সংক্ষিপ্ত

কাননদেবী- ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রথম সুপারস্টার। কিন্তু তাঁকে নিয়ে সে ভাবে কোনও কাজই হয়নি আজ পর্যন্ত। কাননের আঁতুরঘর কলকাতাও ভুলতে বসেছে তাঁকে।

 

কাননদেবী। নিষিদ্ধপল্লির সীমানা ভেঙে ভারতীয় চলচ্চিত্রের সুপারস্টার হওয়ার এক নারী। যিনি তাৎপর্যপূর্ণভাবে ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রথম সুপারস্টার। অভিনয়-গান-নাচ-সবেতেই আসমুদ্র হিমাচলকে বিস্মিত করে দিয়েছিলেন কানন। ঠোক্কর খেয়েছেন জীবনের দ্বারে। কিন্তু ভেঙে পড়েননি। উঠে দাঁড়িয়েছেন, লড়াই করেছেন, নারী সত্তার বিকাশে নিজেকে প্রতিনিধি করেছেন। বলতে গেলে চলচ্চিত্রের আঙিনায় নারীদের সম্মানও যে জরুরি সেটা জোর করে যিনি প্রথম পুরুষ সমাজের বুকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তাঁর নাম কাননদেবী। এহেন কাননকে এবার মঞ্চে তুলে আনলেন লাকি মুখোপাধ্যায়। ৮৫ বছর বয়সে এক টুকরো মঞ্চেই অপেশাদার ৪৯ জন অভিনেতা-অভিনেত্রীকে দিয়ে গড়ে তুললেন ১৯৩০ সাল থেকে ১৯৯২ সালের এক প্রেক্ষাপট। ব্যাক স্টেজ থেকে সরাসরি সঙ্গে সঙ্গত দিলেন আরও ১২ জন। এমনকি, কাননের গানের গলাকে হুবহু লাইভে ফুটিয়ে তুলে তাক লাগিয়ে দিলেন লাকি। 

বরাবরই মুম্বই এবং কলকাতা শহরের বসবাসকারী বাঙালি-সহ তামাম প্রবাসী বাঙালি মহলেও নাট্য়চর্চায় এক জনপ্রিয় নাম লাকি মুখোপাধ্যায়। তাঁর তৈরি করা আনন্দম নাট্য সংস্থা গত ৪৩ বছর ধরে অসামান্য সব প্রযোজনা তৈরি করেছে। আর এই সব প্রযোজনাতে যারা অভিনেতা-অভিনেত্রী হিসাবে কাজ করেছেন তাঁদের বেশিরভাগ জনই অপেশাদার। মানে অভিনয় করাটা এদের কারও পেশা নয়। এরা সকলেই নিজস্ব নিজস্ব কাজের গণ্ডীর বাইরে বেরিয়ে এক সাংস্কৃতিক চক্রে অংশ নেন। এমনই সব অভিনেতা-অভিনেত্রীদের দিয়েও যে কাননদেবী মতো বিষয়কে মঞ্চস্থ করতে পিছ-পা হননি লাকি। ২ বছরের অতিমারি কেড়ে নিয়েছে অনেকটা সময়। কিন্তু তারমধ্যেই অনলাইনে করে গিয়েছেন রিহার্সাল। ভাবনার জাল বুনেছেন নতুন প্রযোজনায়। আর তারই ফসল কাননবালা থেকে কাননদেবী-র মতো এক মিউজিক্যাল ড্রামা। যা হয়তো এই সময়ে দাঁড়িয়ে কলকাতার অন্যান্য নাট্যগোষ্ঠীও করার সাহস দেখাননি। মিউজিক্যাল ড্রামা কলকাতার নাট্য়গোষ্ঠীগুলো করেছে, কিন্তু কাননদেবীকে নিয়েও যে এমন এক মিউজিক্যাল থিয়েটার হতে পারে, সেই ভাবনায় জিয়ন কাঠির স্পর্শটা হয়তো লাকি-ই সূচনা করলেন। 

ক্যানসার আক্রান্তদের চিকিৎসায় সাহায্য করতে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে কাজ করে চলেছে আনন্দম। তাদের শো-থেকে যাবতীয় আয়-এর বেশিরভাগটাই ক্যানসার আক্রান্তদের চিকিৎসায় দান করা হয়। সেই সঙ্গে আরও বিভিন্ন সমাজসেবামূলক প্রকল্পে কাজ করা সরকার অনুমোদিত সংস্থাকেও তারা সাহায্য করে থাকেন। কাননবালা থেকে কাননদেবী- নাটকের আয়ও এমনই সমাজসেবা মূলক কাজে লাগানো হবে জানিয়েছেন, আনন্দম-এর প্রতিষ্ঠাতা লাকি মুখোপাধ্যায়। যার জন্য ৬ নভেম্বর মধুসূদন মঞ্চে নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার আগে দুর্বার মহিলা সমন্বয় সমিতির হাতেও লক্ষাধিক টাকার চেক তুলে দেওয়া হয় আনন্দমের পক্ষ থেকে। দুর্বারের ৪ টি করে ছেলে-মেয়ে-র পড়াশোনার ভার নিয়েছে আনন্দম। তারই অঙ্গ হিসাবে এই অর্থ তুলে দেওয়া হয় এদিন। 

