সংক্ষিপ্ত
দেয়ালের কোণাখামচিতে লুকিয়ে থাকা পোকাগুলো অ্যাতো দিনে বোধহয় আমাকে চিনেও ফেলেছে। আমার রোগাপটকা শরীর। কথা আটকে আটকে যায়। একনাগাড়ে বলতে পারি না। পাড়ার অনেকের মতো তারাও আমাকে চিনে ফেলেছে।
মারা যাচ্ছি। একটু একটু ক’রে মারা যাচ্ছি। ঘরের ভিতর চার-চারটে দেয়াল ক্রমশ ঘনীভূত হয়ে আসছে আমার চারপাশে। আমাকে চেপে ধরতে চাইছে যেন! বেশ বুঝতে পারছি। কি আশ্চর্য! অ্যাতো দিন দেয়ালের লপচপানির গন্ধ পাইনি। চুন-সিমেন্ট-বালি-ইটের মিলিত এক অদ্ভুত গন্ধ পেলাম। আগে পেতাম না। এখন পাচ্ছি। বিলকুল পাচ্ছি। নাক টানতে হচ্ছে না। আপনা-আপনি নিঃশ্বাসের সঙ্গে বেমালুম জায়গা করে নিচ্ছে মগজে। আরও বেশ বুঝতে পারছি, একটু একটু ক’রে চার-চারটে দেয়াল আমার কাছে সরে সরে আসছে যেন!
ইমন আমার বউ। ইমনকে বললাম এই কথা। সে আমার কথা শুনে ক্ষণিকের জন্য থম মেরে দাঁড়িয়ে পড়ল ঘরের মাঝখানে। তারপর কোমরে দু’হাত চেপে অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল— অদ্ভুত কথা তো!
— তোমার কাছে অদ্ভুত লাগছে?
হ্যাঁ। লাগছেই তো। লকডাউনে ঘরে থাকতে থাকতে দেখছি, তোমার মাথাটা একদম খারাপ হয়ে গেছে, বেশ বুঝতে পারছি।—
এই কথাগুলো বলতে বলতে ইমন রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। আমি সেইদিকে তাকিয়ে আবার একই কথা বললাম। বার বার বলতে লাগলাম।
বুঝতে পারলাম, ইমন আমাকে পাত্তা দিচ্ছে না।
বাইরের উজ্জ্বল আলো আমার চোখে ফ্যাকাসে লাগছে। চা-খাওয়ার মাত্রা বেড়েছে। চায়ে শেষ চুমুকটা দিয়ে বেশ জোরের সঙ্গে কাপটা রাখলাম প্লেটে। ঠক্ ক’রে শব্দ হল। আমার কানে বড়ো ক’রে বেজে উঠল।
২
দেয়ালের কোণাখামচিতে লুকিয়ে থাকা পোকাগুলো অ্যাতো দিনে বোধহয় আমাকে চিনেও ফেলেছে। আমার রোগাপটকা শরীর। কথা আটকে আটকে যায়। একনাগাড়ে বলতে পারি না। পাড়ার অনেকের মতো তারাও আমাকে চিনে ফেলেছে।
সেইসব পোকাগুলো। পোকা বলতে টিকটিকি, আরশোলা, মশা, কালো ডাসা পিঁপড়ে.... এইসব আর কি! (আরও থাকতে পারে। যেসব পোকাগুলো, জীবাণুগুলো চোখে দেখিনি আজও)।
তো দেখা পোকাগুলো সুড়সুড় ক’রে অনায়াসে খুব কাছে চলে আসে। অবলীলায় নিজেদের বীরত্ব প্রকাশ করে। যেন দেয়ালগুলো তাদের কাছে খোলা মাঠ। খেলার মাঠ। সেইসব দেয়ালগুলো যেন অনেকটা ঝুঁকে পড়ে সামনের দিকে। আমার মাথার ওপর। যেন খুব কাছে চলে আসে। তখন পোকাগুলো ভয়ংকর হয়ে ওঠে।
পোকাগুলো আগে এভাবে আসত না। এখন অনেক ফুর্তি আর তীব্র ক্ষুধার্ত হয়ে আসে। একটুও ভয় পায় না! উলটে আমাকে ভয় দেখায়! ধারালো নখ দেখায়! হুল তাক করে! একেবারে আমার চোখ বরাবর!
