সংক্ষিপ্ত

গভীররাতে ফোন কলটা এসেছিল। নির্দেশ এসেছিল এখনই ছুটে যেতে হবে ইস্তানবুলে। সেখান থেকে বিমান নিয়ে পাড়ি দিতে হবে ইউক্রেনে। সেদেশে আটকে থাকা ভারতীয়দের উদ্ধার করতে হবে। 

যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনের বুক থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা এসে পৌঁছেছিলো পোল্যান্ড এবং হাঙ্গেরিতে। যুদ্ধের আতঙ্কে ১৮ থেকে ২০ বছরের ছেলে-মেয়েগুলো মানসিকভাবে বিধ্বস্ত তখন। চোখে-মুখে গভীর আতঙ্ক। ওদের দেখে স্বাভাবিকভাবেই কষ্ট হচ্ছিল। অনেকে অসুস্থও হয়ে পড়েছিল। পাইলট মহাশ্বেতা চক্রবর্তীর কাছ থেকে পাওয়া এই বয়ানই বলে দেয় যে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সেখানে আটকে থাকাদের মানসিক এবং শারীরক অবস্থাকে কোন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে। ইউক্রেনে আটকে থাকা এই ছাত্রদের উদ্ধার অভিযানে সামিল হয়েছিল কলকাতার নিউটাউনের মেয়ে মহাশ্বেতা চক্রবর্তী। 

মহাশ্বেতা জানিয়েছে, 'গভীর রাতে ফোনটা এসেছিল। বলা হয়েছিল যে আমাকে অপারেশন গঙ্গার জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে। যার কাজ ইউক্রেনে আটকে থাকাদের উদ্ধার করা। মাত্র ২ ঘণ্টায় আমি আমার ব্যাগ প্যাক করেছিলাম এবং বেরিয়ে পড়েছিল। ওই রাতেই আমি ইস্তানবুল চলে যাই। পোল্যান্ড থেকে কীভাবে উদ্ধার অভিযান হবে তা আমাদের বিস্তারিতভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হয়।' 

২৪ বছরের মহাশ্বেতা এরপর ৮০০ ভারতীয় ছাত্রকে বিমান চালিয়ে পোল্যান্ড এবং হাঙ্গেরি থেকে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছে। ২৭ ফেব্রুয়ারি উদ্ধার অভিযানে সামিল হয়েছিল মহাশ্বেতা। ৭ মার্চ উদ্ধার অভিযান সম্পন্ন করে কলকাতার বাড়িতে ফিরে আসে সে। মোট ৬বার বিমান নিয়ে সে যাতায়াত করেছে। ৪বার সে বিমান নিয়ে গিয়েছে পোল্যান্ডে এবং ২ বার ভারতীয় ছাত্রদের ফেরত এনেছে হাঙ্গেরি থেকে। 

আরও পড়ুন- মা-এর চিঠি নিয়ে ১৪০০ কিমি পথ একাকি পাড়ি ১১ বছরের বালকের, ইউক্রেনের ক্ষুদে নায়কের কাহিনি

টানা ১৪ থেকে ১৬ ঘণ্টা এয়ারবাস চালানো যে কতটা কঠিন সে কথাও তুলে ধরেছে মহাশ্বেতা। বলতে গেলে এতটা পথের সফর শেষ করে সেভাবে বিশ্রাম নেওয়ার অবকাশ থাকত না। শরীরে শক্তির অবশিষ্ট থাকতো না। কিন্তু, আটকে থাকা ভারতীয়দের কথা ভেবে আবার সকলে মিলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে উদ্ধার অভিযান। যত কষ্টই হোক বিমান চালিয়ে ফের পাড়ি দিয়েছে হয় পোল্যান্ড অথবা হাঙ্গেরিতে। 

আরও পড়ুন- প্রেমের কাছে হারল যুদ্ধ - সামরিক চেক পয়েন্টেই প্রেমিকাকে চুমু সেনার, ভিডিও ভাইরাল

অপারেশন গঙ্গায় সবচেয়ে বেশি উড়ান চালিয়েছে এয়ার ইন্ডিয়া। এর সঙ্গে ইন্ডিগো, স্পাইস জেটও তাদের উড়ান নিয়ে ইউক্রেনের প্রতিবেশী দেশগুলি থেকে ভারতীয়দের উদ্ধার অভিযানে সামিল হয়েছিল। এছাড়াও ছিল বায়ুসেনা। মহাশ্বেতা একটি প্রাইভেট সংস্থার হয়ে কাজ করে। তাদের এয়ারবাস নিয়ে অপারেশন গঙ্গায় সামিল হয়েছিল সে। 

