সংক্ষিপ্ত
দেশবিভাগকে নিয়ে সাহিত্য রচনা সবচেয়ে বেশি হয়েছে ভারতবর্ষের পশ্চিম প্রান্তে— পঞ্জাবে। তাই সাদাত হোসেন মান্টো, খুশবন্ত সিং, কৃষণ চন্দর, মুন্সী প্রেম চন্দ, কর্তার সিং দুগগাল, খাজা আহমদ আব্বাস, ইসমত চুগতাই, মুলক রাজ আনন্দ, কালিন্দিচরণ পাণিগ্রাহী, অমৃতা প্রিতম, গুলজার সিং সন্দু, কুররাতুল আইন হায়দার-এর মতো দেশভাগ নিয়ে লেখা রচনাসম্ভার বাংলা সাহিত্য হয়তো পায়নি।
ভারতীয় ইতিহাসে দেশবিভাগ এক ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডি। শুধু সম্প্রদায়গত বিভাজনেই নয়, স্বাধীনতা ও মানবিক চেতনা বিভাজনেরও এক অমানবিক ইতিহাস হল দেশবিভাগ। দেশবিভাগের প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছিল ভারতবর্ষের দুই প্রান্তে – পূর্ব ও পশ্চিমে, অর্থাৎ বাংলা ও পাঞ্জাবে। ভারতবর্ষের এই দুই প্রান্তের মানুষ স্বাধীনতার স্বাদ নিয়েছেন ছিন্নমূল হয়ে এবং শরণার্থী শিবিরে চোখের জল ফেলে। এক জীবনে আশ্রয়চ্যুত হয়ে ‘নোঙরহীন নৌকোর মতো অনিশ্চিতের পথে’ চলা মানুষের নিজস্ব মাটি খোঁজার অভিজ্ঞতা ইতিহাসের পাতায় সেভাবে পাওয়া সম্ভব নয়, যেভাবে সাহিত্যের অঙ্গনে পাওয়া সম্ভব। কানাডার ম্যাকগ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর তরুণী আনাম তাঁর ‘ওরাল হিস্টরি’ বা ‘কথ্য ইতিহাস’ চর্চায় দেশভাগের ক্ষত ও যন্ত্রণাগুলোর প্রজন্ম-প্রজন্মব্যাপ্ত অভিজ্ঞতা লিখতে গিয়ে জানিয়েছেন, ‘সরকারি ইতিহাস ও পাঠ্যপুস্তকের ভাষ্যে সত্যের মূল বিন্দুটি অস্পষ্ট। ঘটনার মানবিক ছাপ কাগজের পাতায় আসেনি, যা এখনো অঙ্কিত রয়েছে রক্তস্নাত হৃদয়সমূহে।’ এই ‘রক্তস্নাত হৃদয়সমূহে’র কথাই উঠে আসে কাব্যে, উপন্যাসে, গল্পের পাতায়।
দেশবিভাগকে নিয়ে সাহিত্য রচনা সবচেয়ে বেশি হয়েছে ভারতবর্ষের পশ্চিম প্রান্তে— পঞ্জাবে। তাই সাদাত হোসেন মান্টো, খুশবন্ত সিং, কৃষণ চন্দর, মুন্সী প্রেম চন্দ, কর্তার সিং দুগগাল, খাজা আহমদ আব্বাস, ইসমত চুগতাই, মুলক রাজ আনন্দ, কালিন্দিচরণ পাণিগ্রাহী, অমৃতা প্রিতম, গুলজার সিং সন্দু, কুররাতুল আইন হায়দার-এর মতো দেশভাগ নিয়ে লেখা রচনাসম্ভার বাংলা সাহিত্য হয়তো পায়নি। কিন্ত, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, দেবেশ রায়, স্বপ্নময় চক্রবর্তী, আনোয়ার পাশা, আবু জাফর শামসুদ্দীন, আবুল ফজল, আবু ইসহাক, সত্যেন সেন, রাজিয়া খান, শহীদুল্লাহ কায়সার, আলাউদ্দিন আল আজাদ এবং পরবর্তী সময়ে হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শওকত আলী ও সেলিনা হোসেনের উপন্যাসেও দেশবিভাগের স্মৃতি ও ইতিহাস রূপায়িত হয়েছে বারবার।
অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের “নীলকণ্ঠ পাখীর খোঁজে” উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের এক অনবদ্য ক্লাসিক উপন্যাস। এই উপন্যাসে দেশবিভাগের বেদনা ও বাস্তবতাকে বাস্তব ও শিল্পস্মমতভাবেই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্র লেখকের কাছে থেকে দেখা বাস্তব ও জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা আর রঙে বৈচিত্র্যময়। নিজের দেশের মাটির লাবণ্য, গাছের ডালে-ডালে, ছায়ায়-ছায়ায়, পুকুরের পাড়ে-পাড়ে জীবনের যে-বন্দনা, সামসুদ্দিনের মায়ের বাতের ব্যথার জন্য শশীবালা ‘ঠাইরেন’-এর উদ্বেগে তেলের শিশি দেয়া, দু’দিন ধরে পেটে ভাত না-জোটা জোটন বিবির ধানক্ষেতের জলে ও আলের নরম মাটির আশ্রয়ে কচ্ছপের ডিম খোঁজা, শালুক তোলা, গাছতলায় সুপারি খোঁজা, আলকুশী লতার কাঁটার ঝোপ পেরিয়ে পানের পাতা ছেঁড়া, ফকির সাবের সামনে সানকির নুন মেশানো ফ্যান গলা ভাত, ফাওসার বিল, গজার মাছের আক্রমণ, তরমুজ ক্ষেতের সাদা জোৎস্নায় পৃথিবীর আদি মানব-মানবীর মতো দু’জন নর-নারীর ভেসে যাওয়া, সূর্যমুখী ঘা সারাবার বাসনায় ফেলুর জোনাকি ধরা এইসব দৃশ্যপট পড়তে পড়তে লেখকের অন্তর্ভেদী দৃষ্টির প্রতিফলন যেমন ধরা পড়ে, তেমনি বাংলাদেশের বাস্তব মাটির দৃশ্য কাব্যময় হয়ে ওঠে উপন্যাসটিতে।
দেশবিভাগের এক দশক পরেও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, সম্পত্তি লুঠ, ডাকাতি, বাড়ির মেয়ে-বউদের শ্লীলতাহানি বা ধর্ষণ ইত্যাদির কথা আছে প্রফুল্ল রায়-এর “কেয়া পাতার নৌকা” উপন্যাসে। এই উপন্যাসের বিনু ও ঝিনুক অন্যতম চরিত্র হিসেবে বাঙালি পাঠকের হৃদয়ে ঠাই করে নিয়েছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের “পূর্ব পশ্চিম” উপন্যাসেও দেশবিভাগের চিত্র এক অনন্য মাত্রা লাভ করেছে। অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরেক উপন্যাস “ঈশ্বরের বাগানে”র শেষে মুরশেদ নামে এক পশ্চিম পাকিস্তানি সেনানী এক পশ্চিম পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনের দ্বারা দিনের পর দিন যৌন নির্যাতিতা মঞ্জুর প্রাণ রক্ষা করেন এবং মঞ্জুর বাড়িতেই আবার পরে দলত্যাগী হয়ে আত্মগোপন করেছিলেন। এই মুরশেদ ফের জোড়া লাগা এক অবিভক্ত ভারতবর্ষের কথা বলেছিল মঞ্জুর আশ্রিতা ও সমভাবে নির্যাতিতা কেয়াকে।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের “খোয়াবনামা” উপন্যাসে দেশভাগ-সহ স্বাধীনতা লাভের সময়েও পূর্ববঙ্গের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের প্রবীণ ও সম্পন্ন মুসলমানরা সমাজে প্রতিষ্ঠিত বা মুরব্বি গোছের হিন্দুদের কথা মেনে চলতেন, যদিও পাকিস্তানপন্থী মুসলমান নব্য যুবকেরা তখন ঘোর হিন্দু-বিরোধী অবস্থান নিয়েছিল। এই উপন্যাসে ১৯৪৬-এর দাঙ্গার প্রতিফলন ঘটেছে গিরিরডাঙা, লাঠিডাঙা, গোলাবাড়ির হাট প্রভৃতি গ্রামগুলির বাস্তব চিত্রায়নে। সমরেশ বসুর ‘খণ্ডিতা’ উপন্যাসে স্বাধীনতা লাভের আগের দিন থেকে ঔপন্যাসিক ঘটনাপ্রবাহের শুরু, আর স্বাধীনতা অর্জনের কয়েক দিন পর পর্যন্ত এর