সংক্ষিপ্ত

২১ অক্টোবর সকাল ৬টায় দিল্লির উদ্দেশে যাত্রা। কৌসানির ২০ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত যে রাস্তার ধস সরানো গিয়েছে তার খবর ছিল। কিন্তু তারপর। কারণ কৌসানি থেকে দিল্লি তো আর এক-আধ কিলোমিটার নয়- পাক্কা সাড়ে চারশো কিলোমিটারেরও বেশি রাস্তা। 

ভীমতাল (Vimtaal) পেরিয়ে নৈনিতাল (Nainital) সড়কের পাকদণ্ডীটা ধরে ফেলল ১৪ আসনের ট্র্যাভেরাটা (Uttarakhand Natural Calamity)। দিনের তখন পড়ন্ত সময়। আকাশের বুকে ক্রমশ অপসরমান সূর্যের আলোটা বলছে যে সন্ধ্যা আসন্ন। ১১ দিন আগেই প্রায় মধ্যরাতে এই পাকদণ্ডী বেয়ে আমাদের ট্র্যাভেরাটা উঠেছিল নৈনিতালের উদ্দেশে (Nainital Natural Disaster)। চোখের সামনে ভিড় করে আসছে একগুচ্ছ সুন্দর সব মুহূর্ত। প্রায় ২ বছরের গৃহবন্দিদশা (Coronavirus Pandemic) কাটিয়ে এক মুক্ত হাওয়ায় শ্বাস নেওয়ার আনন্দ ছিল সকলের চোখে-মুখে। কিন্তু সেই দিনের তুলনায় ১১দিনের মাথার এই সফরে সকলের মুখে এক আতঙ্ক এবং চিন্তার ছাপ। কারণ, এখান থেকে দিল্লি (New Delhi) তখনও ৩০০ কিলোমিটারের বেশি দূরত্বের এক গন্তব্যস্থল। 

নৈনিতাল সড়কের সেই পাহাড়ি রাস্তার পাকদণ্ডী কেটে আমাদের গাড়ি যত নিচে নামছে ততই দেখা মিলছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সেই ভয়াবহ রূপ (Uttarakhand Rain)। ১১ দিন আগের মধ্যরাতের যে রাস্তা এক অপরূপ মায়াবি পট তৈরি করেছিল আজ সেখানে মাঝে রাস্তার মাঝে ভূমিধসের চিহ্ন (Uttarakhand Landslides)। কোথাও পাহাড়ের উপর থেকে নেমে এসেছে বিশাল বিশাল পাথর। মনে হচ্ছে কেউ যেন উপর থেকে তাল-তাল পাথর-কে ধাক্কা মেরে দিয়েছে। কোথাও আবার উপরে পড়ে রয়েছে গাছ। ধ্বংস্তূপগুলোকে কোনওমতে রাস্তার একটা দিকে জড়ো করে গাড়ি চলাচলের রাস্তা করে দেওয়া হয়েছে। কোথাও ভূমিধসের জেরে পাহাড়ের উপর থেকে নেমে আসা ঝর্ণা-র বেগ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। কোথাও আবার তৈরি হয়েছে নতুন জলধারার স্রোত। এদের কাদামাখা জল রাস্তার ঢাল বেয়ে স্রোতের মতো নেমে যাচ্ছে নিচের দিকে। রাস্তার অন্যপাশে অনেকটা নিচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে একটা নদী। যার কাদামাখা জল বলে দিচ্ছে উত্তরাখণ্ডের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ছবিটা কতটা ভয়ঙ্কর। এই নদীর মধ্যে গিয়ে সমানে পড়ে যাচ্ছে রাস্তার বিভিন্ন পাশ থেকে নেমে আসা ঝর্ণার জল। 

আরও পড়ুন- Uttarakhand: উত্তরাখন্ডে ট্রেকিংয়ে গিয়ে নিখোঁজ হওয়া আরও ১ বাঙালির মিলল দেহ, শোকের ছায়া রাজ্যে

