সংক্ষিপ্ত
নবজাতকের জন্ডিস কেন হয়? রইল এই রোগের প্রধান কারণ, লক্ষণ এবং চিকিৎসা
দেশে জন্ডিসে আক্রান্তদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। জন্ডিসকে কখনোই হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয়। জন্ডিস এমন একটি রোগ যা মানুষের জীবন কেড়ে নিতে পারে। জন্ডিস দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার এই পরিস্থিতিতে জন্ডিস সম্পর্কে আরও জানা গুরুত্বপূর্ণ। লিভারকে আক্রান্ত করে এমন একটি প্রধান রোগ হল হেপাটাইটিস বা জন্ডিস। 'সিরিয়াস জন্ডিস' সিরিজে নবজাতকের জন্ডিস কীভাবে প্রতিরোধ করা যায় সে সম্পর্কে লেখাটি লিখেছেন এর্নাকুলাম ভিপিএস লেকশোর হাসপাতালের গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিস্ট এবং হেপাটোলজিস্ট ডাঃ মায়া পীতাম্বরন।
নবজাতকের জন্ডিস একটি সাধারণ ঘটনা। তবে কিছু শিশুর ক্ষেত্রে এটি গুরুতর জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। এটি প্রায়শই বাবা-মায়েদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করে। নবজাতকের জন্ডিস নিয়ে আমাদের কি ভয় পাওয়া উচিত?
জন্ডিস কী?
রক্তে বিলিরুবিন নামক হলুদ রঞ্জক পদার্থের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়াকে জন্ডিস বলে। শরীরে লোহিত রক্তকণিকা ভেঙে গেলে হিমোগ্লোবিন ভেঙে বিলিরুবিন তৈরি হয়। নবজাতকের লোহিত রক্তকণিকার সংখ্যা বেশি থাকে। তাছাড়া এগুলি দ্রুত ভেঙে যায়। নবজাতকের লিভারও পুরোপুরি কার্যকর নয়। তাই বিলিরুবিন দক্ষতার সাথে প্রক্রিয়াকরণ করা যায় না। এই কারণেই নবজাতকের জন্ডিস হয়।
ফিজিওলজিক্যাল জন্ডিস কী?
নবজাতকের ক্ষেত্রে উপরোক্ত কারণে জন্মের দুই-তিন দিন পর চোখে ও মুখে হালকা হলুদ দেখা যায়। এটি চার-পাঁচ দিন পর্যন্ত বাড়তে থাকে এবং সাত থেকে দশ দিনের মধ্যে জন্ডিস অদৃশ্য হয়ে যায়। এই সময়ে শিশু ভালোভাবে দুধ পান করে এবং হলুদ বর্ণের মল ত্যাগ করে। এ নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, এর কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন নেই।
প্যাথলজিক্যাল জন্ডিস
নবজাতকের ক্ষেত্রে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বিলিরুবিন পাওয়া গেলে তা সমস্যা। শিশুর ওজন, জন্মের পর থেকে কত দিন ইত্যাদি বিবেচনা করে গ্রাফ দেখে বিলিরুবিন বেশি কিনা তা নির্ধারণ করা হয়, শুধুমাত্র মাত্রা দেখে নয়।
প্যাথলজিক্যাল জন্ডিসের কারণ
১. বুকের দুধের জন্ডিস: বুকের দুধ খাওয়া শিশুরা পর্যাপ্ত দুধ না পেলে এটি হতে পারে।
২. আরএইচ অসঙ্গতি (রক্তের গ্রুপের অমিল): মা নেগেটিভ গ্রুপের এবং শিশু পজিটিভ গ্রুপের হলে বিলিরুবিনের মাত্রা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে।
৩. এবিও অসঙ্গতি: মা ও গ্রুপের এবং শিশু এ বা বি গ্রুপের হলেও বিলিরুবিনের মাত্রা অনেক বৃদ্ধি পেতে পারে।
৪. সংক্রমণ: কিছু সংক্রমণ জন্ডিসের কারণ হতে পারে।
৫. হাইপোথাইরয়েডিজম (Congenital Hypothyroidism): থাইরয়েড হরমোনের ঘাটতি।
৬. কেফাল হেমাটোমা (Cephalhematoma): প্রসবের সময় সৃষ্ট ছোটখাটো আঘাতের কারণে মাথার খুলিতে রক্ত জমাট বাঁধলেও এটি হতে পারে।
জন্ডিস কীভাবে মারাত্মক হয়?
রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা খুব বেশি বেড়ে গেলে তা মস্তিষ্কে প্রবেশ করে স্নায়ুকোষ ধ্বংস করে। এটি কার্নিকটেরাস নামক একটি অবস্থার সৃষ্টি করে। এর ফলে শিশুর সেরিব্রাল পালসি, বধিরতা, মানসিক প্রতিবন্ধকতা, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।
জন্ডিসের চিকিৎসা
বেশিরভাগ নবজাতকের ক্ষেত্রেই ফিজিওলজিক্যাল জন্ডিস জন্ডিসের কারণ। এর কোনো বিশেষ চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। তবে বিলিরুবিনের মাত্রা খুব বেশি হলে চিকিৎসার প্রয়োজন। জন্ডিসের তীব্রতার উপর নির্ভর করে কোন চিকিৎসা দেওয়া হবে তা নির্ধারণ করা হয়।
* ফটোথেরাপি (আলোক চিকিৎসা): কিছু বিশেষ আলো ব্যবহার করে বিলিরুবিন ভেঙে ফেলার চিকিৎসা। কিছু বিশেষ অতিবেগুনী রশ্মি শিশুর ত্বকে পড়ে। এটি বিলিরুবিনকে ভেঙে অন্য আকারে পরিণত করে এবং এভাবে তা শরীর থেকে বের হয়ে যায়। এটি একটি খুব কার্যকর চিকিৎসা। শিশুকে দুধ খাওয়ানোর সময় ছাড়া সারাক্ষণ ফটোথেরাপির আওতায় রাখতে হয়।
*এক্সচেঞ্জ ট্রান্সফিউশন: বিলিরুবিনের মাত্রা খুব বেশি বেড়ে গেলে এবং মস্তিষ্ককে আক্রান্ত করার সম্ভাবনা থাকলে, ফটোথেরাপি কার্যকর না হলে এটি করা হয়। নাভির মাধ্যমে শিশুর রক্ত বের করে নেওয়া হয় এবং বদলে রক্ত দেওয়া হয়।
শিশুদের রোদে রাখলেই কি জন্ডিস সেরে যাবে?
সূর্যের আলোতে প্রায়শই ক্ষতিকারক রশ্মি থাকে এবং এটি ফটোথেরাপির মতো কার্যকর নয়। তাই এটি এড়িয়ে চলা উচিত।
জন্ডিস কীভাবে প্রতিরোধ করা যায়?
১. সঠিকভাবে বুকের দুধ খাওয়ানো: শিশু পর্যাপ্ত দুধ পাচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করুন।
২. রক্তের গ্রুপের অমিল পরীক্ষা করা: মা এবং শিশুর রক্তের গ্রুপের মধ্যে কোনো অমিল আছে কিনা তা পরীক্ষা করুন।
৩. নিয়মিত পরীক্ষা: জন্মের পরপরই শিশুকে জন্ডিসের জন্য পরীক্ষা করুন। জন্ডিসের লক্ষণগুলি আগেভাগেই শনাক্ত করলে প্রয়োজনে চিকিৎসা শুরু করা যায়।
নবজাতকের অন্য কোনো কারণে জন্ডিস হতে পারে কি?
পিত্তনালীতে জন্মগতভাবে বাধা থাকলে (বিলিয়ারি আট্রেসিয়া) শিশুদের জন্ডিস হতে পারে। জন্ডিস দুই সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হলে, শিশুর প্রস্রাব হলুদ বর্ণের হলে, বা শিশুর মল মাটির রঙের হলে, এটি একটি সমস্যা। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিশুকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। নবজাতকের জন্ডিস সাধারণ হলেও এটি গুরুতর সমস্যার কারণ হতে পারে। তাই জন্ডিসের লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন।