বেশিরভাগ মানুষ, বিশেষত যারা ডানহাতি (Right-handed), তারা ঘড়ি পরার জন্য বাঁহাতকেই বেছে নেন? এটি কেবল একটি প্রচলিত ফ্যাশন বা অভ্যাস নয়, এর পেছনে রয়েছে একাধিক বাস্তব কারণ, যার মূল উদ্দেশ্য হলো কার্যকারিতা এবং সুরক্ষা।

দুপুরের ভিড়ভাট্টা অফিস ক্যান্টিন হোক কিংবা লোকাল ট্রেনের ব্যস্ত কামরা—মানুষের কব্জির দিকে তাকিয়ে দেখলে একটা জিনিস খুব সহজেই চোখে পড়ে। যত জন ঘড়ি পরেছেন, তাঁদের সবারটাই যেন চলে গেছে বাঁ হাতের দিকে। যেন অজানা কোনও ইশারায় মানুষ একই সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছেছে। কেউ কাউকে বলেনি, কোনও নিয়ম বইতেও লেখা নেই, তবুও ঘড়ি মানেই বাঁ হাত—এ যেন একটা নীরব, বিশ্বজনীন অভ্যাস। কিন্তু এই অভ্যাসের শেকড় শুধু অভ্যাসেই নেই। এর পিছনে লুকিয়ে আছে শরীরের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি, দৈনন্দিন জীবনের সুবিধাবাদী সিদ্ধান্ত এবং ঘড়ির বিশ বছরের পুরনো প্রযুক্তিগত ইতিহাস।

ঘড়ি পরার অভ্যাস শুরু হয়েছিল যখন হাতঘড়ি মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে ওঠে। সেই সময়ে মানুষের ডান হাত ছিল সবচেয়ে সক্রিয় হাত—আজও আছে। যে হাত দিয়ে কলম ধরা থেকে দরজা খোলা, ব্যাগ বহন থেকে মোবাইল স্ক্রল—অসংখ্য কাজ হয়, সেই হাতটিকে ব্যস্ত সময়ে সময় দেখার ঝামেলা থেকে মুক্ত রাখাই ছিল অনেকের চিন্তা। ফলে ঘড়িটা স্বাভাবিকভাবেই চলে যায় কম ব্যস্ত হাতে—বাঁ দিকে। এতে কেবল সুবিধাই নয়, আরামও বাড়ে। লেখার সময় ডান হাত টেবিলের সঙ্গে ঘষা খায় না, কাজে কোনও বিঘ্ন ঘটে না, আর সময় দেখা যায় স্বাভাবিক গতিতে। দিনের পর দিন ব্যবহার করতে করতে মানুষ বুঝে ফেলল, ঘড়ির সুরক্ষার দিক থেকেও বাঁ হাত অনেক বেশি নিরাপদ। যে হাত কাজ করে বেশি, আঘাতও পায় সে হাতটিই। দরজায় ধাক্কা লাগা, ভুলবশত কোথাও আটকে যাওয়া, বা ব্যাগ কাঁধে তোলার সময় স্ক্র্যাচ পড়া—এসব ছোটখাটো ঘটনা ঘড়ির ডায়াল বা স্ট্র্যাপের ক্ষতি করে। বাঁ হাতে ঘড়ি থাকলে এসব ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়। তাই ঘড়ির টেকসই হওয়া এবং ব্যবহারযোগ্যতা—দুটো মিলেই বাঁ হাতকে এগিয়ে রাখে। তবে, ঘড়ির ইতিহাসের ভিতরে আছে আরও গভীর একটি কারণ। আজ আমরা যে স্মার্টওয়াচ ব্যবহার করি, সেগুলো চার্জ দিতে হয়—কিন্তু এক সময়ে ঘড়ি চালাতে হতো দম দিয়ে।

 ‘ক্রাউন’ বা ঘড়ির কাঁটা ঘোরানোর ছোট্ট হ্যান্ডেলটি রাখা হতো ঘড়ির ডান পাশে। ফলে বাঁ হাতে ঘড়ি পরলে ডান হাত দিয়ে খুব সহজেই সেট করা যেত সময়। মানুষের হাতের ব্যবহার যান্ত্রিক ঘড়ির সঙ্গে এমনভাবে মানিয়ে গিয়েছিল যে, যান্ত্রিক যুগ চলে গেলেও সেই অভ্যাস মানুষ ভুলতে পারেনি। প্রযুক্তি বদলেছে, ব্যাটারি এসেছে, অটোমেটিক মুভমেন্ট এসেছে, তারপর ডিজিটাল, তারপর স্মার্টওয়াচ—কিন্তু ঘড়ি পরার হাত বদলায়নি। অবশ্যই ব্যতিক্রম আছে। যারা বাঁহাতি, তারা ঠিক উল্টো। তাঁদের কাছে বাঁ হাতই কাজের হাত, তাই ঘড়ি চলে যায় ডান কব্জিতে। যুক্তিটা একই—সক্রিয় হাতকে হালকা রাখা, আর ঘড়িকে নিরাপদ রাখা। এই সহজ, নিত্যদিনের অভ্যাসের ভিতরে লুকিয়ে রয়েছে শতাব্দীর যান্ত্রিক ইতিহাস, মানুষের শরীরের স্বাভাবিক প্রবণতা এবং ব্যবহারিক বুদ্ধি। ঘড়ি কোন হাতে পরবেন তা আজও ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। কিন্তু লাখো মানুষের অভ্যাসের জায়গায় বাঁ হাত জিতে যাওয়ার কারণ খুবই গভীর—এটা শুধু স্টাইল নয়, বরং ব্যবহারিকতা আর আরামের নিখুঁত সমন্বয়। এ কারণেই, আমরা সচেতনভাবে না ভাবলেও, ঘড়ি হাতেই পরলে হাতটাই যেন নিজে থেকেই বাঁ দিকে চলে যায়। অভ্যাস নয়—মানুষের জীবনযাপনই যেন সিদ্ধান্তটা নিয়ে দেয়।