সংক্ষিপ্ত

১৬১০ সালে লক্ষ্মীকান্ত রায় চৌধুরীর হাত ধরেই শুরু সাবর্ণদের পুজোর। এই বাড়ির সাথে সম্পর্ক রয়েছে ইতিহাসের বারো ভুঁইয়ার। পণ্ডিতদের উপদেশ ছিল, দেবীর গাত্রবর্ণ হতে হবে শিউলির বৃন্ত অথবা সোনার আভার মতো। 

বাংলার বিখ্যাত কয়েকটি ঐতিহ্যবাহী দুর্গাপুজোর মধ্যে একটি হল সাবর্ণ রায় চৌধুরীদের বাড়ির পুজো। বারো ভুঁইয়ার সময় যখন বাংলার রাজনীতির আকাশে নানা পটপরিবর্তন হচ্ছে, লক্ষ্মীকান্তের উত্থান সেই সময়। লিখেছেন, সংবাদ প্রতিনিধি অনিরুদ্ধ সরকার।

তখন কলকাতা এবং সংলগ্ন অঞ্চল ছিল যশোরের মধ্যে। আর এই যশোর এস্টেটের দায়িত্বে ছিলেন বারো ভুঁইয়ার বসন্তরায় এবং বিক্রমাদিত্য। বিক্রমাদিত্যর পুত্র প্রতাপাদিত্য এবং লক্ষীকান্ত, দু’জনেরই ছিলেন অমায়িক ব্যবহার। বসন্তরায়ের অত্যন্ত কাছের ছিলেন লক্ষ্মীকান্ত। তিনি ছিলেন যশোর এস্টেটের মহামন্ত্রী। বিক্রমাদিত্য মারা যাওয়ার সময় পূর্ববঙ্গ, অর্থাৎ যশোরের দিক পেলেন প্রতাপাদিত্য, পশ্চিম দিক পেলেন বসন্তরায়। পিতার মৃত্যুর পর চরিত্রের আমূল পরিবর্তন ঘটল প্রতাপের। অত্যন্ত স্বৈরাচারী হয়ে উঠলেন তিনি। হত্যা করলেন পিতা সমান বসন্তরায়কে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘বউঠাকুরানীর হাট’ এই প্রতাপাদিত্যকে ঘিরে। প্রতাপকে দমন করতে মানসিংহকে পাঠান আকবর। প্রতাপ পরাজিত হলে ১৬০৮ সালে লক্ষ্মীকান্তকে হালিশহর থেকে আটটি পরগনার নিষ্কর জমিদারি স্বত্ত প্রদান করেন মানসিংহ। সেই সঙ্গে পান রায়চৌধুরী উপাধি। এর আগে হালিশহরে বছর দু’য়েকের জন্য দুর্গাপুজো করলেও বড়িশাতে জাঁকিয়ে বড় করে পুজো শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন লক্ষ্মীকান্ত রায়চৌধুরী।

পুজো শুরু কখন থেকে - 
১৬১০ সালে লক্ষ্মীকান্ত রায় চৌধুরীর হাত ধরেই শুরু এই পুজোর। কাঠের থামের উপর হোগলাপাতার ছাউনি দেওয়া আটচালা মণ্ডপে দেবী আরাধনা শুরু হয়। পরে এর সঙ্গে যুক্ত হয় ষোলোটি থামবিশিষ্ট একটি নাটমন্দির। পণ্ডিতরা লক্ষ্মীকান্তকে বিধান দিয়েছিলেন, দেবীর গায়ের রং হবে স্বর্ণাভ বা শিউলি ফুলের বোঁটার মতো।

পুজো পদ্ধতি - 
সাবর্ণ পরিবারে কলাবৌ স্নান সপ্ততীর্থের জল দিয়ে আটচালাতেই করানো হয়। আটচালাতেই একমাত্র কৃষ্ণানবমী কল্পারম্ভে পুজো হয়। অন্য পুজোগুলি শুরু হয় ষষ্ঠীর দিন থেকে। অষ্টমী এবং নবমীর দিন এই বাড়িতে একটি বিশেষ পুজো হয়, ‘মাস ভক্ত বলি'। ১৮০টা খুড়িতে মাসকলাই এবং দই দিয়ে এই পুজো করা হয় অপদেবতা আর উপদেবতাদের সন্তুষ্ট করতে যাতে তারা পুজোয় কোনও বিঘ্ন ঘটাতে না পারে।পুজোয় ১৩টি ছাগল এবং একটি মোষ বলি হত। এখন পশুবলি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তার বদলে কুমড়ো, শশা এই সব বলি হয়। 


 

