সংক্ষিপ্ত

চিরঞ্জিতের কথায়, ‘যাঁরা বাংলা ছবির লক্ষ্মী সেই সব দর্শকেরা মাল্টিপ্লেক্সে যান না। তাঁরা সিনেমা বলতে বোঝেন, নাচাগানা, মারপিটে ভরপুর বিনোদন। ছবি দেখতে গিয়েও যদি গালে হাত দিয়ে বসে ভাবতে হয়, তা হলে আর লাভ কী?’

অতিমারির কোপ ছিলই। দক্ষিণী ঝড়ে আরও নড়বড়ে বাংলা ইন্ডাস্ট্রি। অতঃ কিম? এই প্রশ্ন তুলে শহরের এক সাত তারা হোটেলে সম্প্রতি আলোচনার আসর বসেছিল। আয়োজক ইন্ডিয়ান চেম্বার অফ কমার্স। সূত্রধর পরিচালক অরিন্দম শীল। অংশ নিয়েছিলেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, বিক্রম ঘোষ, অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী, অরিজিৎ বিশ্বাস, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের মতো তারকারা। বাংলা ছবি নিয়ে ইংরেজি ভাষায় তাঁদের কথোপকথনে তিনটি দিক উঠে আসে। এক, বাংলা ছবিকে দক্ষিণের মতোই বাণিজ্যিক ধারার ছবিতে ফিরতে হবে। দুই, সিঙ্গল স্ক্রিনের সংখ্যা বাড়াতে হবে। তিন, পরমব্রতর মতে, বাংলা ছবির বাজেটও একই সঙ্গে বাড়াতে হবে। নইলে বাকি আঞ্চলিক ভাষার ছবির সঙ্গে পাল্লা দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ, তাদের ছবি তৈরির বাজেট ইতিমধ্যেই অনেক গুণ বেড়েছে। আলোচনার শুরুতে প্রসেনজিতের সহজ অঙ্ক-- ‘রাজ্যে বাঙালির সংখ্যা ৩০ কোটির বেশি। তার মধ্যে ১০ কোটি যদি প্রেক্ষাগৃহে আসেন তা হলেই ‘হাউজফুল’ বোর্ড ঝুলবে।’ এ প্রসঙ্গে তাঁর অকপট স্বীকারোক্তি, ‘আমরা যে শুধু প্রেক্ষাগৃহে লোক টানতে পারছি না তা নয়। আমরা বাংলার প্রতিভাদেরও ধরে রাখতে পারছি না।’ এই সুর পরমব্রতর কথাতেও। প্রযোজক-পরিচালক-অভিনেতা বাংলা ছবির পাশাপাশি হিন্দিতে জাতীয় স্তরেও যথেষ্ট জনপ্রিয়। তাঁর উপলব্ধি, ‘পুরনো প্রবাদ ‘গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না’ এখনও প্রাসঙ্গিক। আমরা যখন বলিউড বা হলিউডের তকমা নিয়ে ফিরি, তখন কত আদর-কদর! ওই একই ব্যক্তি শুধু বাংলায় থাকলে তাঁকে কে পাত্তা দেয়?’

আলোচনায় প্রসেনজিৎ আরও বলেছিলেন, এক দিন আলোচনায় বসে লাভ নেই। এই ধরনের আলোচনা আরও চাই। তবে যদি বাংলা ছবির হারানো গৌরব ফেরানো যায়। একই সঙ্গে এই প্রশ্নেরও জন্ম দিয়েছিল, বাংলা ছবির ভবিষ্যৎ তা হলে কী? অনুষ্ঠানের পরে এই প্রশ্ন এশিয়ানেট নিউজ বাংলা পৌঁছে দিয়েছিল বিধায়ক-পরিচালক-অভিনেতা চিরঞ্জিৎ চক্রবর্তীর কাছে। জবাবের শুরুতেই তাঁর পাল্টা বিনীত প্রশ্ন, ‘সবাই যখন বুঝতে পারছেন, বাণিজ্যিক ধারার ছবিই এক মাত্র হাল ধরতে পারে, তা হলে আলোচনা সভায় সেই ধারার পরিচালক, প্রযোজক, অভিনেতাদের উপস্থিত থাকার কথা। তাঁরা কই? বাংলা ছবির উন্নতি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। অথচ সেখানে হরনাথ, জিৎ, অনুপ সেনগুপ্ত নেই?’ তার পরেই নিজেকে সংশোধন করে নিয়ে বলেন, ‘জিৎ অবশ্য ইংরেজিতে অনায়াস।’ তাঁর কটাক্ষ, বাংলা ছবি নিয়ে বক্তব্যে যেখানে বাংলা ভাষারই জায়গা নেই সেখানে বাণিজ্যিক ধারার প্রযোজক-পরিচালকেরা কি আমন্ত্রণ পাবেন? সেখানে ভাষাটাও বড় বাধা। এবং তাঁরা তো অপাংক্তেয়। চিরঞ্জিতের দাবি, এক মাত্র প্রসেনজিৎ ওই আলোচনায় যোগ্য ব্যক্তিত্ব। কারণ, তাঁর যাত্রা বাণিজ্যিক ছবি দিয়েই।

