মদ, সুরা বা অ্যালকোহলে কী এমন আছে, যা ক্ষণিকের আরাম দিতে পারে মনে? বিজ্ঞান বলছে, এ প্রশ্নের জবাব লুকিয়ে রয়েছে মানুষের প্রাচীনতম পূর্বপুরুষের স্বভাবে।
মদ্যপানে মেজাজ ফুরফুরে লাগে কারণ অ্যালকোহল মস্তিষ্কের রাসায়নিক ভারসাম্যকে প্রভাবিত করে। বিশেষত GABA নিউরোট্রান্সমিটারকে বাড়িয়ে তোলে যা স্নায়ুকে শান্ত করে এবং ডোপামিন নিঃসরণে সাহায্য করে, যা আনন্দ ও মেজাজ ভালো হওয়ার অনুভূতি দেয়, আর এর ঐতিহাসিক শিকড় মানুষের পূর্বপুরুষদের ফলের গাঁজন করা অংশ খেয়ে মস্তিষ্কে অ্যালকোহলের প্রভাব অনুভব করা থেকে আসতে পারে, যা তাদের খাদ্যাভ্যাসের একটি অংশ ছিল বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন।
** কেন এমন হয়?
মস্তিষ্কের রাসায়নিক প্রক্রিয়া:
* GABA-এর প্রভাব: অ্যালকোহল মস্তিষ্কের GABA (গামা-অ্যামিনোবিউটাইরিক অ্যাসিড) নামক নিউরোট্রান্সমিটারের কার্যকারিতা বাড়িয়ে তোলে। GABA মস্তিষ্কের স্নায়ু কার্যকলাপকে ধীর করে, যা শিথিলতা ও শান্ত ভাব আনে।
* ডোপামিনের মুক্তি: এটি মস্তিষ্কে ডোপামিন নামক "ভালো লাগার" হরমোনের নিঃসরণও বাড়ায়, যা আনন্দ ও ইউফোরিয়া (অতিরিক্ত আনন্দ) অনুভূতি তৈরি করে।
* সেরোটোনিন ও এন্ডোরফিন: অ্যালকোহল সেরোটোনিন ও এন্ডোরফিনের মতো নিউরোট্রান্সমিটারের উপরও প্রভাব ফেলে, যা মেজাজ ভালো রাখতে সাহায্য করে।
** পূর্বপুরুষদের অভ্যাস:
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, প্রায় ৫ কোটি বছর আগে আমাদের প্রাচীন পূর্বপুরুষরা গাছের পচে যাওয়া বা গাঁজন করা ফল খেত, যা স্বাভাবিকভাবেই অ্যালকোহলযুক্ত ছিল।
এই গাঁজন করা ফল খেয়ে তারা যে হালকা "নেশা" বা আনন্দ পেত, তা তাদের খাবার খোঁজার প্রক্রিয়াকে সহজ করত এবং তাদের মস্তিষ্ক সেই আনন্দদায়ক অনুভূতিকে চিনতে শিখেছিল।
এই প্রাকৃতিক অভ্যাস থেকেই মানুষ সময়ের সাথে সাথে অ্যালকোহলের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে, যা এখন তাদের মেজাজ ফুরফুরে করার একটি উপায়।
** সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক কারণ:
সামাজিক অনুষ্ঠানে বা চাপের মুহূর্তে সাময়িক আরাম পেতেও অনেকে মদ্যপান করেন, যা তাদের মেজাজ ভালো করে দিতে পারে।
‘বায়োসায়েন্স’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে এ ব্যাপারে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। সেখানে ব্রিটেনের ডার্টমাউথ কলেজের নৃতত্ত্বের অধ্যাপক ন্যাথানিয়েল ডোমিনি, লিখেছেন, ‘‘কয়েক কোটি বছর আগে গরিলা, শিম্পাঞ্জি বা এপ জাতীয় প্রাণীরা মজে যাওয়া ফলের প্রতি আসক্ত হয়েছিল। ওই ধরনের ফলে যে ইথানল তৈরি হত, তা অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় হজম করার ক্ষমতাও অন্তত ৪০ শতাংশ বেড়েছিল এই বর্গের প্রাণীদের, যাদের মানুষের পূর্বসূরি বলে মনে করা হয়।’’
ন্যাথানিয়েলের বক্তব্য, ওই ধরনের স্বাদের প্রতি আকর্ষণ সম্ভবত সেই সময় থেকেই তৈরি হয়েছিল মানুষের পূর্বসুরিদের মস্তিষ্কে। তা না হলে মানুষ চাষাবাদ শুরু করার পর ফলকে মজিয়ে সুরা বানাবে কেন?
এ ব্যাপারে আরও একটি তত্ত্ব দিয়েছেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা। ‘সায়েন্স অ্যাডভান্স’ নামে এক জার্নালে তাঁরা লিখেছেন, ‘‘সুরার পাত্র হাতে আড্ডা দেওয়ার যে প্রবণতা মানুষের মধ্যে রয়েছে, সেই একই স্বভাব দেখা গিয়েছে মজে যাওয়া ফল খাওয়া আফ্রিকার বানরজাতীয় প্রাণীদের মধ্যে।’’ গবেষকেরা জানাচ্ছেন, আফ্রিকার জঙ্গলে থাকা শিম্পাঞ্জিরা দিনে অন্তত ১০ পাউন্ড পাকা ফল খায়, যার মধ্যে অধিকাংশই মজে যাওয়া। এর থেকে দিনে দেড় পাত্র সুরার সমান অ্যালকোহল শরীরে যেতেই পারে। গবেষকেরা জানিয়েছেন, ওই ধরনের ফল খাওয়ার সময় শিম্পাঞ্জিদের মধ্যেও বন্ধুত্বমূলক আচরণ লক্ষ করা গিয়েছে।
অতএব , অ্যালকোহল মস্তিষ্কের আনন্দ ও শিথিলতা সৃষ্টিকারী রাসায়নিকগুলোকে প্রভাবিত করে এবং এই অভ্যাসটি মানুষের বিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে, যা আমাদের পূর্বপুরুষদের আচরণে প্রোথিত ছিল।
