বিজ্ঞানের অগ্রগতি এখন পাওয়ার আসা চোখকেও চশমা মুক্ত করে তুলতে পারে। নাকের ডগায় ভারী মাইনাস পাওয়ারের চশমা আপনি বিধায় খুলে ফেলতে পারবেন। কলকাতাতেও মিলছে এই সমস্ত সার্জারি হদিশ।
সারাদিন চশমা পড়া এখন অনেকের কাছেই বিরক্তির কারণ। সৌন্দর্য, পেশাগত প্রয়োজন কিংবা জীবনযাত্রার সুবিধার কারণে অনেকেই চশমা ছাড়ার কথা ভাবছেন। আধুনিক প্রযুক্তির চোখের সার্জারি সেই স্বপ্নকে বাস্তব করে তুলছে। আর এইসব উন্নত প্রযুক্তি এখন আর কেবল বেঙ্গালুরু, হায়দ্রাবাদেই সীমাবদ্ধ নয়— কলকাতাতেই পাওয়া যাচ্ছে আন্তর্জাতিক মানের লেজার চক্ষু অস্ত্রোপচার। তবে এই প্রযুক্তির সুবিধার সঙ্গে রয়েছে কিছু সীমাবদ্ধতাও। কার জন্য কোন পদ্ধতি উপযুক্ত, খরচ কত, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কী হতে পারে— সব কিছু নিয়েই বিস্তারিত আলোচনা দেওয়া হলো এশিয়ানেটের পাতায়।
চশমা পরলে দেখতে ভাল লাগে না, আবার কন্ট্যাক্ট লেন্সও বিস্তর ঝক্কির। সেদিক থেকে দেখতে গেলে এখন নতুন প্রজন্মের কাছে ল্যাসিক সার্জারি ভীষণ জনপ্রিয়। এছাড়াও স্মাইল প্রো, পিআরকে, ইমপ্ল্যান্টেবল কলামার লেন্স (ICL)-এর মতো অস্ত্রোপচারের পদ্ধতি রয়েছে। কার চোখে কোনটি নিরাপদ, সে চিকিৎসকই ঠিক করবেন। কে কোন পেশায় রয়েছেন, কাকে কত ক্ষণ ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করতে হয়, কর্নিয়ার ধরন এবং বয়স - এই সব কিছুই দেখে নেওয়া হবে।
কলকাতায় যে সার্জারিগুলি উপলব্ধ
১। ল্যাসিক সার্জারি বা ‘লেজ়ার অ্যাসিস্টেড ইন-সিটু কেরাটোমিলিউসিস’। কর্নিয়ার টিস্যু কেটে পাওয়ার কমানো হয়। যাদের মায়োপিয়া রয়েছে অর্থাৎ দূরের দৃষ্টি অস্বচ্ছ, পাওয়ার মাইনাস ৮ ছাড়িয়ে গিয়েছে, তাদের ল্যাসিক করা যেতে পারে। তবে পাওয়ার স্থায়ী হতে হবে এবং কর্নিয়ার বেধ পুরু হতে হবে।
ল্যাসিক সার্জারির খরচ দু’চোখের জন্য ৮০ থেকে ৮৫ হাজার টাকা। ফেমটোসেকেন্ড লেজ়ার করালে খরচ ৮০ হাজারের বেশি। আর মাইক্রোকেরাটোম ব্লেড সার্জারি করালে খরচ পড়বে ৪০ হাজারের মতো।
২। স্মাইল বা স্মাইল প্রো, স্মল ইনসিশন লেন্টিকিউল এক্সট্র্যাকশন। আইটি সেক্টরের কর্মী, সাংবাদিকদের জন্য স্মাইল প্রো উপযুক্ত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ল্যাপটপ বা কম্পিউটারের সামনে বসে কাজ করতে হয়, নাইট শিফ্ট থাকে বা বাইরে বেরিয়ে কাজ করতে হয় যাদের, তাদের জন্য স্মাইল প্রো সার্জারি উপযুক্ত।