ইন্দিরা গান্ধী রাষ্ট্রীয় উড়ান অ্যাকাডেমি থেকে পাইলট-এর প্রশিক্ষণ নিয়েছিল মহাশ্বেতা। সে আরও জানিয়েছে, ১৩ থেকে ১৪ ঘণ্টার সফরে যেভাবে ছাত্র-ছাত্রীরা বসেছিল এবং তাদের সেই উদ্বেগভরা মুখগুলো দেখে সত্যি সত্যি কান্না পেয়ে যেত। কতদিনের অভুক্ত দশায় তারা যে একটা নিরাপদ স্থানে পৌঁছেছেন সে কাহিনি শেষ হবার নয়। মহাশ্বেতারা বিমান সওয়ারি হওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবার এবং জল দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু যতক্ষণ না ভারতে বিমান পৌঁছেছে ততক্ষণ পর্যন্ত অনেকেই খাবার তো দূরস্ত, জলও খেতে চাইছিল না। সকলেরই একটাই কথা ছিল যত দ্রুত সম্ভব 'আমাদের' বাড়ি পৌঁছে দাও।

আরও দেখুন- ৮৫ বছরের মা একাকী পড়ে রয়েছে কিয়েভে, দেশ ছেড়ে পালানো মেয়ে ভেঙে পড়ল কান্নায়

মহাশ্বেতা এই উদ্ধার অভিযানের বর্ণনা দিতে গিয়ে জানিয়েছে, 'একবার একটি উড়ানে বছর ২১-এর এখ ছাত্রা সমানে জ্ঞান হারাচ্ছিল। প্রবল মানসিক হতাশায় তার এই অবস্থা ছিল। তখনও আমরা টেক অফ করিনি। ভাগ্য ভালো যে ওই বিমান বেশকিছু জুনিয়র ডাক্তার ছিল। তারাই সেই ছাত্রীকে সুস্থ করে তোলে এবং এরপর উড়ান টেক অফ করে। এই ঘটনা আমাকে সত্যি নাড়িয়ে দিয়েছিল। আমি এখনও ভুলতে পারছি না ওই ছাত্রী জ্ঞান হারানোর আগে আমার হাতটা চিপে ধরেছিল, আর বিড়বিড় করে বলছিল তাকে তার মা-এর কাছে পৌঁছে দিতে।' 

কলকাতা শহরেই বেড়ে ওঠা মহাশ্বেতার। অক্সিলিয়াম কনভেন্টের প্রাক্তন ছাত্রী মহাশ্বেতা বরাবরই পাইলট হতে চেয়েছিল সে। আজ শুধু সে পাইলট হয়নি এমন কিছু অভিযানে অংশ নিয়েছে যা তাকে গর্বিত করেছে। অপারেশন গঙ্গার আগে মহাশ্বেতার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অভিযান ছিল কোভিড ১৯-এর ভ্যাকসিন প্লেনে করে শহরে শহরে পৌঁছে দেওয়া। এই কাজ তাকে করতে হয়েছিল যখন সবে টীকাকরণ কর্মসূচি শুরু হতে চলেছে সেই সময়ে। বন্দে ভারত অভিযানের অধীনে তার সেই উড়ান নিয়ে যাতায়াত করাটাও একটা অসামান্য অভিজ্ঞতা বলে জানিয়েছে মহাশ্বেতা। 

এমনকী কোভিড ১৯-এর দ্বিতীয় ঢেউ-এর সময় দেশজুড়ে যখন অক্সিজেনের চাহিদা তুঙ্গে তখন প্লেনে করে অক্সিজেন কনট্রাক্টর মেশিন পৌঁছে দিয়েছিলেন শহরে শহরে। মহাশ্বেতা জানিয়েছে, পাইলট হিসাবে তিনি মানবতার কাজে নিজেকে যেভাবে নিজেকে নিয়োজিত করতে পেরেছেন তাতে অত্যন্ত খুশি, কিন্তু তার মতে ইউক্রেন উদ্ধার অভিযানে যে ছাত্র-ছাত্রীদের তিনি উদ্ধার করেছেন তারা হল আসল হিরো। কারণ, যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্যে থেকে যেভাবে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে এবং অভুক্ত হয়ে মাইলের মাইল হয় ট্রেনে না হয় গাড়ি অথবা পায়ে হেঁটে পোল্যান্ড-হাঙ্গেরিতে পৌঁছেছিল তার জন্য বিশাল সাহসীকতা লাগে বলে মনে করে সে। মহাশ্বেতার মা তনুজা চক্রবর্তীও মেয়ের এমন কীতকর্মে প্রবলখুশি। ইতিমধ্যেই মেয়েকে অভিন্দন জানিয়ে ফেসবুকে তাঁর অভিন্দনন বার্তা পোস্টও করেছেন।