সংক্ষিপ্ত
এইবার রাশিয়া ও ইউক্রেনের অশান্তির মধ্যে শুরু থেকেই দেখা গিয়েছে কিয়েভকে সমানে চাপে রেখেছে মস্কো। কখনও ইউক্রেনের শাসনযন্ত্রকে অচল করার চেষ্টা করছে তারা। আবার কখনও ইউক্রেন সীমান্ত ঘেঁষে সামরিক অস্ত্রের মহড়া চালিয়ে গিয়েছে।
ইউক্রেন (Ukraine)পরিস্থিতি ক্রমশই জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। বিশেষ করে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন (Russ President Vladimir Putin) ইউক্রেন থেকে বেরিয়ে আসা দুটি বিদ্রোহী অঞ্চলের স্বাধীনতার দাবিকে স্বীকৃতি দেওয়ার পর পরিস্থিতি আরও বেশি করে ঘোরালো হয়েছে। এমনকী রুশ ফৌজ (Russian Army ) ওই দুই অঞ্চলে মোতায়েনও হয়ে রয়েছে। এমতাবস্থায় ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধ (Ukraine-Russia War) প্রায় অনিবার্য হয়ে পড়েছে বলেই মনে করছে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহল। ইউক্রেনের পরিস্থিতি সত্যি সত্যি কি যুদ্ধের পথে যাচ্ছে না অন্য কোনও উপায়ে বের হতে পারে মিমাংসা সূত্? আর রাশিয়ার কেন থেকে থেকে ইউক্রেনের শাসন ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণে নেওয়া চেষ্টা? এমনই সব বিষয় নিয়ে এশিয়ানেট নিউজের প্রতিনিধি আনিস কুমারের মুখোমুখি জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের (JNU) ডিপ্লোম্যাসি ও ডিসআরমামেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর শরণ সিং (Dr. Swaran Singh)।
ইউক্রেনের দুই বিদ্রোহী অঞ্চলকে স্বীকৃতি দেওয়ার পিছনে রাশিয়ার কোন কৌশল কাজ করছে?
দীর্ঘদিন ধরেই স্বাধিকারের দাবিতে আন্দোলন করে আসছিল ইউক্রেনের দুই অঞ্চল দন্তশক পিপলস রিপাবলিক বা ডিপিআর এবং লুহান্সক পিপলস রিপাবলিক বা এলপিআর। এরা নিজে থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে দেওয়া মানে এবং এখানে রাশিয়ার সমর্থন থাকার একটাই মানে যে এই দুই অঞ্চলের উপরে ইউক্রেনের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই এই মুহূর্তে। এমনকী, এই দুই অঞ্চলে ইউক্রেনের পক্ষে সমঝোতা করাটাও মুশকিল। ইউক্রেনের পক্ষে আরও বেশি করে অসুবিধাজনক যে রুশ ফৌজ ডিপিআর এবং এলপিআর-এ ঢুকেছে শান্তিরক্ষা বাহিনীর নাম করে। এবার যদি এই অঞ্চল বলে যে ইউক্রেনের মধ্যে তাদের আরও এলাকা দখল হয়ে রয়েছে তাহলে রুশ ফৌজ সংঘর্ষ বিরতি লাইন লঙ্ঘন করে সামনে অগ্রসর হতে পারে। এমনটা হলে ইউক্রেনের পক্ষে তা চিন্তার।
