সংক্ষিপ্ত

প্রসূনের কাছে শুধু একটাই আর্জি, তোমার পরের ছবিতে খুঁত ধরার ফাঁকটুকু রেখো। এত নিখুঁত ছবি দেখলে রাতের ঘুম নষ্ট হয়।

একটা ছবি প্রায় পরপর দু’বার দেখে ফেললাম। আরও কয়েক বার দেখব। শনিবারেই যেমন আবার যাচ্ছি নন্দনে। বন্ধুদের নিয়ে। যত দেখছি ততই একটা কাঁটা মনে খচখচ করছে। এত বার দেখছি। দেখতে দেখতে নানা দিক থেকে নিত্য নতুন ভাবে আবিষ্কারের চেষ্টা করছি। যে দৃশ্যগুলো প্রথম বার এড়িয়ে গিয়েছিলাম, সে গুলো পরের বার খুঁটিয়ে দেখছি। হাতের সমস্ত টিস্যু ভিজেছে। শেষে জামা-কাপড়েই চোখ ঘষে ঘষে মুছেছি। তার পরেও ‘দোস্তজী’র একটা খুঁত বের করতে পারলাম না! যাঁরা আমায় চেনেন তাঁরা জানেন, দেবলীনা দত্ত ছবি নিয়ে ভীষণ খারাপ রকমের খুঁতখুঁতে। বিশ্বের সব ভাষার ছবি দেখে বেড়ায়। তাই চট করে ছবির পাশে ‘ভাল’ তকমা সে দিতে পারে না। কিন্তু পরিচালক প্রসূন চট্টোপাধ্যায় সেই অসাধ্যসাধনই করলেন! এবং এ সবের জন্য একটা বড় ধন্যবাদ প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়কে। ভাগ্যিস বুম্বাদা ছবির নিবেদক। ভাগ্যিস রাধা স্টুডিয়োয় স্পেশ্যাল স্ক্রিনিং-এ আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সেই জন্যই তো ‘দোস্তজী’র সঙ্গে আমার এত দোস্তি!

সেই বন্ধুত্বের খাতিরে বলছি, প্রথম বার দেখে কোনও দ্বন্দ্ব ছাড়া মনে হয়েছিল, এই ছবিটা বিশ্বমানের। বিশ্বের তাবড় ছবির সঙ্গে এক পংক্তিতে বসার যোগ্য। সব দিক থেকে। সাধারণত একটা ছবির যে ক’টা দিক হয়। পরিচালনা, অভিনয়, সংলাপ, বিজিএফ, অভিনেতা, ক্যামেরা, রং, শব্দপ্রক্ষেপ— সব দিক থেকে এই ছবি সেরা। প্রসূনের পরিচালনা নিয়ে কী বলি? ছবি না বানিয়ে ও যেন কবিতা লিখেছে! অনেক বছর পরে একটা ছবি দেখে এত আনন্দ হল। ছবি দেখতে দেখতে আমি আর ‘দোস্তজী’ একাকার। ছবির সব চেয়ে বড় শিক্ষণীয় বিষয়, দামি জিনিস হারানোর ব্যথা কী করে ইতিবাচক হয়? দেখিয়ে দিল ‘দোস্তজী’। বন্ধুকে হারিয়ে ভেঙে পড়তে পড়তেও নিজের মধ্যে তাকে ধারণ করে নেওয়া, পাগলের মতো ভাল না বাসলে এই জিনিস পারা যায় না।

 

 

ফেল করা ছেলের ক্লাসে পঞ্চম হওয়া, শুঁয়োপোকা থেকে প্রজাপতি হয়ে ডানা মেলে মুক্তিলাভ। কিংবা শীতের পরেই কোকিলের ডাক জানিয়ে দেয়, ‘বসন্ত এসে গেছে’...এ গুলোই সেই সমস্ত ইতিবাচক দিক। আমার এক দোস্তজী এক সময় বলেছিল, মৃত্যু মানে ফুরিয়ে যাওয়া নয়। এক শক্তি থেকে আর এক শক্তিতে রূপান্তর। ছবিতে প্রসূন সেটাও তো দেখালেন! পলাশ শফিকুলকে ছেড়ে যেতে পারল কই? কোকিলের কুহু ধ্বনির মধ্যে দিয়ে অনবরত কথা বলেই চলল বন্ধুর সঙ্গে। যেন বলল, ‘এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়!’ ছবিতে একটি দৃশ্য আছে। পুকুরে বাজ পড়ে পলাশের মৃত্যু হবে। তার পর থেকে শফিকুল আর ঘাটের পাশে দিয়ে যাওয়ার সময় চোখ মেলে তাকাতে পারে না! আমার এক দল সারমেয় সন্তান। তাদের এক জন বাড়ির একটি বিশেষ জায়গায় আমায় ছেড়ে চলে গিয়েছে। অনেক বছর পেরিয়ে গিয়েছে। এখনও আমি ওই জায়গার দিকে ভাল করে তাকাতে পারি না!