বিস্তৃতি। তিন বন্ধু সতু, বিজু ও গোরা রেলে চেপে পূর্ব পাকিস্তানে চলে যায়– নতুন দেশ দেখতে। এদের কথোপকথন আর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রচিত হয়েছে উপন্যাসের মূল ভিত্তি। এই আলোচিত উপন্যাসগুলি ছাড়াও আরও কিছু উপন্যাসের কথা বলব, যেখানে দেশভাগ, স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত আগে ও পরের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও উদ্বাস্তু সমস্যার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ধারাবাহিক অনুষঙ্গ পাওয়া যায়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের “সার্বজনীন” (১৯৫২), অমরেন্দ্র ঘোষ-এর “ভাঙছে শুধু ভাঙছে”(১৯৫০), নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়-এর “বিদিশা”, গোলাম কুদ্দুস-এর “মরিয়ম”(১৯৫৬), শহীদুল্লাহ কায়সার-এর “সংশপ্তক” (১৯৬৫), আবু রুশদ-এর “নোঙ্গর”(১৯৬৭), আবু জাফর শামসুদ্দিন-এর “পদ্মা মেঘনা যমুনা” (১৯৭৪), অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়-এর “মানুষের ঘরবাড়ি” (১৯৭৮), শঙ্খ ঘোষ-এর “সুপরি বনের সারি” (১৯৯০), কিংবা এ-কালের মাহ্মুদুল হক-এর “কালো বরফ” (১৯৯২), সেলিনা হোসেন-এর “গায়ত্রী সন্ধ্যা” (১৯৯৬), “যাপিত জীবন” (১৯৯৬), প্রফুল্ল রায়ের “ভাগাভাগি” (২০০১), শান্তা সেন-এর “জন্মের মাটি” প্রভৃতি উপন্যাসে দেশবিভাগের চিত্রকে নানা অনুসঙ্গ আর চরিত্রের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
সাইদুর রহমান : পেশা শিক্ষকতা। বিভিন্ন প্রিন্ট, অনলাইন, পোর্টাল পত্রিকা ও বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে নিয়মিত প্রবন্ধ, নিবন্ধ, কলাম, উত্তর সম্পাদকীয়, ছোটোগল্প লিখে থাকেন। সম্পাদনা করেন “অতঃপর...” নামে একটি লিটল ম্যাগাজিন। উল্লেখ্যোগ্য সম্পাদনা— ‘নারীর আধুনিকতা’, ‘মানবতাবাদ’, ‘সাহিত্য সংস্কৃতিতে দেশবিভাগের প্রভাব’, ‘লিটল ম্যাগাজিন’, ‘বাংলা সাময়িক পত্রের দুশো বছর’ ইত্যাদি। উল্লেখযোগ্য গবেষণা— ‘ভারতীয় সাহিত্যে দেশবিভাগের প্রভাব’, ‘আধুনিক সভ্যতায় নারীর অবদান’, ‘মুসলিম পত্রপত্রিকায় নজরুল বিরোধিতা’।
সংকলনা- জয় ভদ্র, "হরপ্পা", "হাজার শতাব্দীর রূপকথা অথবা রাজনৈতিক বিষণ্ণতা", "ইডিকেস"-এর মতো বইয়ের লেখক তিনি, নয়ের দশকের শেষ লগ্ন থেকে লেখালেখি শুরু। "হরপ্পা" অনূদিত হয়েছে হিন্দি ভাষায়। এছাড়াও তার ছোটগল্পগুলো একসময় হিন্দি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ছিলেন এক বিশেষ পত্রিকার কার্যকরী সম্পাদক। একটা সময় মূলত সাংবাদিকতার সঙ্গে সঙ্গে চালিয়ে গিয়েছিলেন সাহিত্যকর্ম। এই মুহূর্তে পুরোপুরি সাহিত্যেই মনোনিবেশ করেছেন। গল্প, উপন্যাস যেমন তাঁর অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র তেমনি পুস্তক সমালোচনা এবং নাট্য-সমালোচক হিসাবেও সমাদৃত হয়েছেন।