এইবার রাশিয়া ও ইউক্রেনের অশান্তির (Russia-Ukraine Crisis) মধ্যে শুরু থেকেই দেখা গিয়েছে কিয়েভকে (Kyiv)সমানে চাপে রেখেছে মস্কো। কখনও ইউক্রেনের শাসনযন্ত্রকে অচল করার চেষ্টা করছে তারা। আবার কখনও ইউক্রেন সীমান্ত ঘেঁষে সামরিক অস্ত্রের মহড়া চালিয়ে গিয়েছে। এমনকী কূটনৈতিক পর্যায়েও রাশিয়া (Russia)একইভাবে ইউক্রেনের উপর চাপ বজায় রেখেছে। আর এই চাপ আরও বেড়েছে ডিপিআর এবং এলপিআর-এর অঞ্চলে রুশ ফৌজ ঢুকে পড়ার পর থেকে।
অতিতে দেখা গিয়েছে রাশিয়া একইভাবে শান্তি বাহিনী পাঠানোর নাম করে মোলডোভার ট্রান্সনিসট্রিয়া এবং ক্রেমিয়ার দখল নিয়ে নিয়েছিল। এমনকী আন্তর্জাতিক দুনিয়া থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপুঞ্জের চাপ থাকার সত্ত্বেও রাশিয়াকে পিছু হঠাতে পারেনি। বারবার রাশিয়াকে বলা হয়েছিল দখল করা এলাকা ছেড়ে দিতে, কিন্তু এতে কোনও কাজই হয়নি।
তাই মনে করা হচ্ছে রাশিয়া ঠিক যেভাবে জর্জিয়া, মোলডোভা এবং ক্রিমিয়ার এলাকায় ঢুকে পড়ে তার দখল নিয়ে রেখেছে ইউক্রেনের দুই বিদ্রোহী অঞ্চলের ক্ষেত্রেও তারা একই কৌশল নিতে চলেছে। এখানে আরও একটি বিষয়ে চোখ ফেলার রয়েছে। আর সেটা হল ইউএনআরসি-তে দেওয়া ইউক্রেনের দূতের বয়ান। তিনি জানিয়েছেন ডিপিআর এবং এলপিআর-এ রাশিয়া অতিরিক্ত আরও ৩০,০০০ সেনা ঢুকিয়েছে। তারমানে ২০২২ সালের আগে থেকেই এই অঞ্চলে রুশ ফৌজের আনাগোনা ছিল অথবা দখল ছিল, যা সেভাবে আন্তর্জাতিক দুনিয়ার সামনে আসেনি। ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূতের এমন বয়ানের পর থেকেই মনে করা হচ্ছে ২০১৪ সাল থেকেই রাশিয়া এখানে সেনা ঢুকিয়ে রেখেছিল।
এই বয়ান থেকেই স্পষ্ট যে বহুদিন থেকে ইউক্রেন সরকার ডিরপিআর এবং এলপিআর-এর বিচ্ছন্নতাবাদীদের সঙ্গে সমঝোতা করার চেষ্টা করছিল তা স্পষ্ট। কিন্তু বিদ্রোহী এই দুই অঞ্চল যে আদৌ কিয়েভের দৌত্যকে পাত্তা দেয়নি তা এখনও আরও বেশি করে স্পষ্ট। ইউক্রেন বারবার চেষ্টা করেছে যাতে ডিপিআর এবং এলপিআর মিনস্ক চুক্তি মেনে নেয় এবং তাতে স্বাক্ষর করে। আদপেও যে তা এখন হওয়ার নয় ইউক্রেন সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। পরিস্থিতি যা তাতে মনে হচ্ছে মিনস্ক চুক্তি ডাস্টবিন বক্সে চলে গিয়েছে।
ইউক্রেন কি ন্যাটো-তে যুক্ত হবে?
