সংক্ষিপ্ত

দক্ষযজ্ঞে সতী দেহত্যাগ করার পর মহাদেব তাণ্ডবনৃত্য শুরু করলে বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ ৫১ টি খণ্ডে টুকরো করলে তার মধ্যে ৫ টিই না-কি পড়েছিল আজকের বীরভূমে। লিখছেন অনিরুদ্ধ সরকার।
 

পুরাণ বলছে, দক্ষযজ্ঞে সতী দেহত্যাগ করার পর মহাদেব তাণ্ডবনৃত্য শুরু করলে বিষ্ণু তাঁর সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ ছেদ করতে শুরু করেন। সতীর দেহ টুকরো হয় ৫১ টি খণ্ডে। সতীর দেহাংশ যে যে স্থানে পড়েছিল সেই অঞ্চলগুলি "সতীপীঠ" হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এই ৫১টি দেহাংশের মধ্যে ৫ টিই না-কি পড়েছিল আজকের বীরভূমে।একনজরে দেখে নেওয়া যাক বীরভূমে সতীর দেহের কোন কোন অংশ পড়েছিল।


(১)কঙ্কালীতলা- দেবীর কঙ্কাল বিশেষত কোমর ও তার নিচের অংশ। 

(২)নলাটেশ্বরী- শ্বাসনালী সহ কণ্ঠনালী।

(৩)নন্দীকেশ্বরী- পার্বতীর গলার হার।

(৪)বক্রেশ্বর - 'মন'। 

(৫)ফুল্লরা - দেবীর ঠোঁটের নিচের অংশ। 

(১)কঙ্কালীতলা


পুরাণে উল্লিখিত ৫১ সতীপীঠের অন্যতম কঙ্কালীতলা। বীরভূমের বোলপুরে অদূরে অবস্থিত। পুরাণ বলছে, দক্ষযজ্ঞের পর দেবী পার্বতীর কঙ্কাল এই স্থানে পড়েছিল। তাই এই এলাকার নাম 'কঙ্কালীতলা'। এখানে দেবী দেবগর্ভা হিসেবে পূজিত। আর ভৈরবের নাম রুরু। প্রতি কালী পুজোয় অমাবস্যার রাতে এই মন্দিরে তান্ত্রিক রীতি মেনে শান্তি যজ্ঞ হয়ে থাকে। তন্ত্রচূড়ামণি মতে কঙ্কালীতলা ২৮ নম্বর সতীপীঠ। প্রাচীনকালে এই স্থান কাঞ্চী নামে প্রসিদ্ধ ছিল।তন্ত্রচূড়ামণিতেও এই স্থানের উল্লেখ আছে। পীঠনির্নয়তন্ত্র অনুসারে এখানে সতীর অস্থি পড়েছিল, সেকারণে এর নাম হয় কঙ্কালীতলা। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যগ্রন্থ অনুসারে এখানে সতীর কটিদেশ পড়েছিল।

(২)নলাটেশ্বরী


বীরভূমের   নলহাটী শহরের মধ্যভাগে অবস্থিত। দক্ষযজ্ঞের পর দেবী পার্বতীর শ্বাসনালী সহ কণ্ঠনালী এখানে পড়েছিল বলে  প্রচারিত। বলা হয় কামদেব স্বপ্নাদেশ পেয়ে সতীর সেই কণ্ঠনালী উদ্ধার করেন। ব্রাহ্মণী নদীর তীরে ললাট পাহাড়ের নিচে দেবীর বেদী প্রতিষ্ঠিত হয়। নাম হয় দেবী নলাটেশ্বরী। পরে প্রতিষ্ঠিত হয় মন্দির। দেবী এখানে কালিকা রূপে পূজিত হন। আর ভৈরব এখানে যোগেশ। । পুরাণ বিশেষজ্ঞদের মতে তন্ত্রে  উল্লিখিত নলাপাত থেকে এই নলাটেশ্বরী নামটি  এসেছে। দেবী  'পার্বতী'  নামেও তিনি পরিচিতা। বীরভূম- ঝাড়খণ্ড সংলগ্ন আদিবাসীদের জনগোষ্ঠীর কেউ কেউ আবার  মাকে   ' উর্মিলা', 'শেফালিকা'  নামেও  ডেকে থাকেন।  চারচালা  মন্দিরের  সামনে  প্রাচীন  স্থাপত্যের  কিছু  কিছু  নিদর্শন  এখনও  দেখা যায়।  মন্দিরের  গর্ভগৃহে  সিঁদুর আর তেলে ঢাকা  মা  নলাটেশ্বরী  বিরাজমান। 


