সংক্ষিপ্ত
১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টের সেই সকালটি খুব বিশেষ ছিল, সর্বত্র স্বাধীনতা উদযাপনের পরিবেশ ছিল। বন্দে মাতরম ধ্বনিত হচ্ছিল। মজার ব্যাপার হল ওই দিন মানুষ বাসের টিকিটও কাটতে অস্বীকার করেছিল, তার যুক্তি ছিল বাসটি ব্রিটিশদের নয়, আমাদের।
দেশ স্বাধীনের ৭৬ বছর পূর্ণ করেছে। অর্থাৎ স্বাধীন ভারতে জন্ম নেওয়া মানুষের বয়সও অন্তত ৭৫ বছর। কিন্তু, স্বাধীনতার এই দিনটি তাদের বৃদ্ধ হতে দেয় না। ১৪ আগস্ট থেকে ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট সন্ধ্যা পর্যন্ত দেশটি যে উদ্দীপনা, আবেগ, আনন্দ অনুভব করেছিল তা আজও সহজেই বোঝা এবং অনুভব করা যায়। ১৫ আগস্ট যতই এগিয়ে আসে, দেশ এক অন্যরকম আবেশে নিমগ্ন হতে থাকে। হয়তো এটাই দেশের প্রতি ভালোবাসা। আমাদের মাটির প্রতি শ্রদ্ধা।
আজকের পরিস্থিতি দেখে খুব সহজেই অনুমান করা যায় যে সেদিন দেশ ও দেশের প্রাণকেন্দ্র দিল্লির দৃশ্য কী ছিল। দেশের সর্বত্রই যে আনন্দ ছিল তা নয়। সমস্যাও ছিল। হিন্দু-মুসলিমের দাঙ্গা হতো, দারিদ্র্য ছিল।,ক্ষুধা ছিল। স্বাধীনতার ঘোষণা সত্ত্বেও, দেশের অভ্যন্তরে তিনটি রাজ্য হায়দ্রাবাদ, ভোপাল এবং কাশ্মীর ভারতের অংশ হয়ে ওঠেনি। জম্মু ও কাশ্মীর ১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর এবং ১৯৪৯ সালের ১ জুন ভোপাল ভারতের অংশ হয়। হায়দরাবাদের কাহিনী সর্বজনবিদিত যে, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল কীভাবে সেনাবাহিনী পাঠিয়ে নিজামকে নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন।
দেশ এক অন্যরকম উচ্ছ্বাসে নিমজ্জিত হয়েছিল
এতদসত্ত্বেও দেশ এক অন্যরকম উচ্ছ্বাসে ডুবে গেল। বৃদ্ধ, প্রবীণ এবং শিশুরা সবাই মুক্ত হাওয়ার প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিত, নিজেদের মধ্যে স্বাধীনতা অনুভব করতে, একে অপরের সঙ্গে দেখা করতে এবং আনন্দ ভাগাভাগি করতে বদ্ধপরিকর ছিল। দিল্লিতে, ইন্ডিয়া গেট এবং লাল কেল্লায় তিল রাখার জায়গা ছিল না। মানুষ সাইকেল, গাড়ি, গরুর গাড়ি, রিকশা, টাঙ্গা, ট্রাক, বাস ও ট্রেনে চড়ে দিল্লিতে প্রবেশ করছিল। বাসে ট্রেনের ছাদে ও জানালায় ঝুলে দেশবাসীকে দিল্লির দিকে আসতে দেখা গিয়েছিল সে সময়ে।
গ্রাম হোক, শহর হোক সবখানেই ছিল এই পরিবেশ। মহিলারা নতুন শাড়ি পরেন এবং পুরুষদের নতুন পাগড়ি পরে দিল্লিতে উদযাপন করতে দেখা যায়। কারও কোলে, কারও কাঁধে শিশুরাও শামিল হয়েছিল এই উদযাপনে। অনেক জায়গায় মানুষ বাসে টিকিট কিনতে অস্বীকার করেছে। যুক্তি ছিল বাসটি আমাদের, ব্রিটিশদের নয়। প্রত্যেকের জন্য স্বাধীনতার নিজস্ব অর্থ ছিল।
দেশবাসী স্লোগানে মুখরিত হয়েছিল দিল্লি