তারপর আরও মনে হয়, ওই পোকাগুলো এখুনি বুঝি নিমেষে আমার শরীর দখল করবে। সম্মিলিতভাবে ঝাঁপিয়ে পড়বে আমার ওপর। কিলবিল করবে। একটু একটু করে চিবিয়ে চিবিয়ে খাবে মগজ। ফুসফুস। কিডনি। সবশেষে হাত। পা। খেতে খেতে মাথা নাড়াবে। লেজ নাড়বে।
আঁতকে উঠি। কেঁপে ওঠে সারা শরীর। এইসময় ইমনকে খুব কাছে পেতে ইচ্ছা করে। ইচ্ছা করে ইমন আমার সামনে এসে ঢাল হয়ে দাঁড়াক।
এই মুহূর্তে মনে পড়ল, কোথায় যেন দেখেছি, ক্ষুদে ক্ষুদে পিঁপড়ের দল কিভাবে একটি জ্যান্ত বড়ো সাপকে কামড়ে কামড়ে কাবু করে হত্যা করছে....
আমাকেও কি সেইভাবে হত্যা করবে ওই পোকাগুলো!
আগের মতো ‘হুসহুস’ ‘হাসহাস’ শব্দগুলো আমার দুই ঠোঁটে উঠে আসে না। এখন বোধহীন। হাসি নেই। কান্না নেই। দুঃখ নেই। জৈবিক চাহিদাও নেই। শুধু ওই পোকাগুলোর মতো হয়তো খিদে আছে। এইটুকু....
সময় হলে ইমন খেতে ডাকে। কখনও-বা ছেলেমেয়েকে দিয়ে বলে পাঠায়, তোর বাবাকে খেতে ডাক। অনেক বেলা হয়ে গেল!
থপথপ ক’রে খাওয়ার থালার সামনে গিয়ে ধপাস করে বসে পড়ি। অমনি ঠোঁটজোড়া হাঁসের ঠোঁট হয়ে ওঠে। গপগপ খাই ঠিকই। কিন্তু কি খাই? শাক সেদ্ধ? ডাল সেদ্ধ? ভাত সেদ্ধ? ডিম সেদ্ধ? হলফ করে বলতে পারি না। বেশ বুঝতে পারি, ইমন আমার ভাতের থালার দিকে হাঁ ক’রে তাকিয়ে আছে। আমার ঠোঁটজোড়া হাঁসের ঠোঁটের মতো হলুদবর্ণ হয়ে উঠেছে। ঝুঁকে পড়েছি ভাতের থালার ওপর। আমার ডান হাত কাজ করছে না আগের মতো। কেবল দুই ঠোঁট দিয়ে যতটা পারছি ভাত গলাধঃকরণ করছি। কেবল ইমনই বুঝতে পারছে। সে চেঁচিয়ে প্রশ্ন করে— তুমি ওভাবে খাচ্ছো কেন?
— কেন? অন্যরকম লাগছে না-কি আমাকে? উলটে আমি প্রশ্ন করি।
লাগছে বলেই তো বলছি।—
বিরক্তি সহকারে ইমন বলে।
এরপর আমি কিছু বলি না। বলতে পারি না। বাইরের ওই উজ্জ্বল আলোর মধ্যে একটা প্রকাণ্ড ভয় ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে আমাকে ঘিরে ফেলেছে, এই কথাটা কিছুতেই ইমনকে বলতে পারি না।
৩
কেউ ডাকলে অমনি পোকাগুলো সজাগ হয়ে যায়। তারপর ইতিউতি চায়। স্পষ্ট বুঝতে পারি ঘাড় ঘোরাচ্ছে। ‘কোন শালা ডাকছে বে?’— এমনই ভাব তাদের চোখেমুখে! তারপর সুড়ুত করে দরজার খুব কাছে চলে আসে। পুরনো দরজা। কাঁধে ইট-বালি-চুনসুড়কি’র পাহাড় নিয়ে এখন আমার মতোই হাঁপাচ্ছে। ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বাবাকে মনে পড়ে। মাকে মনে পড়ে খুব....
