সংক্ষিপ্ত


বর্ষশেষের রাতে মুম্বইয়ে (Mumbai) খালিস্তানি জঙ্গিরা (Khalistani Terrorists) হামলা চালাতে পারে। কী এই খালিস্তানি আন্দোলন (Khalistani Movement, আসুন জেনে নেওয়া যাক। 

২০২১ সালের বর্ষশেষের রাতে মুম্বইয়ে (Mumbai) খালিস্তানি জঙ্গিরা (Khalistani Terrorists) হামলা চালাতে পারে বলে সতর্ক করেছে ভারতীয় গোয়েন্দা রিপোর্ট। গত কয়েক বছর ধরেই ভারত ও ভারতের বাইরে ফের পালে বাতাস পেয়েছে খালিস্তানি আন্দোলন। তবে এর সূত্রপাত, সেই ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে যাওয়ার আগে থেকেই। যদিও, এই আন্দোলন জনপ্রিয়তা পেয়েছিল ১৯৮০-র দশকের শেষ দিকেই। তারপর অপারেশন ব্লুস্টারের পর বেশ থিতিয়ে গিয়েছিল এই আন্দোলন। গত কয়েক বছরে ফের নতুন করে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে এই আন্দোলন। যার পিছনে পাকিস্তান ও তাদের গুপ্তচর বাহিনী আইএসআই-এর হাত রয়েছে বলে দাবি করেছে ভারত সরকার। কী এই খালিস্তানি আন্দোলন (Khalistani Movement)? আসুন জেনে নেওয়া যাক। 

এক কথায় বলতে গেলে, খালিস্তানি আন্দোলন হল একটি শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। যে আন্দোলনের দাবি শিখ ধর্মাবলম্বীদের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্র গঠন করা। প্রথমে শুধুমাত্র ভারতের পঞ্জাব প্রদেশ এবং পাক পাঞ্জাব নিয়েই পৃথক খালিস্তান রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হলেও, ১৯৭০-৮০'র দশকে তার মধ্যে হিমাচল প্রদেশ, হরিয়ানা এবং রাজস্থানেরও কিছু অংশ দাবি করা হয়। তবে ঐতিহাসিকদের মতে, স্বাধীনতার আগে কোনওদিনই পাঞ্জাবে শিখ ধর্মাবলম্বীরা সংখ্যালঘু ছিল না। তবে দেশভাগের পর, শিখ নেতারা বুঝেছিলেন পাকিস্তানে থাকবে মুসলিমদের আধিপত্য, ভারতে হিন্দুদের। আর তা বুঝেই, সেই সময় থেকেই পাঞ্জাবে ভিড় জমাতে শুরু করেছিলেন শিখ সম্প্রদায়ের মানুষরা। 

আরও পড়ুন - ISI Targets Punjab, UP polls: জঙ্গিদের নিশানায় ভোটের সভা, নেতারা - ফাঁস পাকিস্তানি চক্রান্ত

আরও পড়ুন - Khalistani Terrorist Attack List: এর আগে কী কী হামলা চালিয়েছে খালিস্তানি জঙ্গিরা, দেখুন তালিকা

আরও পড়ুন - হাত মেলাচ্ছে খালিস্তানি আর ইসলামি জঙ্গিরা, দিল্লির এনকাউন্টার সামনে আনল ভয়ানক তথ্য

ঐতিহাসিকদের মতে, খালিস্তানি আন্দোলনের ডাক এসেছিল দুই জায়গায় - একটি ভারতে, আরেকটি ভারতের বাইরে। পরবর্তীকালে দুটি মিলেমিশেই খালিস্তানি আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। ১৯৪৭-এ স্বাধীনতার পর থেকেই শিখদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র বা নিদেন পক্ষে পৃথক রাজ্য গঠনের দাবি জানিয়েছিল সেই রাজ্যের রাজনৈতিক দল শিরোমণি আকালি দল। ১৯৬৬-তে এসে পৃথক পঞ্জাব রাজ্যের দাবি মেনে নিয়েছিল ইন্দিরা গান্ধী সরকার। তবে এরপরই পাঞ্জাব বিদানসবার নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিল আকালি দল। ১৯৭৩ সালে চণ্ডিগড়কে পঞ্জাবে ফিরিয়ে দেওয়া, শিখ ধর্মের স্বীকৃতির মতো বেশ কিছু ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দাবি নিয়ে আনন্দপুর সাহিব অঙ্গীকার প্রকাশ করেছিল তারা। ১৯৮২ সালে জার্নাইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালে, অকালি দলের সঙ্গে হাত না মেলানো পর্যন্ত অবশ্য সেই অঙ্গীকার বিশেষ জনপ্রিয়তা পায়নি। তবে তারও আগে বিদেশের মাটিতে ঘটে গিয়েছিল আরও কিছু ঘটনা।