আমরা কৌসানি থেকে দিল্লির উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলাম ২১ অক্টোবর সকাল ৬টায়। তখনও জানতাম না আদৌ দিল্লি পৌঁছতে পারবো কি না। কৌসানির ২০ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত যে রাস্তার ধস সরানো গিয়েছে তার খবর ছিল। কিন্তু তারপর। কারণ কৌসানি থেকে দিল্লি তো আর এক-আধ কিলোমিটার নয়- পাক্কা সাড়ে চারশো কিলোমিটারেরও বেশি রাস্তা। তারপরে আবার সোজা রাস্তায় যাওয়া কার্যত অসম্ভব। রাস্তায় বেরিয়ে রাস্তা খুঁজে খুঁজে এগোতে হবে। পাহাড়ের উপরে রাস্তার দূরত্ব আর সমতলে রাস্তার দূরত্বের অতিক্রম সময় এক নয়। সাড়া চারশো কিলোমিটার রাস্তা পাহাড়ের উপর থেকে নেমে আসা মানে অন্তত ১৪ থেকে ১৫ ঘণ্টার সফর। এরমধ্যে উত্তরাখণ্ডের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জেরে রাস্তার অতিক্রম সময় যে বাড়বে তাতে আমাদের কোনও সন্দেহ ছিল না। 

মুন্সিয়ারির অপরূপ প্রাকৃতিক শোভা আর হোটেলের ঘর থেকে পঞ্চচুল্লির মনমুগ্ধ করা সৌন্দর্য উপভোগ করে আমরা বেরিয়য়ে পড়েছিলাম কৌসানির উদ্দেশে। মুন্সিয়ারির রাস্তার যে অবস্থা শোচনীয় হয়ে রয়েছে তা সেখানে ঢোকার মুহূর্তেই প্রত্যক্ষ করা গিয়েছিল। মুন্সিয়ারি থেকে সকালে রওনা দিয়ে আমরা কৌসানি-তে যখন প্রবেশ করেছিলাম তখন বিকেল ৫টা। তারিখটা ছিল ১৭ অক্টোবর। কৌসানির কুমায়ুন মণ্ডল বিকাশ নিগমের তথা কেএমভিএন-এর অতিথিশালার রিসেপশনের সামনে আমাদের গাড়ি থামার মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। আমাদের কটেজের বারান্দায় পৌঁছতেই চোখের সামনে বিশাল পাহাড়ি উপত্যকার উপরে আস্তে আস্তে দখল নিয়ে নিল ঘন মেঘ। পেঁজা তুলোর মতো সেই মেঘের সারি কিছু সময়ের মধ্যে পুরো এলাকার দখল নিয়ে নেয়। তখন এক হাত দূরের জিনিসও ভালো করে দেখা যাচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল ঘন কুয়াশার চাদর পুরো কৌসানিকে গিলে নিয়েছে। এদিকে ঝিরঝিরে বৃষ্টি চলছিল। কিন্তু এই বৃষ্টি যে পরবর্তীয় ৪৮ ঘণ্টাতেও যে থামবে না তা ঠাহর করতে পারিনি আমরা কেউই। 
আরও পড়ুন- উত্তরাখণ্ডে ট্রেকিংয়ে গিয়ে বাংলার ৫ জনের মৃত্যু, প্রাণ হারালেন ঠাকুরপুকুরের বাসিন্দাও

আমাদের উত্তরাখণ্ড সফর শুরু হয়েছিল নৈনিতাল দিয়ে। সেখান থেকে আলমোড়া হয়ে বিনসার, চাকোরি হয়ে মুন্সিয়ারি এবং সবশেষে কৌসানি। ১৭ অক্টোবর কৌসানি পৌঁছে আমাদের সেখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা ছিল ১৯ অক্টোবর নৈনিতালের উদ্দেশে। সেখানে এক রাতের বাস সেরে ২০ অক্টোবর দিল্লি যাত্রা এবং সেই রাতেই দিল্লির অনন্ত বিহার থেকে স্পেশাল ট্রেনে কলকাতায় ফেরার টিকিটও কাটা হয়েছিল। ১৭ অক্টোবর থেকে কৌসানি-তে এমন বৃষ্টি শুরু হয়েছিল যে পরের দুদিন গৃহবৎ জীবন। আর মাঝে মাঝে মাথায় জ্যাকেট চাপিয়ে বৃষ্টির মধ্যে ডাইনিং রুমে যাওয়া খাবারের সন্ধানে। বৃষ্টির প্রতাপ দেখে এমন মনে হচ্ছিল যে হয়তো আমাদের কটেজটাই গুড়িয়ে যাবে। আর বৃষ্টি শুরু হতেই অধিকাংশ কটেজেই ছাদ ফুরে জল ঘরের মধ্যে টপাটপ পড়ে যাচ্ছিল। কোনওমতে বালতি দিয়ে, টাওয়াল পেতে জলের ছড়িয়ে যাওয়াটা আটকানোর চেষ্টা করছিল আমাদের মতো অনেকেই। কেএমভিএন কর্তৃপক্ষের মতে এমন বৃষ্টি বহু বছর হয়নি। 
দেখুন ভিডিও- উত্তরাখন্ডে গিয়ে আটকে বর্ধমানের তিন পর্যটক, সেখান থেকেই উদ্ধারের আবেদন জানিয়ে পাঠালেন ভিডিও