ন্যাটো প্রবলভাবে গত কয়েক বছরে সদস্য সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। সোভিয়েত পতনের পর ইউক্রেনের সঙ্গে আমেরিকা এবং ব্রিটেনের মতো দেশের বন্ধুত্বের সম্পর্কের মাত্রা আরও গাঢ় হওয়ায় রাশিয়ার কপালে ভাঁজ দেখা দিয়েছে। গত ৩০ বছরে ন্যাটো ১৪টি দেশকে তাদের গোষ্ঠীর আওতায় নিয়ে এসেছে। সুতরাং, ইউক্রেন যদি কোনওভাবে ন্যাটোর সঙ্গী হয়ে পড়ে এবং আমেরিকা, ব্রিটেন-এর মতো দেশগুলি কিয়েভকে সবধরনের সহায়তার আশ্বাস দেয়। সেক্ষেত্রে রাশিয়া ইউক্রেনের প্রতি আগ্রাসন নীতি থেকে পিছু হঠতে পারে। আর ডিপিআর ও এলপিআর-কে বাফার স্টেটের মতো ব্যবহার করতে পারে।
ন্যাটো ২০০৮ সাল থেকে ইউক্রেনকে তাদের গোষ্ঠীভুক্ত করতে দৌত্য করে যাচ্ছে। কিন্তু কিয়েভ এখনও ন্যাটো গোষ্ঠীভুক্ত হতে স্বাক্ষর দেয়নি। সুতরাং ন্যাটোকেও অনেককিছু মেনে চলতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে অনেকেই আবার ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের সঙ্গে বার্লিনের যোগ খুঁজছেন। এঁদের মতে ঠাণ্ডা যুদ্ধের সময় বার্লিনের যা হাল হয়েছিল কিয়েভের সেই নিয়তি লেখা নেই তো! কিয়েভ-এর মাঝ বরাবর বয়ে গিয়েছ ডনিয়েপার নদী। এখানে ইউক্রেন বলতে গেলে দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে। ডনিয়েপার নদীর এখানে ইউক্রেনকে উত্তর থেকে দক্ষিণে ভাগ করেছে। অন্যদিকে নদীর অন্যপার ইউক্রেনকে পূর্বদিকে এক তৃতীয়াংশে ভাগ করেছে। এছাড়াও এই নদীর জন্য ইউক্রেনের পশ্চিমাংশে রয়েছে দুই তৃতীয়াংশ ভুখণ্ড।
ভৌগলিক অবস্থান মেনে দেখা গেলে ইউক্রেনের পূর্বাংশ খুব সহজেই রাশিয়ার কব্জায় চলে আসতে পারে। এটা যদি সত্যি সত্যি হয় তাহলে ইউক্রেনের আয়তন কমে দাঁড়াবে বর্তমান আয়তনের দুই তৃতীয়াংশ। এমনটা হয়ে গেলে ন্যাটোর পক্ষ এত ছোট দেশকে তাদের গোষ্ঠীভুক্ত করতে অনেক বেগ পেতে হবে। কারণ ইউক্রেনকে তাদের গোষ্টীভুক্ত করার অর্থ হল ন্যাটো তাদের বাহিনী মোতায়েনের মাধ্যমে মোলডোভা, ক্রিমিয়া এবং বেলারুশে মোতায়েন রুশ ফৌজের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলতে পারবে। এই মুহূর্তে মোলডোভার ট্রান্স-ইস্টার্নে রাশিয়া মোতায়েন করে রেখেছে ১ হাজার সেনা। বেলারুশে তারা মোতায়েন করে রেখেছে ৩০ হাজার সেনা। এমনকী কৃষ্ণ সাগর এলাকার চারপাশ ঘিরে রয়েছে রুশ বাহিনী। এবার রাশিয়া যদি ইউক্রেনের পূর্বাংশ দখল করে নেয় তাহলে ন্যাটোর পক্ষে মোলডোভা, বেলারুশ, ক্রিমিয়ার সীমান্ত বরাবর সেনা মোতায়েন স্বপ্নই দেখে যাবে এবং কৃষ্ণ সাগরের উপরের নিয়ন্ত্রণের চাপ রাখাটা আরও মুশকিল হয়ে যাবে।
ইউক্রেন কি তাহলে পরিস্থিতির শিকার ?
এদিক থেকে দেখতে গেলে প্রকৃত অর্থেই ইউক্রেন পরিস্থিতির শিকার। পশ্চিমি দেশগুলির সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং তাদের বিনিয়োগের মূল্য এখন চোকাতে হচ্ছে কিয়েভকে। ন্যাটো এবং পশ্চিমি দেশ বরাবরই ইউক্রেনকে ব্যবহার করে আসছে রাশিয়ার উপরে চাপ বজায় রাখতে। কিন্তু, কিছু কূটনৈতিক কৌশলের অসুবিধায় রাশিয়ার আগ্রাসনকে সরাসরি প্রতিরোধ করাটা পশ্চিমি দেশগুলো বিশেষ করে আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্সের মতো দেশের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এখানে আরও একটা বিষয় সামনে এসেছে যখন ন্যাটো তাদের লিয়াঁজ অফিস কিয়েভ থেকে সরিয়ে ব্রাসেলস-এ নিয়ে গিয়েছে তখন। এমনকী ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেন্সকি-কেও তারা সরিয়ে নিয়ে গিয়েছে। জেলেন্সকি এই মুহূর্তে লাভেভ-এ রয়েছেন। এখানে পশ্চিমি দেশের নিয়ন্ত্রণ ১০০ শতাংশ। তাহলে কি ন্যাটো মনে করছে রাশিয়ার হাতে ইউক্রেনের পতন হলে তারা জেলেন্সকিকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেবে!
