কর্কশ বা তীব্র শব্দের অ্যালার্মে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে তা কেবল দিনের শুরুতেই বিরক্তি সৃষ্টি করে না, বরং আপনার মস্তিষ্কের ওপরও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।

রাতের শেষে ভোর। চারপাশ তখনও আধো অন্ধকার। মোবাইলের স্ক্রিন নিভে আছে। হঠাৎ— ট্রিঁন! ট্রিঁন! ট্রিঁন! একটা তীব্র শব্দ কানে এসে ধাক্কা মারে। চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে বসি। দিনের শুরু হয় অস্থিরতার মধ্যেই। এই দৃশ্য কোটি মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অংশ। কিন্তু প্রশ্ন হল—এই তীব্র শব্দে জেগে ওঠা কি সত্যিই শরীরের জন্য নিরাপদ? নাকি প্রতিদিন অজান্তেই আমরা এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করছি, যার প্রভাব শরীর-বিশেষ করে মস্তিষ্ক ও হৃদযন্ত্র—উভয়ের ওপর পড়ছে? বিশেষজ্ঞদের মতে, হঠাৎ অ্যালার্মের শব্দে ঘুম ভাঙা আমাদের স্নায়ুতন্ত্রকে এমন এক অবস্থায় ঠেলে দেয়, যাকে শরীর ‘স্বাভাবিক’ বলে গ্রহণ করে না। আর সেখান থেকেই শুরু হয় স্ট্রেসের সূক্ষ্ম আক্রমণ।

ঘুম ভাঙার সেই প্রথম মুহূর্তেই কী ঘটে?

মানুষ যখন গভীর ঘুমের পর্যায়ে থাকে, শরীরের প্রতিটি অঙ্গ তখন পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় ব্যস্ত থাকে। শ্বাস-প্রশ্বাস ধীরে, হার্ট রেট নিয়ন্ত্রিত, মস্তিষ্ক বিশ্রাম নিচ্ছে। এই সময় তীব্র শব্দে জাগিয়ে তোলা শরীরের ভেতর একটি সরাসরি ঝাঁকুনি পাঠায়।

• স্ট্রেস রেসপন্স সক্রিয় হয় মস্তিষ্ক আকস্মিক শব্দকে বিপদ সংকেত হিসেবে ধরে। যেন বাইরে আগুন লেগেছে বা ঘরে অনুপ্রবেশকারী ঢুকেছে। সঙ্গে সঙ্গে ‘ফাইট অর ফ্লাইট’ প্রতিক্রিয়া চালু হয়।

• স্ট্রেস হরমোন বাড়ে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই কর্টিসল ও অ্যাড্রেনালিন বেড়ে যায়। ফল—হার্ট রেট বাড়ে, রক্তচাপ লাফিয়ে ওঠে।

এই প্রতিক্রিয়াগুলো যদি মাঝে মাঝে ঘটে, সমস্যা নেই। কিন্তু প্রতিদিন ঘটে গেলে শরীরের ভেতর সাবধানী সিগন্যাল জ্বলে ওঠা উচিত।

স্লিপ ইনারশিয়া: ঘুম ভাঙার পর ঝিমঝিম অবস্থা কেন?

অ্যালার্ম বন্ধ করার পর আমরা অনেকেই লক্ষ্য করি— মাথা ভার, মনোযোগ কম, শরীর যেন পুরোপুরি চলছে না। এই অবস্থাকে বলে Sleep Inertia। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, আচমকা জাগিয়ে দিলে মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে ‘অন’ মোডে যায়। এই সময়ে— • চিন্তাশক্তি কম কাজ করে • স্মৃতিশক্তি সাময়িকভাবে মন্থর হয় • দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা হয় • প্রতিক্রিয়ার গতি কমে যায়

এ অবস্থাকে কাটতে সময় লাগে ১৫ মিনিট থেকে ৬০ মিনিট পর্যন্ত। অফিসে সকালের ভুল, মনোযোগের ঘাটতি অনেক ক্ষেত্রেই এই কারণেই হয়।

