থাইল্যান্ড এবং কম্বোডিয়ার মধ্যে এক দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ সীমান্ত সংঘাতে কমপক্ষে ১২ জন নিহত হয়েছে। দশকের পুরনো ভূখণ্ড নিয়ে বিরোধের জের ধরে রাজনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে এবং জাতিসংঘের হস্তক্ষেপের আহ্বান জানানো হয়েছে।

থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়ার ভূখণ্ড নিয়ে বিরোধ অব্যাহত। দুই দেশের মধ্যে এক দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে চলছে ভয়াবহ সংঘাত। এই সংঘাতে শেষ হয়ে গিয়েছেন ১২ জনেরও বেশি মানুষ।

 থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়ার যুদ্ধ:

থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার সীমান্ত ডানগ্রেক (Dangrek) পর্বতসঙ্কুল এলাকা। থাইল্যান্ডের অভিযোগ, সেখানে কম্বোডিয়ার ড্রোন দেখা গিয়েছে। দুই দেশের মধ্যে গুলি বিনিময় হয়েছে, রকেট হামলা হয়েছে। এমনকী যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে এয়ারস্ট্রাইকও হয়েছে। ঝরেছে প্রাণও। ঠিক যে সীমান্ত এলাকা দুই দেশের দ্বন্দ্ব, তার বীজ বপন হয়েছিল ফ্রান্সের উপনিবেশ থাকাকালীন। ওই এলাকাতেই রয়েছে ৩টি প্রাচীন হিন্দু মন্দির, যা তৈরি হয়েছিল ১১ শতকে।

প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত নিয়ে বিরোধ কেন:

ঔপনিবেশিক অতীতের প্রভাব

থাইল্যান্ড এবং কম্বোডিয়ার ৮০০ কিলোমিটার (৫০০ মাইল) দীর্ঘ সীমান্ত মূলত ১৮৬৩ থেকে ১৯৫০-এর দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ইন্দোচীনের ফরাসি দখলদারিত্বের সময় অঙ্কিত হয়েছিল। থাই রাজনৈতিক বিজ্ঞানী থিটিনান পংসুধিরাক বলেছেন যে ফরাসি এবং সিয়াম রাজ্যের মধ্যে -- থাইল্যান্ডের বর্তমান ভূখণ্ডকে ঘিরে – তৈরি হওয়া মানচিত্র আজও "সমস্যার মূল"। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে, সিয়াম কিছু কম্বোডিয়ান ভূখণ্ড অধিকার করেছিল কিন্তু ১৯৪৬ সালে ফরাসি শাসনে সেগুলি ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়। ১৯৭৯ সালে কম্বোডিয়ার কমিউনিস্ট খেমার রুজ সরকারের পতন পরিস্থিতি আরও জটিল করে তোলে। ডজন ডজন কিলোমিটার এখনও বিতর্কিত এবং ২০০৮ সালে সীমান্তে অবস্থিত ৯০০ বছরের পুরনো, ইউনেস্কো স্বীকৃত প্রেয়া ভিহিয়ার মন্দিরের পাশে একটি ভূখণ্ড নিয়ে সামরিক সংঘর্ষ শুরু হয়। ২০০৮ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত মাঝেমধ্যে হামলার ফলে কমপক্ষে ২৮ জন নিহত এবং হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়।

নতুন সংকট

সর্বশেষ সংকট শুরু হয় ২৮ মে যখন একজন কম্বোডিয়ান সৈন্য থাই সেনাবাহিনীর সাথে সীমান্তে গুলি বিনিময়ে নিহত হয়, দুই পক্ষই দাবি করে যে তারা আত্মরক্ষার জন্য কাজ করেছে। স্থল সীমান্ত পারাপারে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল এবং শান্তি আলোচনা স্থগিত হয়েছিল।

বৃহস্পতিবার ভোরে উত্তর-পশ্চিম কম্বোডিয়ার সীমান্তবর্তী প্রেট ভিয়েরা প্রদেশে প্রথমে হামলা চালায় কম্বোডিয়া সেনা। তার পর থেকে দিনভর সেখানে তীব্র লড়াই চলছে। কম্বোডিয়ার বাহিনী ভারী কামান এবং রাশিয়ায় নির্মিত বিএম-২১ গ্রাড মাল্টিপল রকেট লঞ্চার ব্যবহার করায় প্রাথমিক ভাবে ক্ষয়ক্ষতি হয় তাইল্যান্ড সেনাশিবির এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলির। কিন্তু দ্রুত তাইল্যান্ড বায়ুসেনার ছ’টি এফ-১৬ যু্দ্ধবিমান প্রত্যাঘাত করে বলে সংবাদ সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে।

আন্তর্জাতিক বিচার

আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (ICJ) ১৯৬২ সালে প্রেয়া ভিহিয়ার মন্দিরের উপর এবং ২০১৩ সালে এর চারপাশের একটি ছোট ভূখণ্ডের উপর ফ্নম পেনের সার্বভৌমত্ব মঞ্জুর করে, কিন্তু থাইল্যান্ড এর এখতিয়ার স্বীকার করে না।

বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯০৭ সালে ফরাসি উপনিবেশ থাকাকালীন ওই এলাকায় একটি ম্যাপ তৈরি হয়। সেখানে কাম্বোডিয়াকে থাইল্যান্ডের থেকে আলাদা করে বোঝানো হয়। কাম্বোডিয়া ওই ম্যাপ সামনে রেখে দাবি করে এই এলাকা তাদের। অন্যদিকে ওই ম্যাপ অস্বীকার করে থাইল্যান্ড।

ইতিহাস

শুধু এই মন্দির এলাকা নিয়ে দুই দেশে ঝামেলা এমনটা নয়। অন্তত ১০০০ বছরের পুরনো প্রেয়া বিহার (Preah Vihear) মন্দির নিয়েও দুই দেশের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। এটি ভগবান শিবকে উৎসর্গ করা। পরে বৌদ্ধ মঠ হিসেবে পরিচিতি পেেয়ছে। ১৯৬২ এবং ২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক আদালত এই স্থাপত্যটির উপরে কাম্বোডিয়ার অধিকারে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু তা মানতে নারাজ থাইল্যান্ড। এটিও ডানগ্রেক পার্বত্য এলাকায় অবস্থিত। এখন এটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। খামায় রাজবংশের রাজা প্রথম সূর্যবর্মণ এটি নির্মাণ করেন। পরে এর আকার আরও বৃদ্ধি পায় দ্বিতীয় সূর্যবর্মণের আমলে।