এ রকম আরও কত দৃশ্যের কথা বলব? ছেলের মৃত্যুর পরে মায়ের দু’বার মাত্র ভেঙে পড়া। তাও উচ্চকিত নয়! আমি ছবিটা দেখতে দেখতে শিখলাম জয়তী চক্রবর্তীর থেকে। ২৬ বছর ধরে অভিনয় করছি। কিন্তু আমি ও ভাবে সংযত আবেগ দেখাতে পারি না! দ্বিতীয় বার ছবি দেখতে বসে দেখলাম, প্রজাপতি যখন উড়ে যাচ্ছে, পলাশের মায়ের চোখ বেয়ে জল ঝরছে। শফিকুল যেন প্রজাপতির মধ্যে তার বন্ধুর মুক্তি দেখছে। পলাশের ছোট্ট বোন কিন্তু স্বন্ত্রস্ত ভাবে মায়ের দিকে তাকিয়ে। সে বুঝতে চেষ্টা করছে মায়ের অনুভূতি। এটা তো প্রসূনের মাথা থেকেই বেরিয়েছে, তাই না? অনেকে হয়তো বলতে পারেন, রাম জন্মভূমি, বাবরি মসজিদ দেখানোর খুব দরকার ছিল? তাদেরকে আমার পাল্টা প্রশ্ন, তাতে কি ছবির গতি থমকেছে? না থমকালে, সমস্যা কোথায়! বরং ওই দ্বন্দ্বর পরেও ইদে পলাশ-সফিকুলের ছবি তোলা, সিমুয়েইর পায়েস কলাপাতায় মুড়ে বন্ধুকে দেওয়া কিংবা মজসিদ তৈরির বালি চুরি করে ঝুলনের আসর সাজানো— অনেক স্বাভাবিক দেখিয়েছে। পাশাপাশি, প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের চেহারায় কী মিল! ছেলের সঙ্গে মায়ের। কিংবা দিদির সঙ্গে ভাইয়ের। আরও মজার বিষয়, সবাই এক সুরে কথা বলে গিয়েছেন। স্থানীয় ভাষা যেন তাতে আলাদা মর্যাদা পেয়েছে। যা চট করে দেখাই যায় না। আর কেউ তো অভিনয় করেনইনি! এত স্বাভাবিক।

 

 

অনেকে আমায় এও জিজ্ঞেস করেছেন, বন্ধুত্বের কথা বললে বলিউডের ‘শোলে’র পরে কি বাংলার ‘দোস্তজী’? আমি বলব, যে ছবি বিশ্বমানের তাকে দেখে "দ্য বয় ইন দ্য স্ট্রাইপড পায়জামাস"-এর কথা মনে পড়বে। কিংবা কিছু জায়গায় "চিলড্রেন অফ হেভেন"-এর সঙ্গে মিল পেলেও পেতে পারেন। আমার তো আরিফ শেখ, আশিক শেখের সঙ্গে পরিচালকের বন্ধুত্বকে পরিচালক মাজিদ মাজিদির কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। বিশ্ববরেণ্য পরিচালকও ঠিক এ ভাবেই ছোটদের ক্যামেরায় ধরতেন। বাকি ক্যামেরার কাজ। সবাই ছবি দেখে বলছিলেন, সংলাপ কত কম। বেশ লাগছিল। আমি বলব, সেই ফাঁক ভরিয়ে দিয়েছেন সিনেমাটোগ্রাফার তুহিন বিশ্বাস। ওঁর প্রত্যেকটা ফ্রেম ক্যানভাস। প্রতিটি দৃশ্য কথা বলেছে, এত জীবন্ত! কিন্তু কোথাও ছবিকে ছাপিয়ে যায়নি। এটাই পরিচালকের সঙ্গে এক জন সিনেমাটোগ্রাফারের আন্তরিক দোস্তি!

খুব শিগগিরি আমিও পরিচালনায় আসছি। তার আগে এই ছবি দেখে প্রচুর কিছু শিখে নিলাম। যা আমার ছবিতে ব্যবহারের চেষ্টা করব। প্রসূনের কাছে শুধু একটাই আর্জি, তোমার পরের ছবিতে খুঁত ধরার ফাঁকটুকু রেখো। এত নিখুঁত ছবি দেখলে রাতের ঘুম নষ্ট হয়। কারণে, অকারণ কেঁদে ফেলি। আর বুকের ভিতরটা শিরশিরিয়ে উঠতে থাকে। খালি খচখচ করে, একটা ছবি এত নিখুঁত, নির্ভুল! হয় কী করে?

আরও পড়ুন:

নানা কারণে প্রচুর সমঝোতা করেছি, প্রসূন তুমি আমার মতো সমঝোতা করো না: প্রসেনজিৎ

বাংলা ছবির উন্নতি নিয়ে আলোচনা, সেখানে হরনাথ, জিৎ, অনুপ সেনগুপ্তই নেই? প্রশ্নে চিরঞ্জিৎ

‘৩৫০-র উপর ছবি করেও গোল্ডেন শিখা পেলাম না!’, ‘দোস্তজি’ নিবেদন করে প্রসূনের পাশে প্রসেনজিৎ