স্মাইল প্রো সার্জারির খরচ পড়বে দু’চোখের জন্য ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা। এই স্মাইল প্রো-র মতোই সিল্ক লেজ়ার আই সার্জারির খরচ দু’চোখের জন্য ১ লক্ষ টাকার বেশি।
৩। PRK বা ফোটোরিফ্র্যাক্টিভ কেরাটেকটোমি সার্জারি। যে পেশায় যখন-তখন শরীরে আঘাত লাগার আশঙ্কা থাকে, দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, অথবা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে সেখানে এই সার্জাটি করাতে হয়। যেমন - সেনাবাহিনীতে, বায়ুসেনা বা নৌবাহিনীতে রয়েছেন, পুলিশে চাকরি করেন, খেলাধূলা করেন যাঁরা, ক্রিকেট বা ফুটবল খেলেন অথবা দৌড়দৌড়ি করতে হয় এমন খেলাধূলা করেন, তাঁদের জন্য পিআরকে উপযুক্ত।
এই পিআরকে সার্জারির খরচ দু’চোখের জন্য ৩০-৩৫ হাজার টাকা।
৪। পঞ্চাশ থেকে পঞ্চান্ন বছরের কোঠায় পৌঁছোলে চোখে ছানি পড়লে যারা লেজ়ার করাতে পারবেন না, তাদের জন্য ICL ইমপ্ল্যান্টেবল কলামার লেন্স পদ্ধতি রয়েছে। এ ক্ষেত্রে কর্নিয়ার টিস্যু না কেটে অস্ত্রোপচার করে ইমপ্ল্যান্টেড লেন্স বসিয়ে দেওয়া হয় চোখে। তাতে আর চশমা পরার প্রয়োজন হয় না।
তবে মাথায় রাখতে হবে, কর্নিয়ার পাওয়ার যেন প্লাস ৪০ থেকে প্লাস ৪৪-এর মধ্যে হয়, চোখের ভিতরের লেন্সের পাওয়ার ১৮-২০ ডায়পটর (ডি)-এর মধ্যে হয়। সেখানে যদি ১৫ ডায়পটরের লেন্স চোখে বসিয়ে দিলে আর আলাদা করে চশমা পরার দরকার হবে না।
বহুল জনপ্রিয় লেজ়ার সার্জারি কী ভাবে করা হয়?
আমাদের চোখের সামনের দিকে গোল কাচের মতো উত্তল অংশ কর্নিযয়া, আমাদের দেখতে সাহায্য করে। কর্নিয়ার যদি গঠনগত সমস্যা থাকে, তখন দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হতে থাকে। কারও দূরের দৃশ্য দেখতে সমস্যা হয়, আবার কারও কাছের। তাই কর্নিয়াতে লেজার প্রয়োগ করে চিকিৎসা করা হয়। এই পদ্ধতিটিকে ‘এগ্জ়াইমার লেজ়ার’ বলে।
ক্যাটারাক্ট ও রিফ্র্যাকটিভ শল্যচিকিৎসক অয়ন মোহন্ত বুঝিয়ে বলেছেন, ‘‘যে পাওয়ারের কথা বলা হয় সব সময়ে, তা কিন্তু চশমার পাওয়ার, চোখের পাওয়ার নয়। যেমন, মাইনাস ৫ বা মাইনাস ৭ ইত্যাদি। চোখের ভিতরে কর্নিয়া, লেন্সের নিজস্ব পাওয়ার থাকে। কর্নিয়ার পাওয়ার প্লাস ৪০ থেকে প্লাস ৪৪ এর মতো হয়। ধরুন, যাঁর চশমার পাওয়ার মাইনাস ৫, তাঁর হয়তো কর্নিয়ার পাওয়ার প্লাস ৪৪। এ বার লেজ়ার প্রয়োগ করে কর্নিয়ার পাওয়ার যদি প্লাস ৪৪ থেকে প্লাস ৩৯ –এ নামিয়ে আনা যায়, তা হলেই আর মাইনাস ৫ পাওয়ারের চশমা পরতে হবে না। তখন চশমা ছাড়াই পরিষ্কার দেখা যাবে।’’