পাহাড়ে যে গোল বেধেছে তা ঠাহর করা গিয়েছিল ১৯ অক্টোবর সকালেই। ওই দিন সকালেই আমাদের রওনা হওয়ার কথা ছিল নৈনিতালের দিকে। লাগেজ গুছিয়ে, ড্রেস করে আমরা সকলেই তৈরি। তখনও অঝোর ধারায় বৃষ্টি হয়ে চলেছে। একটা কটেজ থেকে আর এক কটেজে যেতে প্রায় ভিজে চুপসে যাওয়ার মতো অবস্থা। গাড়ির চালক সটানে জানিয়ে দিল- টানা আড়াই দিনের বৃষ্টিতে সব রাস্তা বন্ধ। ধসে বিপর্যস্ত কৌসানি থেকে নৈনিতাল এবং কুমায়ুন রেঞ্জের অধিকাংশ এলাকা। কৌসানির ৭ কিলোমিটারে মধ্যে ধসে রাস্তা বন্ধ। তাই আপাতত কৌসানির অতিথিশালায় চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া আর কোনও গতি নেই। এমনকী যে নৈনিতালে আমরা ৮ দিন আগেই ছিলাম সেখানে নৈনি লেক সীমানা ছাপিয়ে রাস্তায় উঠে এসেছে। নৈনিতালে ঢোকার সমস্ত রাস্তা বন্ধ। 

কৌসানি পৌঁছানোর পর থেকেই বিদ্যুৎ-এর সংযোগ যেন লুকোচুরি খেলছিল। টানা বৃষ্টির জেরে অধিকাংশ সময়টাও বিদ্যুৎ সংযোগ থাকছিল না। তারমধ্যে ১৯ অক্টোবর দুপুর থেকে ইন্টারনেট সংযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। সন্ধ্যার আগে এয়ারটেল(Airtel), ভোডাফোন-এর (Vodaphone) সমস্ত কানেকশন ডেড। টিমটিম করে জ্বলছিল বিএসএনএল-এর (BSNL) নেটওয়ার্ক (Mobile Network)। রাতে তাও অস্তাচলে চলে গেল। ফলে পুরো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। নিকট জনেদের সঙ্গে যোগাযোগ এবং বিপর্যয়ের হাত এড়িয়ে কীভাবে নিরাপদে ফিরবো তার সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ। যদিও, এসবের আগে একটাই কাজ আমরা করতে পেরেছিলাম- আর সেটা হল ২২ অক্টোবর দিল্লি থেকে রাজধানীর (Rajdhani Express) টিকিট কেটে ফেলা। 

১৯ অক্টোবর বিকেল থেকে বৃষ্টি বন্ধ হল কৌসানিতে। মেঘ ও রোদের খেলায় তার প্রাকৃতিক শোভাকে মেলে ধরল কৌসানি। কেন তার মন মুগ্ধ করা প্রাকৃতিক শোভা পর্যটকদের বুদ করে রাখে তা ক্ষণে ক্ষণে যেন প্রমাণ দিচ্ছিল কৌসানি। বিপদ মাথায় করে কৌসানিতে টিকে থাকা আমাদের মতো পর্যটকরা তখন আনন্দে আত্মহারা। মনে হচ্ছে জীবন যায়-যাক কিন্তু এমন ক্ষণে কুমায়ুন রেঞ্জের এমন রূপ সত্যিকারেই এক পরম পাওনা। 

কৌসানির উপত্যকায় তখন মেঘ সরে নীলাকাশ। দিকচক্রবাল থেকে বেরিয়ে আসছে একের পর এক বরফঢাকা শৃঙ্গের সারি। হাতিগুম্ফা থেকে শুরু করে চৌখাম্বা, নীলকণ্ঠ, নন্দীদেবী, নন্দাকোট, ত্রিশূল, মৃগথেলি, পঞ্চচুল্লি এবং আরও অনেক শৃঙ্গ- যার সব নামটাও আমরা জানতে পারিনি। মেঘ-রোদের খেলায় কৌসানির উপত্যকায় তৈরি হল একের পর রামধনু। 