১৯৫৪ সালেই লন্ডনে চলে এসেছিলেন দবিন্দর সিং পারমার। সেই সময় থেকেই তিনি লন্ডনে খালিস্তানপন্থী সভা করা শুরু করেছিলেন। তবে লোকে তাকে পাগল বলে চিহ্নিত করেছিল। তবে তিনি তাঁর প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন এবং ১৯৭০-এ বার্মিংহামে প্রথম খালিস্তানি পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। পঞ্জাব বিধানসভা নির্বাচনে হেরে গিয়ে, সেই বছরই লন্ডনে আসেন আকালি দলের নেতা জগজিৎ সিং চোহান। ১৯৭০ সালেই লন্ডন এই দুজনে মিলে এক সাংবাদিক বৈঠক করে খালিস্তান আন্দোলনের ঘোষণা করেছিলেন। তবে, শিখ সম্প্রদায়ের থেকে কোন সমর্থন তাঁরা পাননি, তাঁদের ধর্মান্ধ বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। 

তবে, ১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পরে, জগজিৎ সিং চোহানের পাকিস্তান সফরেই ভারতসহ আন্তর্জাতিক মহলে প্রথমবার মতো খালিস্তান আন্দোলন পরিচিতি পেয়েছিল। জনসমর্থনের অভাব থাকলেও খালিস্তান শব্দটি আরও বেশি স্বীকৃতি লাভ করেছিল। তৎকালীন পাক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টো, খালিস্তান গঠনে সম্পূর্ণ সহায়তা দেওয়ার আশ্বাসও দিয়েছিলেন বলে দাবি করেছিলেন চোহান। এমনকী তিনি নানকানা সাহিব'কেই খালিস্তানের রাজধানী করার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। ওই বছরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্বাধীন শিখ রাষ্ট্র ঘোষণা করে নিউইয়র্ক টাইমস-এ বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন তিনি। এরপরই প্রবাসী শিখদের কাছ থেকে কোটি কোটি মার্কিন ডলার পেয়েছিলেন তিনি। ভারতও তাঁর বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপ, রাষ্ট্রদ্রোহ এবং অন্যান্য অপরাধে অভিযুক্ত করে। 

১৯৭৯-এ ব্রিটেনে চোহান খালিস্তান জাতীয় কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮০ সালে, একইসঙ্গে লন্ডন এবং অমৃতসর থেকে খালিস্তান রাষ্ট্র গঠনের ঘোষণা করা হয়। খালিস্তানের প্রতীকী 'পাসপোর্ট,' 'ডাক স্ট্যাম্প' এবং 'ডলার' প্রকাশ করা হয়। ব্রিটেন এবং অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে দূতাবাসও খোলা হয়েছিল। এই সময়ই ইকুয়েডরের একটি ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খুলেছিল খালিস্তান জাতীয় কাউন্সিল। কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জার্মানিতে বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখার পাশাপাশি, চোহান ভারতে যোগাযোগ করেছিলেন শিখ নেতা জার্নেল সিং ভিন্দ্রানওয়ালের সঙ্গে। জার্নেল সিং তখন দেশে ধর্মতান্ত্রিক শিখ স্বদেশের প্রচার চালাচ্ছেন।

১৯৮২ সালে দিল্লিতে নবম বার্ষিক এশিয়ান গেমসকে ব্যাহত করার জন্য দিল্লিতে বিক্ষোভ করার সিদ্ধান্ত নেয় আকালি দল। গেমসের এক সপ্তাহ আগে, হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী ভজন লাল, দিল্লি-পাঞ্জাব সীমান্ত সিল করে দিয়েছিলেন। পাঞ্জাব থেকে দিল্লিগামী সকল শিখদের আটকে রাখা হয়। এতে করে শিখদের মধ্যে আকালি দল এবং ভিন্দ্রানওয়ালের প্রতি সহানুভূতি তৈরি হয়েছিল। অবসরপ্রাপ্ত বিপুল সংখ্যক শিখ প্রাক্তন সেনা অফিসাররাও ভিন্দ্রানওয়ালের পক্ষে আসেন। 