সেই সময়ে পতাকার মহিমা দেখা গিয়েছিল, স্বাধীনতার আনন্দ এবং চোখে যে উজ্জ্বলতা দেখা গিয়েছিল, তা বিস্ময়কর ছিল এবং আজও রয়েছে। ১৪/১৫ তারিখ রাতে ইন্দ্রদেবও খুশি হলেন। নেহেরু যখন গণপরিষদে ভাষণ দিচ্ছিলেন, হাজার হাজার দেশবাসী বাইরে স্লোগান দিচ্ছিল। আনন্দে নাচছিলেন, বন্দে মাতরম ও জন গণ মনের সুরে নাচছিলেন, তখন ইন্দ্রদেবও আনন্দে বর্ষণ করছেন। সারা রাত ছিল উৎসবমুখর পরিবেশ।
যে রাতে নেহেরু আজকের রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে দেশের উদ্দেশে ভাষণ দিচ্ছিলেন, সেই রাতেই কলকাতায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা ধীরে ধীরে শান্ত হচ্ছিল। ১৪/১৫ আগস্ট রাতে পন্ডিত নেহরুর বক্তৃতাও তারা শোনেনি। ১৪ আগস্ট সন্ধ্যায় সরকারি দফতর থেকে ব্রিটিশ সরকারের পতাকাগুলো ধীরে ধীরে নামতে থাকে। ব্রিটিশ সৈন্যরা ব্যারাকে যাচ্ছিল। রাজেন্দ্র লাল হান্ডা তার দিল্লি বইয়ে দশ বছরে ১৪ আগস্ট রাতের ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছেন। তিনি লিখেছেন- ''রাত দুইটা বাজে। গণপরিষদ ছেড়ে ভাইসরয়ের উদ্দেশ্যে নেহেরুজি ভাইসরয় ভবনে যাচ্ছিলেন, ভিড় তাঁকে অনুসরণ করল। কেউ জানে না কি হচ্ছে। তিনি যখন লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে ফিরে আসেন, তখন জনতা স্লোগান দিচ্ছিল। হান্ডার কথায় সবকিছুই ছিল অনন্য- অনন্য অনুষ্ঠান, অনন্য দৃশ্য, অনন্য দেশপ্রেম, অনন্য ভিড় এবং অনন্য উদ্দীপনা।''
ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খান-এর শানাই-এর সুরে মেতে উঠেছিল দেশ-
১৫ আগস্ট সকালে পন্ডিত নেহরুর অনুরোধে ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খান যখন স্বাধীন ভারতে সূর্যের প্রথম রশ্মিকে স্বাগত জানালেন তাঁর দলবল নিয়ে শানাই বাজিয়ে, তখন বোঝা মুশকিল ছিল কে কাকে স্বাগত জানাচ্ছে। সেখানে তখন কেউ ধনী নয়, কেউ গরীব নয়, সবাই একে অপরকে এক সংযুক্ত পরিবার হিসেবে একত্রিত হয়েছিল। সেই দৃশ্য দেখার মত ছিল। স্বাধীনতার খুশি উপলক্ষ্যে অনেক ফাঁসি মাফ করা হয়। সাজাপ্রাপ্ত বন্দীদের মুক্তি দেওয়া হয়। সিমলায়, লোকেরা মল রোডে দৌড়েছিল, যেখানে তাদের যেতে দেওয়া হয়নি। সেদিন সকালে লাল কেল্লা থেকে জামা মসজিদ, দিল্লি গেট, কাশ্মীরি গেট, ইন্ডিয়া গেট পর্যন্ত যে ভিড় দেখা গিয়েছিল, তার আগে কোনও দিন বা এত বছর পরেও সেই ভীড় আর হয়নি। বরং ভবিষ্যতে তা আরও কমতে দেখা গিয়েছে।
কোন সোনার দেশে জন্ম নিয়েছি আমরা
স্বাধীনতার সেই মুহূর্তগুলি ডমিনিক ল্যাপিয়ের এবং ল্যারি কলিন্সের বই ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট, ফিলিপ ট্যালবটের বই অ্যান আমেরিকাস উইটনেস টু ইন্ডিয়াস পার্টিশন সহ আরও অনেক বইতে সংরক্ষিত হয়েছে। যা পড়লে যে কোনও ভারতীয় গর্বে বুক ভরে উঠবে যে, কোন সোনার দেশে জন্ম নিয়েছি আমরা। শেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেনের কন্যা পামেলাও তাঁর কথায় এই ব্যক্ত করেছিলেন, যা পরে একটি বই আকারে প্রকাশিত হয়েছিল।
