সংক্ষিপ্ত

২০১১ সালে এক নতুন আশার আলো জ্বেলে বাংলায় পরিবর্তন এনেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়। ফেলে দিয়েছিলেন ৩৪ বছরের বাম শাসনকে। এরপর থেকে প্রতি নিয়ত নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ সামনে নিয়ে এগিয়েছেন। কিন্তু তার সঙ্গে বারবার বিতর্কে জড়িয়েছেন মমতার মন্ত্রী থেকে দলের সাংসদ এবং শীর্ষ নেতা থেকে দলের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলা কিছু প্রভাবশালী। পার্থ চট্টোপাধ্য়ায়ের ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর বাড়ি থেকে একের পর এক কালো টাকা এবং সম্পত্তির হদিশ মেলাটা মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়কে কার্যত কোণঠাসা করে দিয়েছে। 
 

বিষবৃক্ষ। বঙ্কিম সাহিত্যের সুবাদে এই শব্দটি আজ বাংলার সমাজ পাঠে একটা কালো শব্দে পরিণত হয়েছে। বিষবৃক্ষ নামক শব্দটার অবতারণা মানে যে এক চূড়ান্ত খারাপ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে একটি নির্দিষ্ট কিছুকে অবলম্বন করে। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের গ্রেফতারি এবং তার জেরে একের পর এক কোটি কোটি টাকার কালো অর্থ উদ্ধারও এখন যেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের উপরে বিষবৃক্ষের কালো ছায়াকে প্রকট করে তুলেছে। বিষবৃক্ষ একদিনে তৈরি হয় না বলেই দেখিয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই বিষবৃক্ষের মন্ত্রিসভা একদিনে তৈরি হয়নি। একের পর এক আর্থিক কেলাঙ্কারিতে দলের মন্ত্রীরা জড়িয়েছেন, কিন্তু প্রত্যেকবারেই সেভাবে কোনও কড়া পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়কে। 

কথায় আছে অন্যায়কে প্রশ্রয় দিলে অন্যায় একদিন সব নৈতিকতাকে গ্রাস করে। এসএসসি নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে ইডি যেভাবে পার্থ চট্টোপাধ্য়ায়ের ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর বাড়ি থেকে কোটি কোটি টাকা উদ্ধার করেছে এবং প্রচুর বেআইনি সম্পত্তির হদিশ পেয়েছে বলেও দাবি করেছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা, তাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায় এবার নিশ্চিতভাবেই ভুলটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। এমনকী যেভাবে পার্থ চট্টোপাধ্য়ায়ের অপসারণের দাবিতে যেভাবে দলের বিশিষ্ট কয়েক জন নেতা সরব হয়েছেন তা স্বাভাবিকভাবেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপরে একটা চাপ তৈরি করেছে বলেই মনে করা হচ্ছে। 

প্রথমে আসা যাক বর্তমান মন্ত্রিসভাকে ঘিরে তৈরি হওয়া একের পর এক বিতর্কে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বর্তমান মন্ত্রিসভা শপথ নিয়েছিল ১০ মে, ২০২১। এই মন্ত্রিসভায় মমতা স্থান দিয়েছিলেন ২৬ জন অভিজ্ঞ বিধায়কে এবং ১৬টি নতুন মুখ ছিল। এই মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের দিন কয়েক পরেই সিবিআই গ্রেফতার করেছিল মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম এবং সুব্রত মুখোপাধ্যায়-কে। এর সঙ্গে গ্রেফতার হয়েছিলেন মদন মিত্র। গ্রেফতার করা হয়েছিল শোভন চট্টোপাধ্যায়কেও। তবে, তিনি তৃণমূলে ছিলেন না আর বিজেপি-তে থাকলেও, ভোটে প্রার্থী হলেও দলীয় নেতৃত্বের উপর গোঁসা করে ফ্ল্যাটে খিল এঁটে বসেছিলেন। নারদকাণ্ডের জেরে এই গ্রেফতারি নিয়ে হুলুস্থুল পড়ে গিয়েছিল। প্রায় ৪ দিনের মাথায় জামিন পেয়েছিলেন ফিরহাদ, সুব্রত-মদনরা। এই ঘটনায় বিজেপি প্রবল হইচই করেছিল। এর সঙ্গে অবশ্যই লাগাতার বিতর্ক হয়েছে কয়লাকাণ্ড এবং গরু পাচারকাণ্ড নিয়ে। যেখানে বারবার অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ও রুজিরা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ইডি-র সমন পাঠানো নিয়ে বিতর্ক তৈরি হচ্ছিল। এর মাঝেই তৃণমূল কংগ্রেসের বর্ধমানের নেতা প্রণব চট্টোপাধ্যায়-কেও চিটফাণ্ডে জড়িত থাকায় গ্রেফতার করা হয়েছিল। এর সঙ্গে সাঁড়াশি চাপের মতো লেগেই ছিল গরু পাচারকাণ্ডে অনুব্রত মণ্ডলকে জেরার জন্য সিবিআই-এর বারবার সমন পাঠানো। এই পরিস্থিতির মধ্যে দুর্নীতির প্রশ্নে এবং আর্থিক তচ্ছরূপের প্রশ্নে বারবার বিদ্ধ হয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারা। যেভাবে দলের প্রবীণ নেতারা বারবার দুর্নীতির প্রশ্নে বিদ্ধ হচ্ছিলেন তাতে ক্ষোভে বেড়েছে দলের অন্দরেই। কয়েক মাস আগেও প্রকাশ্যে চলে এসেছিল মমতা অনুরাগী নেতা বনাম অভিষেক অনুগামীদের বাক্যবাণ এবং তর্কযুদ্ধ। প্রকাশ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এই নিয়ে প্রতিক্রিয়াও দিতে হয়েছিল। দলের সমস্ত স্তরেই এক কঠোর বার্তা দিতে হয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। আগুনে ঘি ঢালার মতোই সমানে কাজ করে যাচ্ছিলেন কুণাল ঘোষ থেকে শুরু করে কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, অপরূপা পোদ্দার, মদন মিত্ররা। যা পক্ষান্তরে বারবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সরকারকে সরাসসি নিশানা হওয়ার জায়গা ঠেলে দিয়েছিল। 

এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে এসএসসি নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টের কঠোর অবস্থান বলতে গেলে ছিল ডিনামাইট ব্লাস্ট করানোর মতো। কথায় আছে কান টানলে মাথা আসে। সেই পরিস্থিতি হয়েছিল পার্থ চট্টোপাধ্য়ায়ের। এসএসসি নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে ইডি-র জালে ধরাই পড়ে যান পার্থ। বাংলায় ক্ষমতায় আসার পর রাজনৈতিক জীবনে এতবড় আঘাত হয়তো মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায় পাননি। কারণ, ইডি-র এই নাগপাশ থেকে পার্থ উদ্ধার যে সম্ভব নয় তা বুঝতেই পারছিলেন। একটু হলেও আশা ছিল যে সময়ের সঙ্গে যদি এই ঘটনায় উত্তেজনাটা কমে আসে। সেটা তো হলোই না, উল্টে ২৭ জুলাই বেলঘড়িয়ায় অর্পিতা মুখোপাধ্য়ায়ের ফ্ল্যাটে নতুন করে ২৭ কোটি ৯০ লক্ষ টাকা উদ্ধারের পর পার্থ বিসর্জন আপাতত নিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। 

এবার আসা যাক চৌত্রিশ বছরের বাম শাসনকে হঠিয়ে মমতার বাংলার শাসন দখল করার পরের মুহূর্তের পরিস্থিতে। একের এক বিতর্ক। কখনও ত্রিফলা দুর্নীতি তো কখনও নীল-সাদা রঙের প্রলেপে লুকিয়ে থাকা কালোবাজারির অভিযোগ। এমনকী অর্থ নিয়ে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার চিট ফান্ড কেলেঙ্কারি। এখানেই শেষ নয় বিভিন্ন সরকারি দফতরে নিয়োগ থেকে বিভিন্ন কেন্দ্রীয় প্রকল্পে অর্থ নয়ছয়ের অভিযোগ-বারবার বিদ্ধ করেছে তৃণমূল কংগ্রেসকে। এর পিছন পিছন এসেছে নারদ কাণ্ড। এরমধ্যে চিটফান্ডকাণ্ডে সাংঘাতিকভাবে তৃণমূল কংগ্রেসকে ধাক্কা দিয়েছিল। কারণ সারদা থেকে টাওয়ার গ্রুপ চিটফান্ড, প্রয়াগ চিটফান্ড, রোজভ্যালি চিটফান্ডকাণ্ড, আইকোর চিটফান্ড কেস-- সবেতেই ঘুরে ফিরে জড়িয়েছিল তৃণমূল নেতা মন্ত্রী থেকে শুরু করে সাংসদ এবং তৃণমূলের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলা প্রভাবশালীদের নাম। এমনকি গ্রেফতার হতে হয়েছিল কুণাল ঘোষকেও। সারদা চিটফাণ্ড কেসে এক্কেবারে শুরুর দিকে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। কুণাল ঘোষ সে সময় খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে দুর্নীতিতে জড়িয়ে থাকার অভিযোগ এনেছিলেন। গ্রেফতার হতে হয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ তাপস পাল থেকে শুরু করে সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, তৎকালীন পরিবহণ মন্ত্রী মদন মিত্র-কেও। চিটফাণ্ডের রেশ মেলাতে না মেলাতেই নারদকাণ্ডে স্টিং অপারেশনে গোপন ভিডিও-তে টাকা নিতে দেখা গিয়েছিল। এতে নাম জড়িয়েছিল ফিরহাদ হাকিম থেকে শুরু করে শোভন চট্টোপাধ্যায়, শুভেন্দু অধিকারী, শঙ্কু পাণ্ডা, সুব্রত মুখোপাধ্যায়দের। এদের সকলকেই গোপন ভিডিও-তে লক্ষ লক্ষ টাকা নিতে দেখা গিয়েছিল। এমনকী মুকুল রায়ের বিরুদ্ধে সারদার হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মৎসাতের অভিযোগও ছিল। সিবিআই সেই সময় দফায় দফায় জেরাও করেছিল মুকুলকে। কিন্তু, পরবর্তীকালে মুকুল রায় প্রথমে দল থেকে নিজের দূরত্ব তৈরি করেন, এরপর তিনি বিজেপি-তে চলে যান। শুভেন্দু অধিকারীও একটা সময় বিজেপি-র বিরুদ্ধে চক্রান্তের অভিযোগ এনেছিলেন। ২০২১ সালে বিধানসভা ভোটের আগে তিনিও তৃণমূল থেকে বিজেপি-তে চলে যান। 

