- ‘প্রজাপতি’উপন্যাসটি অশ্লীলতার অভিযোগে নিষিদ্ধ হয়
- সমরেশ বসুর জন্মদিনেই নিষিদ্ধ করা হয় উপন্যাসটিকে
- লেখকের মৃত্যুর পর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য একটি দীর্ঘ নিবন্ধ লেখেন
- নিজের পার্টির কাগজে তার নাম দেন ‘লেখকের দ্বিতীয় মৃত্যু’
তপন মল্লিকঃ- লেখকের লেখা যোগায় লেখকের জীবন। যে প্রবাহে তাঁর জীবননদী বয় সেই ধারা থেকেই উঠে আসে লেখকের লেখা। সমরেশ বসুর জীবনস্রোতেও ছিল ছিল নানা বাঁক- ঢাকেশ্বরী কটন মিল থেকে মাথায় নিয়ে সবজি বিক্রি, সাহেব বাবুদের কোয়ার্টারে ডিম ফেরি, কমিউনিস্ট পার্টি...। তাঁর কলমের উত্তাপ যদিও পার্টি একসময় ব্যবহার করতে চেয়েছিল রাজনৈতিক কারণেই। তবে কমিউনিস্ট পার্টি পরবর্তীতে লেখক সমরেশকে আর মর্যাদা দেয় নি। লেখক সমরেশও তাঁর লেখায় কমিউনিস্ট পার্টিকে নানাভাবে সমালোচনা করেছেন। সমরেশ বসুর মৃত্যুর পর রাজ্যের তৎকালীন তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ‘লেখকের দ্বিতীয় মৃত্যু’ এভাবেই পার্টির কাগজে দীর্ঘ নিবন্ধ লিখেছিলেন।
আরও পড়ুন, ঘুমের ওষুধ আর দেওয়া হয়নি, ডাকলে চোখ খুলতে চেষ্টা করছেন, স্থিতিশীল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য
১৯৬৮ সালে অ্যাডভোকেট অমল মিত্র এই মামলা করেন
সমরেস বসুর ‘প্রজাপতি’ উপন্যাসকে কেন্দ্র করে অশ্লীলতার অভিযোগ উচ্চ আদালতে পৌঁছেছিল। দিনের পর দিন সংবাদ মাধ্যমে তা শীরোনামে ছিল| ইতিহাস বলে, কোনও কোনও বইয়ের কারণেই মানুষ শতাব্দীর পর শতাব্দী সামনের রাস্তা কেটেছে, সেই পথেই তার সমাজ, সভ্যতা এগিয়েছে। আবার কিছু কিছু বইকে মানুষ একমাত্র সত্য বলে ধরে নিয়ে ধ্বংসের খেলায় মেতে উঠেছে। কোনও বইকে কিছু মানুষ ক্ষতিকর মনে করে নিষেধের দাবি তুলেছে, লেখকের শাস্তি বা নির্বাসন চেয়েছে। এর ফলে আমরা যেমন পেয়েছি শ্রেষ্ঠ, মহৎ রচনা নামে বেশ কিছু বই, তেমনই পেয়েছি বাতিল, ক্ষতিকারক দাগানো কিছু বই। আলোচ্য উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৩৭৪ সালের শারদীয়া দেশ পত্রিকায়। ১৯৬৮ সালে অ্যাডভোকেট অমল মিত্র ‘প্রজাপতি’ উপন্যাসটিকে অশ্লীলতার অভিযোগে নিষিদ্ধ করার আবেদন করে মামলা করেন। আবেদনকারী তাঁর পক্ষে ৮ জন সাক্ষীর নাম দেন। যার মধ্যে লেখক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আশুতোষ ভট্টাচার্যের নামও ছিল। তবে দু’জনের কেউই সাক্ষী দিতে আসেননি।
আরও পড়ুন, ঠাকুমার কাছেই মানুষ সবার প্রিয় ও হেনরি, জেলে বসেই লেখেন একের পর এক বিখ্য়াত গল্প
অভিযোগ ‘প্রজাপতি’ অশ্লীল উপন্যাস
কলকাতা চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে অভিযুক্ত হয়ে আদালতে হাজির হন সমরেশ বসু এবং দেশ পত্রিকার প্রকাশক ও মুদ্রাকর সীতাংশুকুমার দাশগুপ্ত। অভিযুক্তের সাক্ষী হিসেবে ছিলেন বুদ্ধদেব বসু, নরেশ গুহের মতো ব্যক্তিরা। লেখক সমরেশের বিরুদ্ধে অভিযোগ ‘প্রজাপতি’ অশ্লীল উপন্যাস, যেটি সাহিত্যের পবিত্রতা নষ্ট করছে এবং ওই উপন্যাস পড়ে অল্প বয়সী পাঠকেরা উচ্ছন্নে যাচ্ছে। এটা ঘটনা দেশ-এর ওই শারদীয় সংখ্যাটি ১৫ থেকে ২৩ বয়সীরা লাইন দিয়ে কিনেছে। সাহিত্য সমাজমানসে নৈতিকতা তৈরি করে কিন্তু 'প্রজাপতি' তার জায়গায় যৌনতা নারী পুরুষের কামনা সৃষ্টি করছে। অভিযোগকারীর প্রশ্ন তাহলে এই উপন্যাসটির সাহিত্য মূল্য কোথায়?