১৯ অক্টোবর সন্ধ্যায় একেপর এক পর্যটক ঢুকতে শুরু করল কৌসানিতে। এদের অধিকাংশেরই অবশ্য কৌসানিতে বুকিং ছিল না। চাকোরি থেকে এদের কারও গন্তব্য ছিল মুন্সিয়ারি, কারও আবার বিনসার। কিন্তু, রাস্তা বন্ধ থাকায় কেএমভিএন থেকে এদের কৌসানিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। কৌসানি ও চাকোরি রাস্তায় অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতি হয়েছিল তখনও। ফলে এই রাস্তা দিয়ে অনেক পর্যটকই কৌসানি আস্তে পারছিল। রাতে জানা গেল কৌসানি ও চাকোরির মধ্যে রাস্তাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। 

২০ অক্টোবর বিকেলে নেটওয়ার্কের খোঁজে কৌসানি-র কেএমভিএন অতিথিশালা থেকে ১০ কিলোমিটার নিচে আমরা নেমে গেলাম। ধস কবলিত এলাকা পেরিয়ে অনেকটা নিচে নামলাম। মিলল নেটওয়ার্ক। ফের বাড়ির সঙ্গে কথা। চালু হল ইন্টারনেট। দেখা গেল দেড় দিনে হোয়াটসঅ্যাপে কয়েক শ-মেসেজ, সঙ্গে কললিস্টে অগুণিত সব মিসড কল। হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজের অধিকাংশই উদ্বেগে ভরা। আমরা উত্তরাখণ্ডে কোন অবস্থায় রয়েছি জানতে চেয়ে মেসেজ। 

২০ অক্টোবর রাতে অতিথিশালার ডাইনিং-এ একটি বাঙালি পরিবারের সঙ্গে দেখা হল। জানলাম তারা রাতভর আলমোড়া-তে আটকে ছিলেন। বুঝলাম কৌসানি থেকে আলমোড়া অন্তত যাওয়া যাবে। ২১ অক্টোবর সকালে কৌসানি-কে বিদায় জানিয়ে শুরু হয়েছিল আমাদের দিল্লি সফর। সমস্ত বিপদের সম্ভাবনাকে মাথায় রেখে কপাল ঠুকে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তায় মাঝে মাঝে সামনা-সামনি হল অসংখ্য ধসের। বোঝা গেল ধসের স্তূপকে একপাশে সরিয়েই আপাতত রাস্তা তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। কৌসানি থেকে সোমেশ্বরের চৌমাথায় পৌঁছে জানা গেল রানিখেতের রাস্তা বন্ধ রয়েছে। সুতরাং আমাদের আলমোড়া দিয়েই বের হতে হবে। 

ধসের পাশ কাটিয়ে কাটিয়ে আমাদের গাড়ি পৌঁছল আলমোড়া। কিন্তু, সেখানেও বাইপাস বন্ধ। এই বাইপাসের পাশএই রয়েছে স্বামী বিবেকানন্দের ধ্যানাগার। যেখানে স্বামীজি ধ্যান করতেন। সেই ধ্যানাগার চোখে পড়লেও রাস্তা ধসের জন্য বন্ধ। গাড়ি ফের ঘোরাতে হল অন্য রাস্তায়। এর ফলে রাস্তার দূরত্ব আরও ১০০ কিলোমিটার বেড়ে গেল। এদিকে, গোদের উপর তখন বিষফোড়া। কারণ, গাড়িতে তেল নেই। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে পাহাড়ের উপরে থাকা তেল পাম্পগুলিতে ট্যাঙ্কার ঢোকেনি। ফলে তেল নেই। আর যেটুকু তেল যে পাম্পগুলিতে রয়েছে, তা তারা স্থানীয় গাড়িতে দিচ্ছে। কোনওভাবেই বাইরের নম্বর প্লেটওয়ালা গাড়িগুলোকে তেল দিচ্ছে না। 

অথচ আমাদের গাড়িতে যে পরিমাণ তেল তখন ছিল তাতে আমরা খুব বেশি হলে ৬০ কিলোমিটার রাস্তা যেতে পারবো। গাড়ি চালক শঙ্কর অনেক ঝুঁকি নিয়ে পাহাড়ের ঢালে স্টার্ট বন্ধ করে গাড়ি চালাল। এভাবে আমরা অনেকটা রাস্তা পার করলাম। অনেক কষ্টে শঙ্কর ব্ল্যাকে ১০ লিটার তেল ১৩০ টাকায় জোগাড় করে আনল। তাই দিয়ে আমরা পৌঁছালাম ভোওয়ালি। সেখানে তেলের পাম্পে তেল ভরা হল গাড়িতে। 