দেখা গিয়েছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার প্রথম ক্ষমতায় আসার বছর খানেকের মাথা থেকেই বারবার আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগে বিধ্বস্ত হয়েছে। যত সময় এগিয়েছে এই দুর্নীতির অভিযোগের মাত্রা কম হওয়ার লক্ষণ তো দেখাইনি উল্টে একের পর এক তৃণমূল নেতা-মন্ত্রী ও সাংসদ কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার হাতে গ্রেফতার হয়। কিন্তু, এতমাত্র মদন মিত্রের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়া ছাড়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা তাঁর দল অন্য কাউকে নিয়ে কঠোরতা অবলম্বন করেনি বা এমন কোনও বার্তা দেয়নি যাতে দুর্নীতি নির্মূল লড়াইয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এই সময়টা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশেই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যাবতীয় রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ ও কুৎসার মোকাবিলা করেছিলেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়। এই মুহূর্তে পার্থ-র গ্রেফতারি, কোটি কোটি টাকা উদ্ধারের ঘটনা, বেআইনি সম্পত্তির খোঁজের দাবি বুঝিয়ে দিচ্ছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যতই দুর্নীতির বিরুদ্ধে বড় বড় আস্ফালন করে থাকুন তাতে তাঁর ছত্রছায়ায় থাকা নেতাদের মূল্যবোধের উন্নতি এক্কেবারেই হয়নি। 

এই মুহূর্তে তৃণমূল কংগ্রেসের নবীন সদস্যদের মধ্যেও প্রশ্ন যে দলের অভিজ্ঞ নেতাদের যদি এই হাল হয় তাহলে ভেবে দেখার সময় এসেছে। রাজনীতি করতে গেলে অনেক কালিমা শরীরে লাগে। এরমধ্যে অনেকটা অংশ অবশ্যই সাধারণ মানুষের উপরে ছেড়ে দিতে হয়, তারাই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঠিক করেন আদৌ কোনও রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ আদৌও ঠিক না বেঠিক। কিন্তু, এর বাইরে একটা অংশ থাকে যেখানে দলকে সবসময় নিজেকে কার্যত গঙ্গার মতো পবিত্র থাকার অঙ্গিকার করে দেখাতে হয়। কিন্তু, বর্তমানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই সরকার যেভাবে একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগে ক্লিস্ট হয়ে পড়েছে তাতে অবিলম্বে সমস্ত মন্ত্রীকে সরিয়ে নতুন করে মন্ত্রিসভা গঠনের প্রয়োজন আছে বলেও তৃণমূল কংগ্রেসের একটা অংশ মনে করছে। 

পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে মন্ত্রিত্ব থেকে অপসারণের পর মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায় তাঁর সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন আপাতত ৩টি দফতর তাঁর কাছে এলেও মন্ত্রিসভার গঠন করেই এই দফতর বিলি করতে হবে। নতুন করে মন্ত্রিসভার গঠন মানে কি বোঝাতে চেয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়? তাহলে কি বর্তমান মন্ত্রিসভা ভাঙছে, আর সেই জায়গায় আসছে নতুন মন্ত্রিসভা। এটা এখন যতই জল্পনার পর্যায়ে থাকুক যদি বাস্তবায়িত হয় তাহলে তা হবে এক নজির বিহীন ঘটনা। তৃণমূল কংগ্রেসের অন্দরের একটা বিশাল অংশ মনে করছে যেভাবে দুর্নীতির অভিযোগ বিজেপি বা অন্য বিরোধীরা তৃণমূলকে আক্রমণ করছে তাতে নতুন মন্ত্রিসভার গঠন এই বিতর্কে জল ঢেলে দেবে।