(৩)নন্দীকেশ্বরী

বীরভূমের সাঁইথিয়া শহরের মধ্যভাগে অবস্থিত। নন্দীকেশ্বরী মন্দিরকে ঘিরে মিথ কিছু কম নেই। পুরাণে কথিত দেবী পার্বতীর গলার হার নাকি এই এলাকায় পড়েছিল। দেবী এখানে নন্দিনী হিসেবে পূজিত। ভৈরব এখানে নন্দীকেশ্বর।এই মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে সাধক বামাক্ষ্যাপার সিদ্ধিলাভের কাহিনী। পুরাণ মতে, সাধক বামাক্ষ্যাপা যখন তারাপীঠে সাধনা করছিলেন, একদিন তাঁকে স্বপ্নে দেখা দেন মা নন্দীকেশ্বরী। তাঁকে আদেশ দেওয়া হয়, একমাত্র এই রূপে মা-কে পুজো করলেই সিদ্ধিলাভ হবে। তারপর থেকে তিনি সাধনা শুরু করেন। 

(৪)বক্রেশ্বর


বক্রেশ্বর সম্পর্কে কথিত আছে, দক্ষযজ্ঞের পর মহাদেব যখন দেবী পার্বতীর মৃতদেহ নিয়ে ব্রহ্মাণ্ডে প্রলয়-নাচন শুরু করেছিলেন, তখন ভগবান বিষ্ণুর চক্রে খণ্ডিত সতীর ভ্রূণের মধ্যবর্তী অংশ বা 'মন' বক্রেশ্বরে পড়েছিল। সেই মিথকে কেন্দ্র করেই এখানে তৈরি হয়েছে মন্দির। তবে এর আগেও বক্রেশ্বরের উল্লেখ মিলেছে বিভিন্ন শাস্ত্রগ্রন্থে।

বক্রেশ্বরে আটটি কুণ্ড আছে, যেখানে সারা বছর চলে উষ্ণ প্রস্রবণ। বিশ্বাস করা হয় সেখানে স্নান করলে মুক্তি মেলে নানা রোগ থেকে। মন্দিরে স্থাপিত পিতলের দশভূজা মূর্তির নীচেই একটি গর্তের মধ্যে রয়েছে সতীর দেহাংশ-'মন'।

(৫)ফুল্লরা


বীরভূমের লাভপুরে অবস্থিত। পুরাণ বলছে ফুল্লরায় দেবীর ঠোঁটের নিচের অংশ পড়েছিল। দেবী এখানে ফুল্লরা নামে পূজিত। ভৈরবের নাম বিশ্বেশ বা বিশ্বেশ্বর।জনশ্রুতি, সাত-আটশো বছর আগে একদল বেদানুসারী ব্রাহ্মণ মিথিলা থেকে বিতাড়িত হয়ে বঙ্গদেশে আশ্রয় নেন। কেউ কেউ বলেন বিতাড়িত ব্রাহ্মণরা নাকি এসেছিলেন কণৌজ থেকে। তাঁরাই এই দেবীর পুজোর প্রচলন শুরু করেন। স্থানীয়দের মতে মহারাজ গ্রহবর্মারর প্রধান পুরোহিত ভবদেব ভট্ট নাকি নিজের উদ্যোগে প্রথম পুজো শুরু করেন। দেখতে দেখতে ফুল্লরা মন্দিরের পুজারীরা ফুল্লরা মন্দির সংলগ্ন ফুলিয়ানগর, অট্টহাস প্রভৃতি জনপদগুলিতে বসতি স্থাপন করেন। পরবর্তীকালে এই বাহ্মণ বংশেরই দীনমণি মিশ্র বাহাদুর বর্মণ রাজা হন।