ভোওয়ালি থেকে সরাসরি হলদওয়ানি রাস্তায় ঢোকার চেষ্টা করলাম আমরা। কিন্তু কয়েক কিলোমিটার যাওয়ার পর ফের গাড়ির মুখ ঘুরিয়ে নিতে হল। কারণ রাস্তা বন্ধ। আমাদের ভীমতাল হয়ে হলদওয়ানির দিকে যেতে হবে। ভীমতাল হয়ে নৈনিতাল সড়কের পাকদণ্ডীতে যখন আমাদের গাড়ি পড়ল তখন সন্ধে নেমেছে। হলদওয়ানি ছাড়িয়ে মোরাদাবাদে সাগর রত্ন ধাবার সামনে যখন গাড়ি থামল তখন রাত ৯টা। জিপিএস বলছে দিল্লি তখনও ২৯০ কিলোমিটার। দিনভর আমাদের কারওই খাওয়া-দাওয়া নেই। অনিশ্চয়তায় ভরা এই সফরে সকলেরই চোখে-মুখে আতঙ্ক-চিন্তা। বাচ্চারাও দীর্ঘ সফরে ক্লান্ত-অবসন্ন। কারও কারও শরীর বেশ খারাপ। 

সাগর রত্ন ধাবায় গ্রোগাসে খাবার খাওয়ার পর ফের যাত্রা শুরু। চালক শঙ্কর তখনও কিছু মুখে তোলেনি। আমাদের মধ্যে সেদিন তাঁর সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম হয়েছে। পাহাড়ি ছেলে ধৈর্য এবং স্থৈর্য মারাত্মকরকমের। জানিয়ে দিল যতক্ষণ ও আমাদের নিরাপদে দিল্লির হোটেলে নিয়ে যাচ্ছে ততক্ষণ কিছু খাবে না। কারণ, খেলেই চোখে ঘুম চলে আসবে। 

রাত সোয়া একটা। সামনের বিশাল তোরণদ্বারটা দেখাল দিল্লি আর মাত্র ৩০ কিলোমিটার। দিল্লির বাইপাসের রাস্তার আঁকি-বুকি কেটে হোটেলের সামনে গাড়ি যখন পৌঁছল তখন ঘঁড়ির কাটা রাত ২টো অতিক্রম করেছে। দিল্লি স্টেশনের পাশেই জিঞ্জার হোটেলে রেলওয়ে যাত্রী নিবাসে আমরা ঘর বুক করে নিয়েছিলাম। শঙ্করকে বিদায় জানিয়ে হোটেলের রুমে স্নান করে করে যখন শুতে গেলাম রাত তখন সাড়ে তিনটে। মোবাইলের ইন্টারনেট অনেকক্ষণ সচল হয়ে গিয়েছে। নোটিফিকেশনে সামনে এল এশিয়ানেট নিউজ বাংলার একটা ভিডিও নিউজ। বাঁকুড়ার সাত বন্ধু পিথোরাগড়ে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে আটকে পড়েছে। এরা সকলেই মধ্যবয়সী। রাস্তা ভেঙে ও ধসে বিপর্যস্ত চারপাশ। পায়ে হেঁটে অনেকে বের হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পারেননি। অনেকেই অসুস্থ হয়ে ফের হোটেলে ফিরে গিয়েছেন। হাতের অর্থও শেষ হয়ে আসছে। তাদের কাতর প্রার্থনা যদি তাঁদের কোনওভাবে হেলিকপ্টার লিফটিং-এ উদ্ধার করা যায়। 

উত্তরাখণ্ডের প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে নিরাপদে দিল্লি পৌঁছানো নিয়ে আমরা ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিচ্ছিলাম। কিন্তু যারা আটকে রয়েছে তাঁদের কী হবে? চিন্তা থেকেই গেল, আর মনের মধ্যে গেড়ে বসল এক নিদারুণ অসহায়তা। 

লেখক- দেবজ্যোতি চক্রবর্তী, এডিটর, এশিয়ানেট নিউজ বাংলা- দেবজ্যোতি তাঁর পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে উত্তরাখণ্ড ভ্রমণে গিয়েছিলেন ১০ অক্টোবর। হাওড়া থেকে রাজধানী এক্সপ্রেসে তিনি ও তাঁর পরিবার দিল্লি পৌঁছন ১০ তারিখ দুপুরে। সেদিন রাত ১টায় পৌঁছন নৈনিতাল। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় তিনি কৌসানিতে পরিবার নিয়ে আটকে পড়েছিলেন। দিল্লি থেকে ২২ অক্টোবর রাজধানী এক্সপ্রেসে ওঠার পর এই প্রতিবেদন তিনি তৈরি করেন।

YouTube video player