রতিমার উচ্চতা ৪০ ফুট! মহালয়ায় চোখ আঁকব বলে পাশে অস্থায়ী ভাড়া বাঁধা হয়েছিল। তার উপরে আমি স্যান্ড পেপার দিয়ে ঘষে চোখ আঁকছি। নীচে সংবাদমাধ্যম চুপচাপ ক্যামেরায় পুরো ঘটনা লেন্সবন্দি করছে। আমি বাহ্যজ্ঞানরহিত। কিচ্ছু ছোঁয়নি আমায়। আমার কাছে এটাই ঈশ্বরের সঙ্গে সংযোগস্থাপন, অলৌকিকত্ব। নিজের সৃষ্টিতে ডুবে যাওয়া। তাই মন না বসলে এই কাজ শুরু করি না। এমনও হয়েছে, চোখ আঁকতে উঠেছি। তুলি হাতে নিয়ে বুঝতে পারছি, মনোযোগে ঘাটতি। ওখানেই পাটাতনে চাদর বিছিয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি। মহালয়ার ভোরে রেডিয়ো শুনে ঘুম ভেঙেছে। শুনতে শুনতে তুলি হাতে প্রতিমার চোখ আঁকতে শুরু করেছি। ব্যস, আর কিছু খেয়াল নেই। শেষ হতে হতে সকাল ১০টা, সাড়ে ১০টা। টানা পাঁচ, সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা এক টানা কাজ করে গিয়েছি, বুঝিইনি। আমার মতে, যে কোনও কাজই পেশাদারেরা একই ভাবে সামলান। যেমন, মাছ বিক্রেতা যখন তাঁর মাছ কাটেন তখন তাঁরও কিন্তু মনোযোগ নিখুঁত মাছ কাটায়। আমার কাছে তাই প্রতিমার চক্ষুদান আর মাছ কাটায় কোনও পার্থক্য নেই।
উপালি মুখোপাধ্যায়, প্রতিনিধি, এশিয়ানেট নিউজ বাংলা- মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটবে বলেই শিল্পীরা পুজোর আগে সংবাদমাধ্যমকে এড়িয়ে চলেন?
সুশান্ত পাল, শিল্পী- আমি অনন্ত মহালয়ার সকাল ছাড়া বাকি সময়ে সংবাদমাধ্যমকে কাছে ঘেঁষতে দিই না। সত্যিই এতে মনোযোগ নষ্ট হয়। আর যাঁরা আসেন তাঁরাও যথেষ্ট সহযোগিতা করেন। কোনও শব্দ করেন না। কথা বলেন না। চুপচাপ ভিডিয়ো করেন আমার কাজ। শেষ হয়ে গেলে তার পর আমি সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হই।
উপালি মুখোপাধ্যায়, প্রতিনিধি, এশিয়ানেট নিউজ বাংলা- বিদেশে আপনার প্রতিমা যায়?
সুশান্ত পাল, শিল্পী- না, আমি কিন্তু তথাকথিত কুমোরপাড়ার মৃৎশিল্পী নই। তাই দুর্গা প্রতিমা ছাড়া অন্য দেব-দেবীর মূর্তিও গড়ি না।
উপালি মুখোপাধ্যায়, প্রতিনিধি, এশিয়ানেট নিউজ বাংলা- বছরের বাকি সময় কী করেন?
সুশান্ত পাল, শিল্পী- বিভিন্ন পেশা ছুঁয়ে ছুঁয়ে গিয়েছি। প্রথমে টেক্সটাইল ডিজাইনে স্নাতোকত্তর করেছি। তার পর ঋতুপর্ণ ঘোষের ১৩টি ছবির পোশাক এবং অন্দরসজ্জা বিশেষজ্ঞ ছিলাম। পাশাপাশি দুর্গাপুজোও চলছিল। এখন আমি শুধুই দুর্গাপুজো নিয়ে ব্যস্ত থাকি। পুজোর থিম থেকে প্রতিমা— সবটাই আমার দায়িত্বে থাকে। দুর্গাপুজো কিন্তু এখন অনেক বদলে গিয়েছে। আর শুধুই প্রতিমা বা মন্ডপে সীমাবদ্ধ নেই। বৃহৎ শিল্প। যার জন্য এক বছর খুবই কম সময়।
উপালি মুখোপাধ্যায়, প্রতিনিধি, এশিয়ানেট নিউজ বাংলা- শিল্পের ভারে কি সাবেকিয়ানা হারিয়ে গেল?