স্মৃতি ও মস্তিষ্কের ওপর প্রভাব

গভীর ঘুম ও REM ঘুম মস্তিষ্কের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ে— • স্মৃতি জমা হয় • শেখা বিষয় মস্তিষ্কে স্থায়ী হয় • নিউরোন সংযোগ তৈরি হয়

কিন্তু তীব্র অ্যালার্মে বারবার REM ঘুম ভাঙলে এই প্রক্রিয়ায় বাধা তৈরি হতে পারে। অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত ব্যাঘাত স্মৃতিশক্তি দীর্ঘমেয়াদে দুর্বল করতে পারে।

মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব

প্রতিদিনের অ্যালার্ম সন্ত্রাস—শরীরকে উচ্চ সতর্কতায় শুরু করতে বাধ্য করে। তাই— • সারাদিন উদ্বেগ বাড়ে • মেজাজ খিটখিটে হয় • মনোযোগ দীর্ঘ সময় ধরে থাকে না • স্ট্রেস হরমোন দীর্ঘমেয়াদে বেশি থাকে

এগুলো ধীরে ধীরে মানসিক ক্লান্তি ও বার্নআউটের ঝুঁকি বাড়ায়।

হার্টের জন্য লুকোনো হুমকি

হঠাৎ অ্যালার্মে জেগে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে হৃদস্পন্দন এবং রক্তচাপ বদলে যাওয়ার প্রভাব দীর্ঘদিনে হৃদযন্ত্রের ওপর চাপ তৈরি করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, স্ট্রেস হরমোন সকালের দিকেই যদি উচ্চমাত্রায় থাকে, তা— • হৃদরোগের ঝুঁকি • স্ট্রোকের সম্ভাবনা • রক্তচাপ অস্বাভাবিক ওঠানামা —সবই বাড়িয়ে দিতে পারে।

যদিও এটি ‘অবশ্যই ক্ষতি করবে’ এমন নয়, তবে ঝুঁকির দিকটি অস্বীকার করা যায় না।

তাহলে সমাধান কোথায়? স্বাস্থ্যকরভাবে জাগানো কি সম্ভব?

হ্যাঁ। খুব সহজ কয়েকটি পরিবর্তনেই ঝুঁকি কমানো যায়।

১. নরম সুর ও ধীরে বাড়ে এমন অ্যালার্ম ব্যবহার করুন হঠাৎ উচ্চ শব্দ নয়—ধীরে ধীরে ওঠা সুর শরীরকে কম চাপ দেয়।

২. “সানরাইজ অ্যালার্ম” বা আলোভিত্তিক অ্যালার্ম এই ঘড়িগুলো ধীরে ধীরে ঘর আলোকিত করে, প্রাকৃতিক সূর্যোদয়ের মতো। এতে স্ট্রেস কম হয়।

৩. নিয়মিত ঘুমের সময় বজায় রাখুন ভাল ঘুম হলে শরীর অনেক সময় স্বয়ংক্রিয়ভাবে জেগে ওঠে। অ্যালার্ম চাপ কমে।

৪. ঘুমানোর আগে মোবাইল, ক্যাফেইন কমান ঘুমের মান বাড়লে হঠাৎ জাগরণের ধাক্কাও কম লাগে।

অ্যালার্ম ঘড়ি আধুনিক জীবনের প্রয়োজনীয় অংশ। কিন্তু কোন ধরনের অ্যালার্ম, কেমন শব্দ, কোন অভ্যাস—এসবের ওপরই নির্ভর করে আমরা প্রতিদিন সকালে শরীরকে স্ট্রেস দেব নাকি স্বাভাবিকভাবে দিন শুরু করবো। হঠাৎ শব্দে ঘুম ভাঙা সরাসরি মস্তিষ্ক নষ্ট করে না— কিন্তু প্রতিদিনের ক্রমাগত চাপ শরীরকে ধীরে ধীরে ক্লান্ত করে তুলতে পারে। ব্যস্ততার মধ্যে ছোট একটি পরিবর্তনই দিতে পারে বড়ো উপকার। নরম অ্যালার্ম, নিয়মিত ঘুম—এতেই অনেকটাই নিরাপদ থাকবেন আপনি এবং আপনার মস্তিষ্ক।