কাননবালা থেকে কাননদেবীর কাহিনি শুরু হয় যখন পালিত বাবাকে হারিয়ে মা রজবালা দাসের হাত ধরে ৯ বছরের কানন হাজির হয় এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়-র বাড়িতে আশ্রয়ের খোঁজে। সেইখানে প্রায় পরিচারিকার মর্যাদায় দিন কাটছিল কাননের মা রজবালার এবং কাননকে রোজ বাড়ির সমস্ত বাথরুম ও শৌচাগার পরিস্কার করতে হত। মাত্র ৯ বছর বয়সেই মেয়ে মেথরের তকমা পেয়ে গিয়েছিল কাননবালা। আত্মীয়-র বাড়ির অসহনীয় অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে ফের মেয়েকে নিয়ে হাওড়ার নিষিদ্ধপল্লিতে ফিরে এসেছিলেন রজবালা। এক সহৃদয় প্রতিবেশী মহিলার সাহায্যে রজবালা একটু একটু করে জীবনের প্রতি আস্থা ফিরে পেতে থাকেন। এমন-ই এক সময় কাননেকে নির্বাক ছবি জয়দেব-এ শিশুশিল্পীর ভূমিকায় অভিনয় করানোর সুযোগ তৈরি করেন তুলসীবাবু। এরপর থেকে আস্তে আস্তে কলকাতার বায়োস্কোপের আঙিনায় পরিচিত হতে থাকে কাননবালা। তাঁর গানের গলা মুগ্ধ করে সকলকে। তখনকার সময়ে অভিনেতা-অভেনত্রীদেরই গান গাইতে হত। নির্বাক ছবিতে থেকে সবাক ছবিতে পা রাখতেই কাননবালাকে নিয়ে হইচই পড়ে যায়। কানন যে ক্রমশ বড় স্টার হতে চলেছে তা নিয়ে চর্চা শুরু হয়ে যায় কলকাতায়।

কাননদেবীর এই বায়ো-পিকে মোট ৫ জনকে তাঁর নাম-ভূমিকায় অভিনয় করিয়েছেন লাকি। বয়সের ভার অনুযায়ী এক-এক জনকে কাননদেবীর ভূমিকায় নির্বাচিত করা হয়েছে। কাননদেবীর নাম-ভূমিকায় প্রত্যেকেই তাঁদের বলিষ্ঠ অভিনয়ে এক স্বতন্ত্র উপস্থিতি তৈরি করেছেন। এর সঙ্গে অব্যই নজর কেড়েছে প্রমথেশ বড়ুয়ার চরিত্র। কাননদেবী ছাড়াও এই নাটকে সবচেয়ে বেশি সময় মঞ্চ উপস্থিতি ছিল প্রমথেশ বড়ুয়ার চরিত্রটির। এছাড়াও কাননদেবীর মা রজবালা থেকে তুলসীবাবু, কুনন্দনলাল সায়গল, পঙ্কজ মল্লিক, জ্যোতিষ বন্দোপাধ্যায়দের চরিত্রগুলো-সহ আরও বাকি চরিত্র তাঁদের অভিনয়গুণে কাননবালা থেকে কাননদেবীকে এক বলিষ্ঠতা দান করেছে। যা দর্শকদের মনে গভীরভাবে ছাপ ফেলেছে। আর অবশ্যই সূত্রধার হিসাবে এক আলো-আঁধারি কক্ষে বসে থাকা ঘোষকের উপস্থিতি-সময়ের এই বিশাল মুহূর্তকে একে অপরের সঙ্গে জুড়ে দিতে সাহায্য করেছে।  


অভিনয়গুণ যদি হয় কাননবালা থেকে কাননদেবীর মূল আধার, তাহলে এই মিউজিক্যাল থিয়েটারের সবচেয়ে বড় বিস্ময় কাননদেবীর কন্ঠের হুবহু নকল করে তাঁর গানকে উপস্থাপিত করা। এই গান আগে থেকে রেকর্ডিরও করা হয়নি, এক্কেবারে লাইভে বসিয়ে এই গান গাইয়েছেন লাকি। যা সারা হলের দর্শককে চমকিত করেছে। অপেশাদার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের দিয়েও যে এমন এক নিখুঁত প্রযোজনা নামানো যায়, তা ফের একবার প্রমাণ করে ছেড়েছেন লাকি। এই অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মধ্যে কেউ পাইলট, কেউ আর্কিটেক্ট, কেউ চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ড, কেউ সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার, কেউ আবার ভাবা অ্যাটোমিক রিসার্চের বিজ্ঞানী, কেউ নাজাদা কর্পোরেটের উচ্চপদস্থ কর্তা, কেউ আবার অধ্যাপক বা ছাত্রী, স্কুল পড়ুয়া, গৃহবধূ অথবা মন্তেসরি স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল। ৮৫ বছরের এক বৃদ্ধের এই বয়সেও বাঙালি নাচ্যচর্চা ও সংস্কৃতিকে ভারতবর্ষের বুকে তুলে ধরার প্রয়াসে এখনও এক নতুনত্বের খোঁজ- তা দর্শকমনকে ভরিয়ে দিয়েছে বলেও অনেকে মন্তব্য করেছেন।  

আরও পড়ুন- 
দিদিমাকে হারালেন রানি মুখার্জি, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় প্রয়াত হলেন বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী আরতি রায়