মাউন্টব্যাটেনের দেহরক্ষীর ঘোড়া মাটিতে লুটিয়ে পড়ে
১৫ আগস্ট সন্ধ্যায় ইন্ডিয়া গেটে পতাকা উত্তোলন করার কথা ছিল। শেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেনও আসার কথা ছিল। অফিসাররা আনুমানিক ৩০ হাজার ভিড় করেছিলেন, তবে পাঁচ লাখের বেশি লোক সেখানে পৌঁছেছিল। ভিড়ের চাপে মাউন্টব্যাটেনের দেহরক্ষীর ঘোড়া মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। অফিসাররা ভয় পেয়ে গেলেও কিছুক্ষণ পর ঘোড়াটি আপনা থেকেই উঠে পড়ে।
জাতিসংঘের সংস্থাও প্রথম তেরঙ্গা উত্তোলন করে
ভারতের স্বাধীনতা শুধু দেশেই পালিত হচ্ছিল না। নিউইয়র্কে অবস্থিত জাতিসংঘের সংস্থাও একই দিনে স্বাধীন ভারতকে মেনে নিয়ে তেরঙ্গা উত্তোলন করে। এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ সত্য যে, সেদিন লাল কেল্লায় পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল কিন্তু জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করা হয়নি, যদিও জাতীয় সঙ্গীত এবং জাতীয় স্তোস্ত্র তখনও মানুষের মুখে ছিল কিন্তু তা জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে গৃহীত হয়েছিল। ১৯৫০ সালে, তারপর থেকে যখনই তেরঙ্গা উত্তোলন করা হয়, আমরা গর্বের সঙ্গে জাতীয় সঙ্গীত গাই। সেই নিয়ম আজও বদলায়নি।
ভিরে তিল রাখার জায়গা ছিল না
১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট, যেখানে লাল কেল্লায় তিল রাখার জায়গা ছিল না। একই সঙ্গে নিরাপত্তা ও নিয়মতান্ত্রিক কারণে এই জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত অতিথির সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়। যদিও এই নিয়মগুলি প্রতি বছর পরিবর্তিত হয়। এই বছরের জন্য সারাদেশ থেকে তাদের পরিবার-সহ ১৮০০ জন বিশেষ অতিথিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
এর মধ্যে ভাইব্রেন্ট ভিলেজের সঙ্গে যুক্ত ৪০০ জন কৃষক, কৃষক প্রযোজক সংস্থার ২৫০ জন, পিএম কিষান সম্মান নিধি এবং পিএম কৌশল বিকাশ যোজনার ৫০ জন এবং সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ৫০ জন শ্রম যোগীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। ১৭ হাজার ই-ইনভাইটেশন কার্ডও ইস্যু করা হয়েছে। এভাবে লাল কেল্লার এই অনুষ্ঠানে প্রায় ২৫ হাজার মানুষ অংশ নেবেন। কোভিডের সময় এই সংখ্যা ছিল পাঁচ হাজারের মধ্যে। ইন্দিরা গান্ধীর হত্যার পর প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে পুলিশ বেশ কিছু সতর্কতামূলক পদক্ষেপের কারণে সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। এর আগে কড়া ব্যবস্থা ছিল না, তাই পাস ছাড়া মানুষও আসতেন।