পোকাগুলো বাইরের দিকে তাকায়। বিছানায় শুয়ে পোকাগুলোর কাণ্ডকারখানা দেখি। জিভ দিয়ে নখ চাটে। জিভ দিয়ে হুল চাটে। অজস্র পা’কে অজস্র হাত বানিয়ে সুচারু ম্যাজিশিয়ান হয়ে ওঠে মুহূর্তে। গোঁজামিলকে ক্ষণে ক্ষণে সুচারু শিল্পে পরিণত করতে করতে ভয় দেখায়— ভয়! ভীষণ ভয়! ঘরে থাকুন! চুপটি করে থাকুন! কোনও টুঁ শব্দটি করবেন না! একটি পা-ও ঘরের বাইরে রাখবেন না!—
তাহলেই সব ঠিকঠাক চলবে। বিশ্বকে আমরা একটা উপযুক্ত বার্তা দিতে পারব। ভারত আবার জগত সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লভে....
তবুও ভয়জারিত মনে বিস্ময়ের ঢেউ দু’চোখে আঁছড়ে পড়ে। ঝাপসা হয়ে ওঠে চারপাশ।
৪
দীর্ঘদিন লকডাউনে ঘরবন্দি থাকতে থাকতে আর আগের মতো হাঁটতে পারি না। এটা খুব সত্যি কথা। পা’জোড়া ভারী হয়ে উঠেছে। পেটটাও বেশ বড়ো হয়ে গেছে। চোখজোড়া আরও ছোটো হয়ে একজোড়া বিন্দু পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। তাকাতে বড়ো কষ্ট হয়। মাথা ভর্তি কাঁচাপাকা চুল। গাল ভরতি দাড়িগোঁফ। একটুও হাসি নেই। সব হাসি যেন উবে গেছে চারপাশে! একটা থম মারা পরিবেশ চারদিকে।
একদিন ইমনকে ডেকে বাচ্চাদের মতো আবদার করে বললাম— তুমি একটু হাসো না। অনেক দিন হাসির শব্দ শুনিনি।
এখন কি হাসির সময়?
তা ঠিক। তবুও হাসো।
আমার যে হাসি আসে না!
তুমি হাসলে আমিও হাসার চেষ্টা করব। সঙ্গে ছেলেমেয়েকেও বলব, তোরা আমাদের সঙ্গে হাস। হো হো করে হাত-পা নাচিয়ে হেসে ওঠ। তাহলে ওই পোকাগুলো ভয় পেয়ে যাবে।
কোন পোকাগুলো? ইমন অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে।
ওই যে ঘরের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে যেসব পোকাগুলো! যারা প্রতিনিয়ত আমাদের ভয় দেখিয়ে নিজেদের কার্যসিদ্ধি করছে....
ইমন আর কথা বলে না। ও বুঝে যায়, নির্ঘাত আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। লকডাউন উঠলে ঠিক ডাক্তারের কাছে যাবে। নিশ্চিত যাবে।
তারপর ঘরের কাজে মন দেয়।
৫
আয়নায় নিজেকে দেখে যখন চমকে উঠলাম তখন ইমন অনায়াসে বলে ফেলল— তোমাকে অন্যরকম দেখাচ্ছে!
কীরকম?
বিয়ের আগে এমনটি দেখলে কিছুতেই তোমাকে বিয়ে করতাম না।—
ইমন খুব গম্ভীর গলায় বলল।
এরপর আমি আর কিছু বলিনি। ঠিকই বলেছে। একদম সত্যি কথা বলেছে। আমিও বুঝতে পারছি, আমার শরীরের একটু একটু করে পরিবর্তন। প্রতিদিন আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে টের পাচ্ছিলাম।
একদিন ছেলেমেয়েদের মুখেও মায়ের কথার প্রতিধ্বনি শুনতে পেলাম। হি হি ক’রে হাসতে হাসতে বলল— ‘বাবা, তোমাকে অন্যরকম দেখতে লাগছে!’
কীরকম?
কীরকম দেখতে লাগছে রে বাবাকে? মেয়ে দু’বছরের বড়ো দাদাকে প্রশ্ন করল।
ভূতের মতো! বলেই দু’জনে মোবাইলে গেম খেলতে শুরু করল।
জানলার বাইরে দূরের গাছগুলোর সব নাম জানি। তাদের বয়স কত? কে পুঁতেছে? সব জানা আমার। উড়ে আসা প্রতিদিনের পাখিগুলোর নামও দিয়েছিলাম একসময়। তারা আস্লে আমি ডাকি সেই নামে। তারা খুশি হতো। ঘর থেকে রুটি কিংবা মুড়ি নিয়ে আসতাম।
এখনও আসে। ডাকে। অথচ আমি খেতে দিতে পারি না!
