সংক্ষিপ্ত
- জনতার কারফিউয়ের দিন একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছিল
- পরে লকডাউনের মধ্য়ে সেই ভিডিয়ো ভাইরাল হয়
- রীতিমতো ব্য়াঙ্গবিদ্রুপের শিকার হতে হয় চা খেতে আসা ওই মানুষগুলোকে
- অবশেষে একজনের পরিচয় পাওয়া যায় আর সেইসঙ্গে শুরু হয় বিবেক দংশন
সবুজ মুখোপাধ্য়ায়: একুশ দিনের লকডাউন তখনও শুরু হয়নি। এমনকি শুরু হওয়ার কোনও আভাসও পাওয়া যায়নি। রবিবার। জনতার কারফিউ শুরু হয়েছে। সকালের দিকে একটি ভিডিও চোখে পড়লো ফেসবুকে। তখনও বুঝিনি, আগামী কয়েকদিনে ওই ভিডিওটাই সমবেত খিল্লির বিষয় হয়ে উঠতে চলেছে নেটিজেনদের কাছে।
কী দেখা গেল ভিডিও-তে?
স্বেচ্ছায় মেনে চলার কথা যে জনতার কারফিউ, যেখানে প্রধানমন্ত্রী নিজেও কোনও কিছু চাপিয়ে দেননি জোর করে, সেই কারফিউ-র দিন কলকাতার পল্লীশ্রী অঞ্চলের একটি ছোট্ট চায়ের দোকান খোলা ছিল। সেখানে কাতারে কাতারে মানুষ ভিড় করেননি (যেমন ভিড় দেখা গিয়েছিল ঠিক সেদিনই বিকেলে, দলবল মিলে রাস্তায় বেরিয়ে থালা বাজানোর সময়ে)। তা আচমকা শোনা গেল এক যুবতীর কণ্ঠস্বর, যিনি ভিডিও-টা করছিলেন আর কী। একেবারে প্রধান শিক্ষিকার মতো করে এসে তিনি বকাবকি শুরু করলেন-- কেন 'তোমরা' চা খেতে এসেছো? বাপের বয়সি লোকগুলোর শ্রেণি চরিত্র দেখেই বোধহয় 'আপনি'র বদলে 'তুমি' বলে সম্বোধন করতে পারলেন নীতি পুলিশের ভূমিকায় অবতীর্ণ ওই মহিলা। যাই হোক, একটা কথা বলে রাখা ভালো--তখনও কিন্তু পরিস্থিতি এতটা জটিল হয়নি। সেই রবিবারের সঙ্গে লকডাউন শুরু হওয়ার দিনগুলো ব্য়বধান যেন এক আলোকবর্ষকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় পরিস্থিতি বদলেছে। যদিও ওই ভিডিওটি এমনভাবে চলেছে লকডাউনের বাজারে, যেন মনে হয়েছে মানুষগুলো লকডাউন উপেক্ষা করেই চা খেতে জড়ো হয়েছেন। কারণ কোনও দিনক্ষণের উল্লেখ নেই কোথাও। অবশ্য় সমবেত খিল্লির ক্ষেত্রে অত অথেনটিসিটির প্রয়োজন পড়ে না।
তা যাই হোক, এবার কী হল, যুবতীর ক্য়ামেরার সামনে পড়ে কেউ কেউ মৃদু প্রতিক্রিয়া জানালেন। একজন বললেন-- কোয়েশ্চেনগুলো ওনাদেরকেই করুন, যারা ওখান থেকে এসে রাস্তায় ঘুরে বেরিয়ে... আপনার কি ওনাদের প্রশ্নটা করার ক্ষমতা আছে... স্পেশাল সেক্রেটারিকে গিয়ে কোয়েশ্চেনটা করতে পারবেন, তাঁর ছেলে এসে যেভাবে যে ঘুরলো,... আমরা চা খেতে এসেছি, আড্ডা মারতে, নয়, চা খাওয়া হয়ে গিয়েছে, বাড়ি চলে যাচ্ছি।
খুব জরুরি প্রশ্ন বলে মনে হল। বিশেষ করে এ-রাজ্য়ে এখনও পর্যন্ত করোনায় যতজন আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁদের প্রায় সবার সঙ্গেই বিদেশ-যোগ প্রমাণিত। যাইহোক, এর ঠিক পরেই গায়ে গামছা পরা এক নিম্নবিত্ত মানুষ অপার সরলতার সঙ্গে প্রশ্ন করলেন-- "চা খাবো না আমরা, আমরা খাবো না চা!" তাঁর পাশে তখন বিপুল বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন একজন প্রৌঢ়। "তোবড়ানো গাল ভেঙে যাওয়া মুখ"। ঝুঁকে পড়েছে অর্ধেক শরীর। যুক্তি-তর্কের কিছুই বুঝতে পারছেন না তিনি। ঠিক যেমন আমরা অনেকেই বুঝতে পারছি না-- অনাবাসী ভারতীয়দের বিমানে করে উড়িয়ে আনা হবে আর পরিযায়ী শ্রমিকরা অভুক্ত শরীরে দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে গিয়ে বেঘোরে মারা পড়বেন কেন। তা যাইহোক, এহেন কথোপকথনের পর যুবতী রীতিমতো শাসিয়ে গেলেন, তিনি এই ভিডিও ফেসবুকে দিয়ে দেবেন। তখনও বুঝিনি-- সোশাল মিডিয়া আদতে শালিশী সভারই ডিজিটাল সফিসটিকেটেড ভার্সান ছাড়়া আর কিছু নয়।
