সংক্ষিপ্ত
আলিপুর বোমামামলা বদলে দিয়েছিল বিপ্লবী অরবিন্দের জীবন।অরবিন্দের হয়ে মামলা লড়েছিলেন উদীয়মান ব্যারিস্টার চিত্তরঞ্জন দাশ। চিত্তরঞ্জন অরবিন্দকে পণ্ডিচেরী থেকে ফিরিয়ে আনতে গেলে অরবিন্দ মৃদু হেসে চিত্তরঞ্জনকে বলেছিলেন, "আমি আর বিপ্লবী অরবিন্দ নই, আমি এখন যোগী অরবিন্দ।আমার পক্ষে ফেরা সম্ভব নয়।" শ্রীঅরবিন্দের মহাপ্রয়াণে তাঁর অজানা কথায় অনিরুদ্ধ সরকার।।
বিপ্লবী অরবিন্দ (Sir Arabinda) ঘোষ তখন পণ্ডিচেরীতে, তাঁর নতুন পরিচয় তখন "যোগী অরবিন্দ"। কারো কারো কাছে তিনি "ঋষি অরবিন্দ" (Rishi Arabinda)। প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে তিনি তখন শত যোজন দূরে চলে এসেছেন। একদিন পণ্ডিচেরী হাজির হলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন। বহুবছর পর দুজনার দেখা৷ দুজনেরই স্মৃতিতে ভেসে উঠল আলিপুর বোমা মামলার কথা। আলিপুর বোমামামলা বদলে দিয়েছিল বিপ্লবী অরবিন্দের জীবন। বাংলায় তখন দিকে দিকে গড়ে উঠছে বিপ্লবী গুপ্ত সমিতি। অরবিন্দ ও অরবিন্দের ছোটো ভাই বারীন তখন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী। বারীনের গুপ্ত সমিতির সিদ্ধান্তে বিপ্লবী ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকী অত্যাচারি কিংসফোর্ডকে হত্যার জায়গায় ভুল করে নিরীহ দুই ইউরোপীয় মহিলাকে হত্যা করে ফেলে। প্রফুল্ল চাকী আত্মহত্যা করে। ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয়। শুরু হয় ব্যাপক খানা তল্লাসি।বারীনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এই ঘটনারই সূত্র ধরে পুলিশ পৌঁছে যায় অরবিন্দের কাছে।ভোররাত্রে কলকাতার গ্রে স্ট্রিটে 'নবশক্তি' পত্রিকার অফিসের ওপরতলার ঘর থেকে পুলিশ অরবিন্দকে গ্রপ্তার করে।ঘর খানাতালাশি করার সময় পুলিশ কাগজে মোড়া খানিকটা মাটি উদ্ধার করে,তারা ঐ মাটিকে বোমা বানানোর উপাদান মনে করে।আসলে ওই মাটি ছিল দক্ষিণেশ্বর থেকে আনা শ্রী রামকৃষ্ণের (Sree Ramkrishna) পদ ধূলি মেশানো মাটি।
প্রায় ১৩১ দিন ধরে চলে আলিপুর বোমা মামলা।৪০০০ দলিল,৩৫০ দস্তাবেজ,২০০ সাক্ষী। অরবিন্দের (Rishi Arabinda) হয়ে মামলা লড়তে এসেছিলেন উদীয়মান ব্যারিস্টার চিত্তরঞ্জন দাশ (Chittaranjan Das)। সেই প্রথম দুজনের আলাপ। বিচারপতি বিচ ক্রাফট অরবিন্দকে দেখে স্তম্ভিত হয়ে যান।কারণ তিনি ছিলেন কেমব্রিজে অরবিন্দের সহপাঠী। অরবিন্দ (Rishi Arabinda) সেখানে ছিলেন প্রথম স্থানাধিকারি ছাত্র, যে কারনে একে অপরকে ভালভাবেই চিনতেন।ক্লাসে ক্রাফটের স্থান থাকত বরাবরই নিচে। বিচক্রাফট অরবিন্দকে আসামীর খাঁচা থেকে বেরিয়ে অন্য আসনে বসতে বললে অরবিন্দ তা অস্বীকার করেন।
অলিপুর বোমা মামলার আসামী হিসেবে অরবিন্দকে (Rishi Arabinda) জেলে কাটাতে হয় প্রায় একবছর।আর জেলে থাকাকালীনই তার মধ্যে এক দিব্য চেতনার সঞ্চার হয়।তাঁর কথায় তিনি 'কৃষ্ণকে দর্শন করেছেন। যে উপলব্দধির কথা তিনি উল্লেখ করেন-'কারা কাহিনী ' বই এ। শ্রীঅরবিন্দের (Sree Arabinda) চমক ভাঙল। তিনি চিত্তরঞ্জের আগমনের কারণ জানতে চাইলেন। চিত্তরঞ্জন অরবিন্দকে বললেন - "আপনি ফিরে চলুন। রাজনীতিতে আপনার প্রয়োজন আছে। ভারতের জন্য স্বাধীনতা সংগ্রামের যে বীজ আপনি রোপণ করেছিলেন তা আজ মহীরুহ। আপনি ফিরে চলুন।" অরবিন্দ মৃদু হেসে চিত্তরঞ্জনকে বললেন, "আমি আর বিপ্লবী অরবিন্দ নই, আমি এখন যোগী অরবিন্দ।আমার পক্ষে ফেরা সম্ভব নয়।"