১৯৮০-র দশকে ব্যাপক হত্যাকাণ্ডে পঞ্জাবের মাটি লাল করে দিয়েছিল ভিন্দ্রানওয়ালের অনুগামীরা। সবথেকে সাড়া ফেলেছিল, ১৯৮৩ সালে দরবার সাহেবের গেটে ডিআইজি অবতার সিং অটওয়ালের হত্যা। ভিন্দ্রানওয়ালের অনুমতি ছিল না বলে, ২ ঘন্টা মৃতদেহ স্পর্শ করতে পারেননি পুলিশ অফিসাররাও। হামলাকারী, হত্যাকারীরা সকলেই গুরুদ্বারে আশ্রয় নিচ্ছেন, জেনেও কংগ্রেস সরকার কিছু করতে পারছিল না। ভয় ছিল শিখ অনুভূতিতে আঘাত লাগার। এমনকী, অমৃতসরের স্বর্ণ মন্দিরে অস্ত্র বোঝাই ট্রাক আসার খবরও ছিল সরকারের কাছে। ১৯৮৩ সালের অক্টোবরেই পাঞ্জাবে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল, যা চলেছিল পরের এক দশকেরও বেশি সময় ধরে।

কিন্তু, ১৯৮৪ সালে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছিল ইন্দিরা গান্ধীর। ১ জুন ভারতীয় সেনাকে অমৃতসরের স্বর্ণ মন্দিরে জার্নেল সিং ভিন্দ্রানওয়ালে এবং তার সশস্ত্র অনুগামীদের অপসারণের নির্দেশ দেওয়া হয়। শুরু হয়েছিল অপারেশন ব্লু স্টার। সেনাবাহিনীর পাশাপাশি এই অভিযানে ছিল কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স, বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স এবং পাঞ্জাব পুলিশ। লেফটেন্যান্ট জেনারেল কুলদীপ সিং ব্রার-এর নেতৃত্বে সেনা ৩ জুন মন্দির কমপ্লেক্স ঘিরে ফেলে। জঙ্গিরা কাছে অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক এবং মেশিনগান, গ্রেনেড লঞ্চার দিয়ে আক্রমণ চালিয়েছিল। ২৪ ঘন্টার গোলাগুলির পর, সেনাবাহিনী অবশেষে মন্দির কমপ্লেক্সের নিয়ন্ত্রণ দখল করে। ভিন্দ্রানওয়ালে নিহত হয়, তার অনেক অনুসারী পালিয়ে যায়। ভারত সরকারের অনুমান অনুসারে, মোট ৪৯৩ জন জঙ্গি ও অসামরিক ব্যক্তির হতাহতের ঘটনা ঘটেছিল।

১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর সকালে, অপারেশন ব্লু স্টারের প্রতিশোধ হিসেবে ইন্দিরা গান্ধীকে হত্যা করেছিল তাঁর দুই ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী সতবন্ত সিং এবং বিয়ন্ত সিং। এই হত্যাকাণ্ডের জবাবে উত্তর ভারত জুড়ে শিখ বিরোধী দাঙ্গার সূত্রপাত ঘটেছিল, যাকে অনেকে পরিকল্পিত শিখ গণহত্যার বলে থাকেন। 

তবে এত কিছুর পরও খালিস্তানি জঙ্গিবাদ খতম হয়নি। ভারতে ও ভারতের বাইরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তারা এখনও সক্রিয়। বাব্বর খালসা ইন্টারন্যাশনাল, ভিন্দ্রানওয়ালে টাইগার ফোর্স অফ খালিস্তান (BTFK), ভিন্দ্রানওয়ালে টাইগার ফোর্স (BTF), খালিস্তান কমান্ডো ফোর্স (KCF), খালিস্তান লিবারেশন আর্মি (KLA), খালিস্তান লিবারেশন ফোর্স, খালিস্তান জিন্দাবাদ ফোর্স (KZF), আন্তর্জাতিক শিখ যুব ফেডারেশন (ISYF),অল ইন্ডিয়া শিখ স্টুডেন্টস ফেডারেশন (AISSF), দশমেশ রেজিমেন্ট, শহীদ খালসা বাহিনী - ভারত-সহ বিভিন্ন দেশে এই সব খালিস্তানপন্থী সংগঠনগুলি জঙ্গি তালিকাভুক্ত। 

জঙ্গিবাদের পাশপাশি বিদেশের মাটিতে খালিস্তানপন্থীরা বহু সভা, সমিতি, মিছিল আয়োজন করে থাকেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিখ ফর জাস্টিস নামে একটি সংগঠন তৈরি হয়েছে, যাকে ২০২০ সালে জঙ্গি সংগঠনের তালিকাভুক্ত করেছে ভারত। ২০১৪ সালেই 'খালিস্তানের জন্য গণভোট ২০২০' নামে একটি প্রচার শুরু করেছিল তারা। ২০২০ সালে এই নামে একটি ওয়েবসাইটও খোলা হয়। এই সংগঠনটি এখন বিভিন্ন দেশেই বেশ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। খালিস্তানের দাবি এখনও মুছে যায়নি।