এবার শুরু হল খিল্লি। সমবেত খিল্লি। যে ভদ্রলোক সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন তুলেছিলেন-- স্পেশাল সেক্রেটারিকে গিয়ে প্রশ্নটা করতে পারবেন, তাঁর স্ত্রীকে এবার খুঁজে বের করা হল। নেটিজেনদের মধ্য়ে কেউ কেউ রীতিমতো সিবিআইয়ের ভূমিকা নিয়ে আবিষ্কার করে ফেললেন-- "লোকটার বউ চা করে খেতে দেয় না বলেই নাকি সে সেদিন দোকানে চা খেতে এসেছিল।" সেইসঙ্গে 'বউদি'র উদ্দেশে কিছু পরামর্শও তাঁরা দিলেন। খিল্লিতে যেমন হয় আর কী। আর গামছা জড়ানো ওই মানুষটা, যিনি বলেছিলেন-- "চা খাবো না আমরা, আমরা চা খাবো না"-- তাঁর কী দশা হল শিক্ষিত নেটিজেনদের হাতে পড়ে? তাঁকে নিয়ে গান বাঁধা হল, বিদ্রুপে বিদ্রপে ছয়লাপ করা হলো তাঁর কথার দেশোয়ালি টানকে। এমনকি, কেউ তো আবার তাঁর একটা আবক্ষ মূর্তি পর্যন্ত বানিয়ে ফেললেন!
দেখতে দেখতে কেটে গেল দশদিন মতো। দেখা গেল আর একটা ভিডিয়ো। কী দেখা গেল সেই সেখানে? লকডাউনের বাজারে নির্বাচিত সাংসদরা যখন রান্নার পোস্ট দিচ্ছেন, বিরিয়ানির পোস্ট দিচ্ছেন, মুখে মেকআপ মেখে পোস্ট দিচ্ছেন, সমবেত কবিতা, গল্প ও খিল্লি চলছে অবিরাম ও অবিরত, সেখানে ওই মানুষটাকে দেখা গেল কোদাল দিয়ে মাটি কাটতে। মানুষটার মাথার ওপর গনগনে সূর্য আর গা-বেয়ে চুঁইয়ে পড়া ঘাম আমাদের বিবেককে খানিক দংশন করল। হাওয়াও খানিক ঘুরলো। এবার কেউ কেউ লিখলেন-- মানুষটাকে নিয়ে আর খিল্লি নয়। আর মিম নয়। যথেষ্ট হয়েছে। জানা গেল, কারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তাই জোগাড়ের কাজ করেন তিনি এখন। বাড়িতে কেউ নেই চা করে দেওয়ার জন্য়। তাই সেদিন চা খেতে বাধা পেয়ে ভয়ানক বিস্ময়ে নিরীহ প্রশ্ন করেছিলেন-- চা আমরা খাবো না! আমরা বুঝলাম না-- ওই মানুষটাকে তো বাইরের দোকানেই চা খেতে হয়। পাইস হোটেলেই খাবার জোগাড় করতে হয় প্রতিদিন। অবশ্য় যদি কাজ জোটে তবেই।
আসলে মুশকিল হল, ফেসবুক প্রজন্মের একটা বড় অংশের কাছে দুনিয়াটা এত কম জানা , এত কম দেখা , এত কম চেনা যে, তাঁদের অনেকের পক্ষেই বোঝা সম্ভব হয়ে উঠলো না যে, গামছা পরা একজন ঠিকে শ্রমিক কী ভাষায় কথা বলেন, কী ভাবে প্রতিক্রিয়া জানান, একই কথাকে কেন আবার ঘুরিয়ে দু-বার বলেন। সেই কথাগুলোকে নিয়ে আর যাই করা হোক খিল্লি করতে নেই। কেউ একটা ভিডিয়ো আপলোড করে দিলেই তার পেছন পেছন দৌড়তেও নেই। তার আগে কিছু জরুরি প্রশ্ন করে নিতে হয় নিজেকে। তাই নয় কি?
পুনশ্চ--আর একটা কথা। আমরা যাঁরা নীতি পুলিশ, তাঁরা অন্তত আর যাই করি না কেন, কাউকে অভিযুক্ত করতে হলে তাঁর স্ত্রীকে টেনে আনতে পারি না শালিশীর মধ্য়ে । ওইটুকু শালীনতা থাকা দরকার। কী বলেন?