৬
বুঝতে পারি, শরীর আমার। অথচ শরীরে আমি নেই। প্রতিনিয়ত একটু একটু ক’রে মারা যাচ্ছি। এখন আবার ভাবতে শুরু করেছি, আদৌ আমি মানুষ নামক প্রাণী আছি কি-না!
পোকাগুলোর একটুও ভয়ডর নেই। প্রত্যেকেই হুল ফোটাচ্ছে। নখ দিয়ে আঁচড়াচ্ছে। সেই সাপটার মতো ছটফট করছি। প্রতিটা সময়ে। বিছানায় গড়াতে গড়াতে মেঝেতে পড়ে যাই। একটুও শব্দ হয় না। কেউ টের পায় না আমার পড়ে যাওয়া। আবার দাঁড়াতে চেষ্টা করি।
জানালার কাছে যেতে চাই। নীলাভ আকাশটাকে দেখতে চাই। মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে চাই। গাছগুলোকে দেখতে চাই। দেখতে চাই পাখিগুলোকে। তাদের নাম ধরে ডাকব আবার। ওরা ঠিক আসবে। কাছে আসবে। আগের মতো খাবে....
পোকাগুলো ভয়ংকর কামড়াচ্ছে। আঁচড়াচ্ছে। সারা শরীরে বিষ ছড়িয়ে দিচ্ছে। একটু পরে হয়তো কোনও এক সাদা দেয়ালের গায়ে ছবি হয়ে সেঁটে যাব!
তবুও আমাকে বাঁচতে হবে। সংসারের মুখ চেয়ে আমাকে বেঁচে থাকতে হবে।
স্পষ্ট দেখছি, পোকাগুলোর শরীর আর পোকার মতো নেই। অদ্ভুত এক ধরনের মানুষ হয়ে উঠেছে। পরিপক্ক ম্যাজেশিয়ানদের মতো। হাজার-হাজার পা নিয়ে ফুটবল খেলছে। হাজার-হাজার হাত নিয়ে জাগলিং করছে। সব অভিজ্ঞ দুরন্ত জাগলার যেন! ম্যাজিক দেখাচ্ছে। দেখতে হবেই। বাতেলা দিচ্ছে। শুনতে হবেই। সব শেষে হুমকি দিচ্ছে!
৭
একটা ভয়ের পরিবেশের মধ্যে থাকতে থাকতে ইমনও একসময় আরও ভয় পেয়ে চিৎকার করে ওঠে। আমি তাকিয়ে থাকি ওর শরীরের দিকে। ওর শরীরের লোমগুলো কাঁটার মতো দাঁড়িয়ে পড়েছে। ব্লাউজ আর শাড়ি ভেদ করে এক অদ্ভুত আকার নিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে....
গৌতম দে : বাংলাদেশের বিভিন্ন নামীদামী পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত গল্প কবিতা লেখেন। নিজেকে লিটিল ম্যাগাজিনের লেখক হিসেবে ভাবতেই ভালোবাসেন। দীর্ঘ ৩২ বছর সংবাদপত্রে চাকরি করেছেন। বেশ কিছু কবিতা ও গল্পের বই আছে। জন্ম: ০৭.০২.৫৯
সংকলনা- জয় ভদ্র, "হরপ্পা", "হাজার শতাব্দীর রূপকথা অথবা রাজনৈতিক বিষণ্ণতা", "ইডিকেস"-এর মতো বইয়ের লেখক তিনি, নয়ের দশকের শেষ লগ্ন থেকে লেখালেখি শুরু। "হরপ্পা" অনূদিত হয়েছে হিন্দি ভাষায়। এছাড়াও তার ছোটগল্পগুলো একসময় হিন্দি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ছিলেন এক বিশেষ পত্রিকার কার্যকরী সম্পাদক। একটা সময় মূলত সাংবাদিকতার সঙ্গে সঙ্গে চালিয়ে গিয়েছিলেন সাহিত্যকর্ম। এই মুহূর্তে পুরোপুরি সাহিত্যেই মনোনিবেশ করেছেন। গল্প, উপন্যাস যেমন তাঁর অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র তেমনি পুস্তক সমালোচনা এবং নাট্য-সমালোচক হিসাবেও সমাদৃত হয়েছেন।