সংক্ষিপ্ত
নানক ছিলেন একেশ্বরবাদী। আর 'ঈশ্বর নিরাকার' এই ধারণায় বিশ্বাসী হওয়ার কারণে অবতারবাদ এবং ঈশ্বরের পুনর্জন্মকে অস্বীকার করতেন। মূর্তিপুজো মানতেন না। নানকের ব্যক্তিত্ব এবং সাহস সবাইকে মুগ্ধ করেছিল। নানক ছিলেন বিনয়ী। নানকের বিভিন্ন গুণ এবং বিভিন্ন ধর্মের সমন্বয়সাধন পক্রিয়া খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তাকে জনপ্রিয় করে তুলেছিল। এই সবকিছুর সাথে তিনি ছিলেন একজন অনুভূতিশীল কবিও। প্রচলিত প্রথার ঊর্ধ্বে গিয়ে তাই তিনি খুঁজতে চেয়েছিলেন এক পরম সত্যকে, যা তাঁকে আজও অমর করে রেখেছে। - লিখছেন অনিরুদ্ধ সরকার
"বাবা নানক শাহ ফকির
হিন্দু কা গুরু, মুসলমান কা পীর।"
এই কবিতা আজও নানক ভক্তদের মুখে মুখে ফেরে। অমৃতসরের স্বর্ণ মন্দির গেলে আজও নানকের জন্য শ্রদ্ধায় মাতা নত হয়ে যায়। গুরু নানক আজীবন লড়াই করেছিলেন হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের জন্য। নানক তাঁর মৃত্যুশয্যায়ও দিয়ে গেছিলেন সম্প্রীতির শিক্ষা। কি ছিল সেই গল্প। আসুন জেনে নিই। নানকের মৃত্যুশয্যায় মুসলমান ভক্তরা নানকের কাছে দাবি নিয়ে এল, "আমরা গুরুকে কবর দেব"। অন্যদিকে হিন্দুরা বলল, "আমরা দাহ করব"। নানক দেখলেন বেশ মুশকিল। কেউই কোনো কথা শুনতে রাজি নয়। দু'পক্ষই বেশ উত্তেজিত। তখন নানক এই সমস্যার সমাধান করতে এগিয়ে এলেন। নানক বললেন, “তোমরা আমার দুই পাশে ফুল দিও। হিন্দুরা দিও ডানদিকে আর মুসলমানরা দিও বামদিকে। যাদের ফুল কাল তাজা থাকবে; তাদের ইচ্ছাই পূরণ হবে।” নানক উভয় পক্ষকেই প্রার্থনা করতে বললেন। দু'পক্ষই নানকের কথায় রাজি হল এবং গুরুর নির্দেশমত প্রার্থনা শুরু করল। প্রার্থনা শেষ হলে 'গুরু' নিজের ওপর চাদর টেনে নিলেন ও চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন। দেহ রাখলেন গুরু নানক। নানকের দেহ রাখার পরদিন সবাই খুব আগ্রহ সহকারে চাদর তুলতে এল কাদের ফুল তাজা আছে তা দেখার জন্য। কিন্তু চাদর তুলে দু'পক্ষই বেশ অবাক। তারা কেউই চাদর তুলে কিছুই পেল না। উভয়পক্ষই চাদর তুলে দেখল দুই সম্প্রদায়ের ফুলগুলোই সতেজ রয়েছে।
নানকের জন্ম পঞ্জাব প্রদেশে। পিতা ছিলেন গ্রামের কোষাধ্যক্ষ। নাম মেহতা কালিয়া। মার নাম তৃপ্তি।সাত বছর বয়সে বর্ণমালা ও সংখ্যা শেখানোর জন্য পাঠানো হয় পণ্ডিতের কাছে। পরের দুই বছর মুসলিম আলেমের কাছে থেকে রপ্ত করেন আরবি এবং ফারসি। বারো বছর বয়সে মুলচাঁদের মেয়ে সুলক্ষ্মীর সাথে বিয়ে হয় নানকের। কোষাধ্যক্ষ পিতা চাইছিলেন ছেলেকে জাগতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে। দেখতে দেখতে নানক ও সুলক্ষ্মীর দুই সন্তান হয়,
শ্রী চাঁদ এবং লক্ষ্মী দাস। এরপর হঠাৎ করে নানক সংসারের মায়া কাটিয়ে আধ্যাত্মিকতায় মনোনিবেশ করেন। এই সময় একদিন নদীতে স্নান করতে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে যান নানক। তিনদিন তিনরাত নিখোঁজ ছিলেন নানক।পরিবারের সবাই ধরেই নিয়েছিলেন, যে নানক জলে ডুবে মারা গেছেন। কিন্তু চতুর্থ দিন ঠিক ফিরে এলেন এক অন্য নানক। বাড়িতে গিয়েই সবকিছু দান করে বেরিয়ে পড়েন এক দীর্ঘ ভ্রমণে। মথুরা, বেনারস, গোয়া, বাংলা, অসমের বিস্তৃর্ণ এলাকা ভ্রমণ করে নানক দক্ষিণে পাড়ি দেন। তামিলনাড়ু শ্রীলঙ্কা ঘুরে পশ্চিমে মালাবার হয়ে বোম্বে ও রাজস্থান ভ্রমণ করেন। তারপর নানক পাড়ি দেন উত্তরে হিমালয়ের দুর্গম অঞ্চল। নানকের শেষ দীর্ঘ ভ্রমণ ছিল মক্কা, মদিনা এবং বাগদাদের বিভিন্ন এলাকা।
নানক তখন হিমালয় ভ্রমণ করছেন। হরিদ্বারে থাকাকালীন সময়ে নানক গঙ্গা স্নান করতেন নিয়মিত৷ তা একদিন গঙ্গা স্নানে গিয়ে নানক দেখলেন উদীয়মান সূর্যের দিকে তাকিয়ে কিছু গঙ্গাজল উৎসর্গ করছেন। নানক এগিয়ে গিয়ে তার কারণ জানতে চাইলেন। উত্তরে তারা বলল, " আমরা পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে এই জল নিবেদন করছি।এতে তাঁদের আত্মা শান্তিলাভ করবে।"
একথা শোনার পর নানক গঙ্গায় নেমে বেশ জোর করে জল ছুঁড়তে লাগলেন। উপস্থিত তীর্থযাত্রীরা তো বেশ অবাক৷ তারা সবাই এগিয়ে এসে নানকের কাছে এহেন আচরণের কারণ জানতে চাইলে নানক বললেন, “আমার দেশের খামার এবছর একেবারে শুকনো তাই সেখানে এই জল পাঠাচ্ছি"।
সবাই হাসাহাসি করতে লাগল নানকের কথা শুনে। তারপর একদল তীর্থযাত্রী এগিয়ে এসে নানককে বললেন, "মহাশয়, আপনি এখান থেকে জল ছুঁড়লে কখনও তা খামারে পৌঁছায়! এ আপনি কি করছেন। আপনার জল এভাবে খামারে পৌঁছাবে না।" একথা বারে বারে তারা নানককে বোঝাতে লাগলো। নানক মৃদু হাসলেন আর হাসিমুখে জবাব দিলেন, “আমার খামার তো তোমাদের মৃত পূর্বপুরুষের চেয়ে কাছে। অত দূরে জল গেলে ওখানে যাবে না কেন?” এই ধরনের কথা শুনে উপস্থিত তীর্থযাত্রীরা স্তব্ধ হয়ে যায়। কথাটা দারুণভাবে প্রভাবিত করে তাঁদের। তাঁরা নানকের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে।
তেমনই আরেকটি গল্প। নানক মক্কা যাচ্ছিলেন। পথমধ্যে এক মসজিদে ঘুমিয়ে গেলেন নানক। নানকের পা কা’বার দিকে। হঠাৎ একজন মুসলিম ভদ্রলোক এসে নানককে ঝাঁকালেন এবং রাগী স্বরে বললেন, “এ তুমি কী করেছো। তুমি না খোদার বান্দা। আর খোদার অনুগামী হয়ে কিনা তুমি নিজের পা খোদার ঘরের দিকে রেখেছো। এমন হীন কাজ তুমি কীভাবে করলে?” নানক তাঁকে জবাবে বললেন, "তাহলে আমার পা টা সেদিকেই ঘুরিয়ে দিন, যেদিকে খোদা নেই"।
লোকটির মুখে আর কথা নেই।
নানক ছিলেন একেশ্বরবাদী। আর 'ঈশ্বর নিরাকার' এই ধারণায় বিশ্বাসী হওয়ার কারণে অবতারবাদ এবং ঈশ্বরের পুনর্জন্মকে অস্বীকার করতেন। মূর্তিপুজো মানতেন না। নানক হিন্দু-মুসলমান বিভেদ করেননি। নানকের ধর্মীয় উদারনৈতিক সাম্যনীতি নিম্নবর্গীয় হিন্দু এবং প্রত্যন্ত এলাকার গরীব মুসলমান কৃষকদের যথেষ্ট আকৃষ্ট করে। নানকের ব্যক্তিত্ব এবং সাহস সবাইকে মুগ্ধ করত। নানক ছিলেন বিনয়ী। নানকের বিভিন্ন গুণ এবং বিভিন্ন ধর্মের সমন্বয়সাধন পক্রিয়া খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তাকে জনপ্রিয় করে তোলে। এই সবের সাথে তিনি ছিলেন একজন অনুভূতিশীল কবিও। প্রচলিত প্রথার ঊর্ধ্বে গিয়ে তাই তিনি খুঁজতে চেয়েছিলেন এক পরম সত্যকে, যা তাঁকে আজও অমর করে রেখেছে।
আরও পড়ুন- অশোক ও কিশোর কুমারের প্রপিতামহ ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্রের সহপাঠী
আরও পড়ুন- LPG গ্রাহকদের জন্য সুখবর,৬৩৪ টাকায় ঘরে বসে পেয়ে যাবেন সিলিন্ডার,আসছে Composite Cylinder
আরও পড়ুন- রেলযাত্রীদের জন্য সুখবর,ফের চালু হচ্ছে প্যান্ট্রি কার পরিষেবা
"