ন্যাটোর আগ্রাসনে একটা সময় কড়া মূল্য চুকিয়েছে রাশিয়া। একটা সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীনে থাকা ইস্টোনিয়া, লিথুনিয়া এবং তিনটি বাল্টিক দেশ ন্যাটোর গোষ্ঠীভুক্ত হয়েছে। এতে চাপ বেড়েছে রাশিয়ার উপরে। এহেন পরিস্থিতিতে ইউক্রেনের উপরে আগ্রাসনের কৌশলে রাশিয়া অনেক সুবিধাজনক জায়গায় রয়েছে।
ডিপিআর ও এলপিআর-এর উপরে ইতিমধ্যে আমেরিকা, কানাডা বিধিনিষেধ জারি করেছে, রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদ এখানে আর কি কোনও অতিরিক্ত অবরোধ নীতি লাগু করতে পারে?
সমস্ত রাশিয়ান তেল কোম্পানি এবং গ্যাস সংস্থাগুলো ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ব্যবসা করে। এমনকী বহুজাতিক ব্যাঙ্কেও রুশ সংস্থাগুলোর আর্থিক লেনদেন হয়। এমনসব লেনদেন এবং ব্যবসার উপরে বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে পশ্চিমি দেশগুলো। এছাড়াও রাশিয়ার এমন সব সংস্থাকে চিহ্নিত করে তাদের সম্পত্তি, লেনদেনে বিধিনিষেধ আরোপ করা থেকে এদের পশ্চিমি দেশে আনাগোনা-য় অবরোধ নীতি আরোপ করতে পারে। তবে এতে খুব একটা লাভ হবে না। কারণ পুতিন এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে তৈরি। রাশিয়ার হাতে ৬৩০ বিলিয়ন ডলারের ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ রয়েছে। তাই অবরোধ বা বিধিনিষেধে খুব একটা কাজ হবে না।
রাশিয়া বনাম ইউক্রেনের এই বিবাদে তাহলে ইউরোপের ভূমিকাটা কী হতে চলেছে?
ইউরোপের শক্তিশালী দেশগুলি আমেরিকার কথা শুনে চলবে মনে হয় না। কারণ ইতিমধ্যে জার্মানি এই পরিস্থিতিতে ইউক্রেনে অতিরিক্ত সমরাস্ত্র ঢোকানোর নিন্দা করেছে। এমনকী ফ্রান্সও সমানে কিয়েভ ও মস্কোর মধ্যে দৌত্য চালানোর চেষ্টা করছে। জার্মানি সম্প্রতি রাশিয়া থেকে গ্যাস আনার পাইপ লাইন বসিয়েছে। ১১ বিলিয়ন ডলারের এই পাইপলাইন। এটা চালু হলে জার্মানির গ্যাস আমদানি ডাবল হয়ে যাবে। এমন এক পরিস্থিতিতে জার্মানিও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করতে চাইবে না। ইউরোপ পরিস্কার করে দিয়েছে ইউক্রেন ইস্যুতে তারা আমেরিকার দেখানো পথে হাঁটতে রাজি নয়। সেক্ষেত্রে আমেরিকাকে খুব কম সমর্থন নিয়েই ইউক্রেনের পক্ষপাতিত্ব করে রাশিয়ার বিরোধিতায় অবতীর্ণ হতে হবে।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে কড়া মনোভাব আমেরিকার, পুতিনকে রুখতে আর্থিক নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা বাইডেনের
রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে ভারতে প্রত্যক্ষ প্রভাব, দেখুন কোন জিনিসের দাম হবে আকাশছোঁয়া
ইউক্রেনের এমন ৮ অজানা কাহিনি, যা বিশ্বজুড়ে যে কোনও মানুষকে আকর্ষণ করে