কর্নিয়া গড়ে ৫২০ মাইক্রন পুরু হয়। এগ্জ়াইমার লেজ়ারের কাজ হল কর্নিয়ার টিস্যুকে একটু একটু করে পাতলা করে পাওয়ার কমানো। পদ্ধতিটি ল্যাসিক, স্মাইল প্রো বা পিআরকে-র ক্ষেত্রে আলাদা। কর্নিয়ার পুরুত্ব অনুযায়ী তা ঠিক করতে হয়। কর্নিয়ার এই পুরু ভাব স্বাভাবিকের আশপাশে থাকলে ল্যাসিক সার্জারি করানো যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে মাইক্রোকেরাটোম ব্লেড বা ফেমটোসেকেন্ড লেজ়ার পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকেন চিকিৎসকেরা। প্রথমেই ৯০ থেকে ১১০ মাইক্রনের একটি স্তর কর্নিয়া থেকে অস্ত্রোপচার করে তুলে নেওয়া হয়। এর পরে ফের এগ্জ়াইমার লেজ়ার পদ্ধতি ব্যবহার করে কর্নিয়ার বেশ কিছু কোষকে অপসারণ করা হয়। তার পর আগে থেকে তুলে রাখা কর্নিয়ার স্তরটি আবার চোখে বসিয়ে দেওয়া হয়। কোষের এপিথেলিয়াম স্তর গঠনের মাধ্যমে কর্নিয়ার স্তরটি ফের জুড়ে যায়। এ ক্ষেত্রে সেলাই করার প্রয়োজন পড়ে না। সার্জারির পরদিন থেকেই চশমা ছাড়া স্পষ্ট দেখা যাবে।
চোখে সার্জারি কারা করাতে পারবেন, কারা নয়?
১. বয়স ১৮ বছরের উপরে হতে হবে। এর কমে চোখে অস্ত্রোপচার করা যাবে না, সে পাওয়ার যত বেশিই হোক না কেন।
২. ৬ মাস বা তারও বেশি সময় ধরে চোখে স্থায়ী পাওয়ার রয়েছে, এমন কেউ করতে পারবেন। যাঁদের পাওয়ার ঘন ঘন বদলায়, তাঁরা করাতে পারবেন না।
৩. কর্নিয়ার স্তর পুরু হতে হবে, কম করেও ৫২০ মাইক্রন।
৪. ড্রাই আই বা শুষ্ক চোখের সমস্যা থাকলে ল্যাসিক সার্জারি করা যাবে না।
সার্জারির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কী আছে?
* ল্যাসিক সার্জারি করালে দু’রকম সমস্যা হতে পারে— ১) ড্রাই আইয়ের সমস্যা হতে পারে, ২) কোনোভাবে আঘাত লাগলে বা দুর্ঘটনা ঘটলে তখন আবার পাওয়ারের সমস্যা হতে পারে।
* PRK'র ক্ষেত্রে ড্রাই আইয়ের সমস্যা বেশি হতে পারে।
* সার্জারি করানোর পর প্রথম কিছু দিন চোখের সামনে আলোর রিং বা আলোর ছটা দেখা যেতে পারে। পরে ধীরে ধীরে এই সমস্যা কমে যাবে।
অস্ত্রোপচারের পরে সতর্কতা
* সার্জারির পর প্রথম কিছুদিন চোখে আলোর রিং দেখা যেতে পারে, তাই রাতে গাড়ি চালানো থেকে বিরত থাকুন সেই সময়ে।
* প্রথম কয়েক দিন হাত দিয়ে চোখ রগড়ানো যাবে না।
* চোখে জোরে জোরে জলের ঝাপটা দেওয়া যাবে না।
* সাঁতার কাটা কয়েক মাস বন্ধ রাখতে হবে।
* শৌখিন লেন্স পরা যাবে না প্রথম কয়েক মাস। পরে পরতে হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
* অস্ত্রোপচারের পর পরই চোখে ধুলোবালি লাগানো যাবে না।