চিত্তরঞ্জন (Chittaranjan Das) তখন বললেন, " তা বেশ। আপনি যখন রাজনীতিতে ফিরবেন না তখন রাজনৈতিক দীক্ষা আর দিতে হবে না আমায়। আপনি বরং আমায় যোগ দীক্ষা দিন।" একথা শুনে অরবিন্দ (Rishi Arabinda) চিত্তরঞ্জনকে বললেন-" আপনি বাংলার বিপ্লবী আন্দোলের একজন প্রবীন এবং শেষ প্রতিনিধি। আপনি রাজনীতি ছাড়বেন না। আপনি অনেকের অনুপ্রেরণা। আর রাজনীতির সংসর্গ ত্যাগ না করলে আপনার পক্ষে যোগের পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া আপনার স্বাস্থ্যও ভেঙে পড়েছে।" চিত্তরঞ্জন (Chittaranjan Das) সব শুনে মাথা নাড়লেন। অরবিন্দের স্মৃতিতে ভেসে এল আবার সেই সময়ের কথা। আলিপুর বোমা মামলা শেষে যখন জেল থেকে যখন বের হলেন তখন তিনি একেবারেই অন্য মানুষ। বিপ্লবের কথা বলছেন না বলছেন। বলছেন আধ্যাতিক কথা। আত্মিক উন্নতির কথা।
প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে সরলেও দেশের জন্য কলম ধরেছিলেন 'কর্মযোগীন' আর 'ধর্ম' পত্রিকার হয়ে। কিন্তু শুনলেন তার নামে ইংরেজরা ওয়ারেন্ট বের করছে। সব শুনে তার কি মনে হল একখানা নৌকো নিয়ে সোজা চলে গেলেন চন্দননগর। আশ্রয় নিলেন বিপ্লবী মতিলাল রায়ের বাড়িতে। তারপরই নিলেন এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। পন্ডিচেরী যাওয়ার। অরবিন্দ (Rishi Arabinda) পন্ডিচেরীতে কাটিয়েছিলেন জীবনের চল্লিশ বছর। অরবিন্দ পণ্ডিচেরীতে প্রায় সারাদিন যোগাভ্যাস করতেন। ধীরেধীরে গড়ে ওঠে শ্রী অরবিন্দ আশ্রম (Sree Arabinda Ashram)।
বরোদায় অরবিন্দ ছিলেন অনেকটা সময়।।আর সেখানে থাকাকালে এক ইঞ্জিনিয়ার বন্ধু দেবধরের কাছ থেকে প্রাণায়াম শেখেন তিনি। যদিও সে সময় অরবিন্দের (Rishi Arabinda) যোগের প্রতি তীব্র বিরোধিতা ছিল। অরবিন্দের (Rishi Arabinda) ধারনা বদলায়, যখন বারীনের কঠিন হিল ফিভারকে এক নাগা সাধু মুহূর্তের মধ্যে কেবল মন্ত্রপুত জল খাইয়েই ঠিক করে দিয়েছিল তা দেখে। যোগের প্রতি আকর্ষন তাকে নিয়ে যায় সেসময়ের বিখ্যাত মহারাষ্ট্রীয়ান যোগী বিষ্ণু ভাস্কর লেলের কাছে। তাঁর কাছেই যোগে হাতেখড়ি অরবিন্দের। অরবিন্দের (Rishi Arabinda) পণ্ডিচেরী আশ্রমে এসেছিলেন অনেক বিখ্যাত মানুষজন।।যার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীপুত্র দেবদাস, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পুত্র দিলীপ রায়, ঠাকুরবাড়ির সরলাদেবী ও আরও অনেকের নাম রয়েছে।
অরবিন্দের (Rishi Arabinda) বয়স তখন ৬৩। বাঘছালে আটকে পা ভাঙে অরবিন্দের। সামান্য হাঁটা চলা শুরু করলে ভক্তরা তাকে ছড়ি উপহার দেওয়া শুরু করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (Second World War) সময় অরবিন্দের ঘরে বসে রেডিও। নিয়মিত খবর শুনতেন তিনি। বয়স তাঁর তখন প্রায় আটাত্তর। শরীর অসুস্থ। ওষুধ তিনি খাবেন না। কারন, দীর্ঘ চল্লিশ বছরের জীবনে একবারের জন্যেও ওষুধের প্রয়োজন হয় নি তাঁর। শ্রীরামকৃষ্ণকে (Sree Ramkrishna) যেভাবে নিজের ক্যান্সার সারিয়ে নেওয়ার জন্য ভক্তরা বলেছিলেন ঠিক একইভাবে অরবিন্দকে তাঁর ভক্তরা বললেন- "যোগশক্তি প্রয়োগ করছেন না কেন? " অরবিন্দ মৃদু হেসে বললেন -"বোঝাতে পারব না, তোমরা বুঝবে না।" ১৯৫০ এর ৫ ডিসেম্বর মধ্যরাতে হঠাৎ করে চলে গেলেন যোগী অরবিন্দ। পাঁঁচ দিন পর তার দেহ সমাধিস্থ করা হয় পণ্ডিচেরী আশ্রমের এক গাছতলায়।যে গাছের ফুল আজও ঝরে পড়ে তার সমাধির ওপর।