‘লেখকের দ্বিতীয় মৃত্যু’
সাক্ষী বুদ্ধদেব বসু জানান, তিনি এই লেখায় অশ্লীলতার বদলে সমাজ বাস্তবতার ছবিই পেয়েছেন। তাঁর প্রশ্ন, সাহিত্যে শ্লীল-অশ্লীলতা মাপার দাড়িপাল্লাটা কোথায়? যদি থাকে তাহলে রামায়ণ-মহাভারতের মতো বহু ক্লাসিকের বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠতে পারে। নরেশ গুহর বক্তব্য ছিল প্রায় এক। কিন্তু 'প্রজাপতি' নিষিদ্ধ করার মামলায় সেবার অভিযোগকারীই জিতে যায়। সেই মামলার রায় বেরিয়েছিল ১৯৬৮ সালের ১১ ডিসেম্বর। অর্থাৎ ‘প্রজাপতি’ উপন্যাসটি ওইদিন অশ্লীলতার দায়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। রায়ে বলা হয়, অশ্লীল উপন্যাস লেখার জন্য লেখক সমরেশ বসুকে কোনও মতেই অব্যাহতি দেওয়া যায় না। তা তিনি যত বড় লেখকই হোন না কেন। ভারতীয় দণ্ডবিধির ২৯২ ধারা অনুযায়ী তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। আদালত লেখককে ২০১ টাকা জরিমানা করে, অনাদায়ে দু’মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দেয়। প্রকাশকেরও একই সাজা হয়। এবং দেশ শারদীয় সংখ্যা(১৩৭৪)-এর ১৭৪ থেকে ২২৬ পৃষ্ঠা পর্যন্ত নষ্ট করে দেওয়ার কথা বলা হয়। খুব অবাক করা ঘটনা হল ৫২ বছর আগে লেখকের উপন্যাস নিষিদ্ধ ঘোষণা ও লেখককে তার জন্য শাস্তি দেওয়ার দিনিটি ছিল সমরেশ বসুর ৪৪ তম জন্মদিন।
আরও পড়ুন, '২ পয়সার প্রেস' মন্তব্যে মহুয়াকে আইনি নোর্টিস হাইকোর্টের আইনজীবির, ক্ষমা না চাইলেই মামলা
১৯৮৫ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বলা হয়, 'প্রজাপতি' অশ্লীল নয়
জরিমানার টাকা সেদিনই জমা দেওয়া হয় এবং মামলাটিকে উচ্চ আদালতে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। যদিও কলকাতা উচ্চ আদালতও ৫ বছর পর তার রায়ে ব্যাঙ্কসাল কোর্টের রায়ই বহাল রাখে। বিচারপতি মামলাটিকে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে নিয়ে যাওয়ার অনুমতিও নাকচ করে দেন। কিন্তু হাল ছাড়েন না লেখক ও দেশ কর্তৃপক্ষ। ১৯৭৯ সালে মামলাটি সুপ্রিম কোর্টে ওঠে। পরের বছর সুপ্রিম কোর্ট প্রজাপতির অনুবাদ চায়। অনুবাদটি যদিওবা জমা পড়ল কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেটি আগুনে নষ্ট হওয়ায় ফের ১৯৮৫ সালে পেশ করা হয়। ওই বছরই ২৪ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বলা হয়, প্রজাপতি অশ্লীল নয়। বাংলা সাহিত্যের কোনো উপন্যাস নিয়ে ১৭ বছর ধরে মামলা সেই প্রথম।
Read Exclusive COVID-19 Coronavirus News updates, from West Bengal, India and World at Asianet News Bangla.
খেলুন দ্য ভার্চুয়াল বোট রোসিং গেম এবং চ্যালেঞ্জ করুন নিজেকে। கிளிக் செய்து விளையாடுங்கள்
Last Updated Dec 11, 2020, 6:11 PM IST