পুজোর ভোগবৃত্যান্ত- 
তিন বেলা দেবীকে ভোগ দেওয়া হয়। সকালে ফলমূল, দুপুরে অন্নভোগ আর রাতে লুচি। সপ্তমীর দিন থেকে পরিবারের মহিলারা একসঙ্গে ভোগ রাঁধেন। সাদা ভাত, পোলাও, খিচুড়ি— এক এক দিন এক একটা জিনিস রান্না করা হয়। এর সঙ্গে শুক্তো, মুগের ডাল, মোচার ঘণ্ট, লাউ, সবই রান্না করা হয় দেবীর জন্য। এ ছাড়াও দেবীকে আমিষ ভোগ দেওয়া হয় বলে রুই, ভেটকি, পার্শে, বাটা, ইলিশ— এমন পাঁচ রকমের মাছ থাকে প্রতি দিন। আর থাকে চাটনি, পায়েস, পাঁচ-ছয় রকমের মিষ্টি। অষ্টমীর দিন সন্ধিপুজো চলাকালীন তৈরি করতে হয় খিচুড়ি, ল্যাটামাছ আর কাঁচকলা পোড়া। দশমীর দিন হয় পান্তাভোগ। নবমীর দিন রাতে রান্না করে রাখতে হয় খেসারির ডাল, চালতার অম্বল, কচুশাক আর কইমাছ। দশমীর দিন সকালে ঠাকুরকে তা উৎসর্গ করা হয়। রাতে হয় লুচি। এর সঙ্গে থাকে বেগুনভাজা, পটলভাজা এবং ছানার ডালনা।

প্রাচীন ঐতিহ্য মেনে পুজো- 
সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের মোট আটটি বাড়িতে দুর্গাপুজো হয়। প্রধান পুজোটি হয় বড়িশা আটচালায়। বাকি পুজোগুলি হয় আটচালা বাড়ি, বড় বাড়ি, মাঝের বাড়ি, বেনাকী বাড়ি, কালীকিঙ্কর ভবনে। এ ছাড়াও বিরাটিতে ও নিমতা পাঠানপুরের সাবর্ণবাড়িতে পুজো হয়। 

তন্ত্রমতে পুজো-
কবি বিদ্যাপতি রচিত দুর্গাভক্তি তরঙ্গিনী মতে পুজো হয়। সহজ কথায়, তন্ত্রমতে দেবীর পুজো হয়। এই পরিবারের পুজোতে ত্রিশক্তির প্রভাব দেখা যায়- শাক্ত, শৈব এবং বৈষ্ণব। পুজোর চালচিত্রে দেখা মেলে ছিন্নমস্তা, বগলা, কমলাকামিনী, মাতঙ্গী সহ দশমহাবিদ্যা। এর পাশাপাশি  রাধাকৃষ্ণও পূজিত হন। বড় বাড়ি, মেজ বাড়ি ও নিমতার বাড়িতে সিংহের মুখ হয় ঘোটক আকৃতির। যা বৈষ্ণব মতানুযায়ী হয়। বাকি বাড়িতে সিংহের মুখ হয় সিংহের মতোই। বড় বাড়ি এবং বিরাটি বাড়িতে নবমীর দিন হয় কুমারী পুজো। এ-ও হয় বৈষ্ণব মতে। আটচালা বাড়িতে ষষ্ঠীর তেরো দিন আগে থেকে দেবীকে আবাহন করা হয়। পাশেই রাধাগোবিন্দ মন্দিরে রয়েছে বোধন ঘর। সেখানে দেবীর বোধন শুরু হয়। মহালয়ার পরের দিন বেদী করে সেখানে পঞ্চঘট বসানো হয়। পঞ্চমীর দিন ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরে গণেশ ও শান্তির আরাধনা করা হয়। সপ্তমীর দিন যখন পুজো শুরু হয় তখন এই ঘট থেকে মাটি নিয়ে গিয়ে প্রতিমার সামনে মূল ঘটে নিয়ে গিয়ে বসানো হয়।

বিজয়া দশমী-  
সাবর্ণদের বাড়িতে দশমীর দিন সকালে ঘট বিসর্জনের পরে ঠাকুরের সামনেই শুরু হয় বিজয়া পর্ব। চণ্ডীমণ্ডপে রয়েছে প্রণামের রীতি। আগে ঠাকুর টলিনালায় বিসর্জন হত। এখন ঠাকুর বিসর্জন  হয় বাবুঘাটে।

আরও পড়ুন-
‘সিটি অফ জয়’ থেকে ‘সিটি অফ ড্রিমস’, দুর্গাপুজোর আমেজ স্বপ্নের মুম্বইতেও, জেনে নিন এখানকার পুজোর বিশেষত্বগুলি
কেবলমাত্র কল্লোলিনী কলকাতা নয়, দিলওয়ালো কা দিল্লিতেও দুর্গাপুজো ছাড়িয়েছে একশো বছর, রইল সেরা মণ্ডপগুলির হদিশ 
দক্ষিণ সুইডেনের হেলসিংবর্গের কনকনে ঠাণ্ডায় এই প্রথমবার তিথি মেনে দুর্গাপুজো, দুই বাংলার সমন্বয়ে নারীশক্তি