 

 

চিরঞ্জিৎ একে একে আলোচনায় উঠে আসা সব দিক ছুঁয়ে যান। প্রসেনজিতের উদ্দেশে তাঁর বক্তব্য, ‘বুম্বা, ১০ কোটি লাগবে না। আমার ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’য় ২ কোটি দর্শক এসেছিলেন। আমরা তাতেই কুলিয়ে উঠতে পারিনি। ভাঁড়ার উপচে পড়েছিল। তুই পারলে ওই ২ কোটি দর্শক জোগাড় কর, যথেষ্ট।’ এ বার প্রশ্ন, এই ২কোটি দর্শক আনবে কে? আজকের দিনে কোন ছবি এত দর্শককে হলমুখো করতে পারবে? এ ক্ষেত্রে অংশগ্রহণকারীদের বক্তব্যই চিরঞ্জিতের বক্তব্য। তাঁর কথায়, ‘যাঁরা বাংলা ছবির লক্ষ্মী সেই সব দর্শকেরা মাল্টিপ্লেক্সে যান না। ওঁরা শপিং মল থেকে জিনিস কেনেন না। পাস্তাও খান না। তাঁরা সিনেমা বলতে বোঝেন, নাচাগানা, মারপিটে ভরপুর বিনোদন। ছবি দেখতে গিয়েও যদি গালে হাত দিয়ে বসে ভাবতে হয়, তা হলে আর ছবি দেখে লাভ কী? যুক্তি দিয়েছেন, তামিল, তেলুগু এমনকী কন্নড় ভাষার বিনোদন দুনিয়াও সেটা বুঝেছে। বুঝেছে বলেই বাইরের খোলনলচে বদলেছে। ভিতরটা একই রকম রেখে দিয়েছে। ‘ওরা পুরনো মদ নতুন বোতলে পরিবেশন করছে। দর্শক কত খুশি, দেখেছেন?’ প্রশ্ন তাঁর।

পাশাপাশি, প্রসেনজিতের সঙ্গে একটি বিষয়ে এক মত। এই যুক্তি থেকেই বিধায়ক-পরিচালকের দাবি, বাংলা ছবির ভবিষ্যতও বাণিজ্যিক ধারার ছবিতেই আটকে। বিষয়টি সবাইকে বোঝাতে এক বার নয়, একাধিক বৈঠক ডাকতে হবে। এবং সেই আলোচনায় সেই ধারার বিশেষজ্ঞদের চাই। উত্তমকুমার পরবর্তী যুগে যাঁরা বাংলা ছবিকে অক্সিজেন জুগিয়েছিলেন। অঞ্জন চৌধুরী পদ দেখিয়েছিলেন। তিনি নেই। হরনাথ, অনুপ, সুজিত গুহরা চেষ্টা করলে বাংলা ছবির খরা কাটবে। তাই আলোচনায় তাঁদের থাকা আবশ্যিক। অন্য ধারার ছবি করিয়েরা বাণিজ্যিক ধারার ছবির কী বোঝেন? একই সঙ্গে চিরঞ্জিৎ সওয়াল করেছেন প্রযোজক-অভিনেতা জিতের হয়ে। তাঁর প্রশ্ন, জিতকে কেন ডাকা হল না? জিৎ একমাত্র অভিনেতা, যিনি নিজের ঘরানা ধরে রেখেছেন। বাণিজ্যিক ধারার ছবি ছাড়া অভিনয় করেন না। এ প্রসঙ্গে উঠে এসেছে দেবের নামও। চিরঞ্জিতের কথায়, দেবও একটা সময় এই ঘরানারই ছবি করতেন। ইদানীং তিনিও ঘরানা বদলে ফেলেছেন।

আগের দিনের আলোচনায় সিঙ্গল প্লেক্সের সংখ্যা বাড়ানোর কথাও তুলেছিলেন অরিন্দম। চিরঞ্জিৎ সে প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, ব্যবসা বাড়লে তবে না প্রেক্ষাগৃহ সংখ্যা বাড়বে! নইলে শুধু শুধু সিঙ্গিল পর্দা খুলে লাভ কী? তাঁর আরও মত, একটি প্রশ্ন তুললেই সবাই সমস্ত উত্তর পেয়ে যাবেন। সাড়ে ৮০০ প্রেক্ষাগৃহ থেকে ২০২২-এ প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা ১০০-য় এসে ঠেকেছে কেন? এর উত্তর খুঁজলেই ছবির বাজেট, বাণিজ্যিক ধারার ছবি থেকে শুরু করে সব সমস্যার সমাধান মিলবে। অভিনেতার কথায়, ‘আরও একটা ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’ বা ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ’ প্রযোজকের ঘরে পয়সা আনবে। সেই অর্থে বানানো হবে ‘দোস্তজী’র মতো ছবি। শুধুই বাণিজ্যিক দিক থেকে নয়, আন্তর্জাতিক মানেও আমরা পিছিয়ে।’