সুশান্ত পাল, শিল্পী- থিমের পুজোই বা কেন সাবেকি নয়? শিল্পের একটি বিশেষ ধরণই কি কেবল সাবেকি? তা নয় তো! সেই টানা চোখ, হলুদ বরণ গা, ডাকের সাজ হলেই সাবেকিয়ানা। তারই অন্য ধারায় প্রতিমা তৈরি হলে সেটা আধুনিক? শাড়ি বেনারসি হোক বা কাঞ্চিপুরম— শাড়ি কিন্তু শাড়িই। ঠিক একই ভাবে প্রতিমা তৈরিতেও বৈচিত্র আসছে। এটাও সাবেকি। আগের পদ্ধতিও।
উপালি মুখোপাধ্যায়, প্রতিনিধি, এশিয়ানেট নিউজ বাংলা- আধুনিক ধাঁচে গড়া প্রতিমাকে দেখে মন থেকে মাতৃ-সম্বোধন আসে?
সুশান্ত পাল, শিল্পী- এক মাত্র জন্মদাত্রীই আমার মা। আর কেউ মা নন। বাকি রইল নিজের হাতে গড়া প্রতিমা। ও তো আমারই সৃষ্টি! আমার প্রতিনিধি। আমার সত্তা, আবেগ। যা শুরুতে এক তাল কাটামাটি ছিল। আমি যদি আমার আবেগকে ঠিকমতো প্রতিফলিত করতে পারি তা হলে বাকিরা তার মধ্যে মাতৃরূপ দর্শন করবেন। যিক যেমন এক জন সাহিত্যিকের সৃষ্ট চরিত্রে আসলে সেই লেখকের যাপনই থাকে। আমার কাজ আমার ঈশ্বর। মাটির মূর্তিকে যতই ডাকুন, তাতে প্রাণ নেই! পৃথিবীর সমস্ত অমর শিল্পই আসলে শিল্পীর সার্থক সৃষ্টি।
উপালি মুখোপাধ্যায়, প্রতিনিধি, এশিয়ানেট নিউজ বাংলা- মহালয়ায় কি দশমীর কথা ভেবে কষ্ট হয়? আপনার শিল্পের বিসর্জন...
সুশান্ত পাল, শিল্পী- ২০০৫-এ প্রথম প্রতিমা তৈরি করেছিলাম। ওই বছর দশমীতে যখন তাকে বিসর্জন দেওয়া হল আমিও হাউহাউ করে কেঁদেছিলাম। আস্তে আস্তে বুঝতে শিখেছি, একটি শিল্প শেষ না হলে নতুন সৃষ্টি হবে না। একটি প্রতিমার বিসর্জন না হলে সেই নতুন আসবে না। তাই এখন আমি দশমী উপভোগ করি। আমার শিল্পকে আমার পাশাপাশি গোটা বাংলা উপভোগ করল। তার পালা শেষ। আসছে বছর আবার হবে। ফের, নতুনের খোঁজে ঝুলি কাঁধে বেরিয়ে পড়ব।
আরও পড়ুন-
ইউরোপের 'আড্ডা'-য় দুর্গাপুজোর আজ ষষ্ঠী, দেখে নিন প্রবাসের মাটিতে খাদ্যরসিক বাঙালিদের পেটপুজোর কিছু ছবি
দুর্গাপুজোর থিমে ভোট-পরবর্তী হিংসা, প্যান্ডেলের আনাচে কানাচে উঠে এল হিংসার ছবি
পেতলের টিকিট দেখিয়ে চোরবাগানের শীল বাড়ি থেকে টাকা পেতেন গরীব-দুখীরা, জেনে নিন সেই বাড়ির দুর্গাকথা