সংক্ষিপ্ত
এহেন লক্ষীদেবী কিন্তু কোনো দেবী নন।আদতে তিনি একজন অসুর কন্যা। তাই বস্তুবাদ মতো বিষয়টি তার সঙ্গে সম্পর্কিত ।জেনে নিন লক্ষীদেবীর জীবনকাহিনি ।
আমরা জানি লক্ষী হলেন সম্পদের দেবী। বৃহস্পতিবার পাঁচালি পড়ে হোক বা কোজাগরী লক্ষীপূজোর দিন সারারাত জেগে ,- লক্ষীকে প্রসন্ন রাখা আমাদের জীবনের একটা অবশ্যকর্তব্য কাজ বলে মনে করেন অনেকেই। তো এহেন লক্ষীদেবী কিন্তু কোনো দেবী নন।আদতে তিনি একজন অসুর। ভাবছেন কি সব বলছি ? তাহলে শুনুন লক্ষীদেবীর জীবনকাহিনি ।
লক্ষীদেবী কোনো দেবতা নন। তিনি আদতে ছিলেন অসুর কন্যা। পুরান ঘটলে পাওয়া যায় যে লক্ষীর তিনজন পিতা । ভৃগু , পুলমান ও বরুন। হ্যাঁ , বরুণকে সমুদ্রের দেবতা বলা হলেও বৈদিক মতে কিন্তু তিনি ছিলেন একজন অসুর। ভৃগু ছিলেন অসুরদের গুরুদেব আর পুলমান ছিলেন অসুরদের রাজা। তো এহেন তিন অসুর পিতার সঙ্গে একসময় মাটির নিচেই বাস করতেন লক্ষী। একারণেই বলা হয় যে পৃথিবীর সমস্ত ধনসম্পদের অস্তিত্ব কিন্তু থাকে মাটির নিচেই। যেকোনো ফসলের অঙ্কুরোদগমও হয় মাটির নিচে। যেকোনো মূল্যবান ধাতু পাওয়া যায় মাটির নিচে। এমনকি জল যা কিনা প্রাণীজ সম্পদের আধার সেটাও মেলে মাটির নিচে। তো লক্ষীদেবীর আসল অবস্থান ছিল একসময় পাতালেই । কিন্তু লক্ষীর গুরুত্ব তখনই বৃদ্ধি পায় যখন তাকে তার বাপের বাড়ি থেকে বাইরে আনা হয় অর্থাৎ পাতাল থেকে তুলে আনা হয়। কোথাও অসুর-কন্যা হওয়ার কারণেই লক্ষীদেবীকে দেবতা বলা হলেও ,বস্তুবাদের মতো বিষয়টি তার সঙ্গে সম্পর্কিত ।
এখন আপনাদের মনে প্রশ্ন জাগবেই যে লক্ষী দেবী দেবতার আখ্যা পেলো কি করে ? আসলে লক্ষী নিজে অসুর হলেও তার বিবাহ কিন্তু হয়েছিল দেবতাদের সঙ্গে। বৈদিক যুগের অনুলোম-বিলোম প্রথার কথা মনে পড়ে ? বৈদিক যুগে কোনো নিচুবর্ণের পাত্রের সাথে কোনো উচ্চবর্ণের পাত্রীর বিয়ে হলে তাকে বলা হতো অনুলোম প্রথা। আর নিচুবর্ণের পাত্রীর সঙ্গে উচ্চবর্ণের পাত্রের বিয়ে হলে তাকে বলা হতো বিলোম প্রথা। বৈদিক যুগের সাথে যদিও লক্ষীদেবীর সরাসরি কোনো যোগাযোগ নেই, তবুও বৈদিক যুগে যে সমস্ত কাহিনিগুলো লোকমুখে প্রচলিত ছিল সেগুলোতে বর্ণিত আছে লক্ষীদেবীর বিবাহ হয়েছিল বিলোম প্রথা মেনে। তিনি অসুর হয়েও বিয়ে করেছিলেন দেবতাকে। তার বিবাহ নিয়েও আছে নানান মজার কাহিনি ।
কথিত আছে লক্ষীর যখন বিবাহের বয়স হলো তখন তার জন্য শ্রেষ্ঠ পাত্র খুঁজতে তার পিতারা রওনা দিয়েছিলো অমরাবতীর উদেশ্যে। স্বয়ং ইন্দ্রকে দিয়েছিলেন তারা জামাই হবার প্রস্তাব। ইন্দ্রও লক্ষীর রূপে গুণে মুগ্ধ হয়ে দিয়েছিলেন বিবাহে সম্মতি। মহা ধুমধাম ও মহাসমারোহে হয়েছিল তাদের বিবাহ। বিয়েতে উপহার দেবার রীতি তখনও ছিল , এখনও আছে। কথিত আছে লক্ষীও নাকি বিয়েতে পেয়েছিলেন অনেক অনেক উপহার। কিন্তু বেছে বেছে ঠিক চারটে উপহার এনেছিলেন তিনি ,তার শ্বশুরবাড়ি অমরাবতীতে। এই চারটি জিনিস হলো ,কল্পতরু , কামধেনু , চিন্তামণি ও অক্ষয়পাত্র। কল্পতরু হলো এমন এক আশ্চর্য্য বৃক্ষ যার সামনে দাঁড়িয়ে যা চাওয়া যায় তাই নাকি পাওয়া যায়। শ্বশুরবাড়ির লোকজনেরা যা চান তাই যাতে পান -সেই উদ্দেশ্যেই লক্ষী কল্পতরু বৃক্ষটি এনেছিল তার সঙ্গে। কামধেনু হলো এমন এক গাভী , যার সামনে দাঁড়িয়ে যে খাবারই চাওয়া যায় ,সেটাই নাকি মেলে। শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে রোজ রোজ ভালো-মন্দ খাইয়ে প্রসংশা কুড়োনোর উদেশ্যেই লক্ষীদেবী কামধেনুটিকে সঙ্গে করে এনেছিলেন অমরাবতীতে। চিন্তামণি হলো এমন এক আশ্চর্য্য মনি ,যার সামনে দাঁড়িয়ে যেমন গয়না চাই, ঠিক তেমন গয়নাই নাকি গড়ানো যেতো,। নিজেকে সবসময় সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতেই চিন্তামনিটি তিনি এনেছিলেন তার সঙ্গে। আর অক্ষয়পাত্র হলো এমন এক পাত্র যেটিতে খাদ্যশস্য ও সম্পদ সবসময় পরিপূর্ণ থাকে। শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে যাতে কোনোরকম কোনো অভাব -অনটনে পড়তে না হয় তাই এটিও তিনি এনেছিলেন তার সঙ্গে। তার ছোঁয়াতেই অমরাবতী হয়ে উঠেছিল স্বর্গ।
কিন্তু লক্ষীদেবী ছিলেন চঞ্চলা। তিনি , যে সবথেকে বেশি যোগ্য পুরুষ তার কাছেই চলে যেতেন বার বার। তাই ইন্দ্রের সিংহাসনটি ছিল বেশ নড়বড়ে। কারণ যোগ্যতম যে কোনও পুরুষই বসতে পারতেন ইন্দ্রের সিংহাসনে। আর যে বসতেন সিংহাসনে সেই পেতেন লক্ষীকে। তাই বলা হয় লক্ষীদেবীর একাধিক স্বামী । এই বিষয়টি নিয়েও একটি মজার কাহিনিও আছে।কথিত আছে একবার প্রহ্লাদের কাছে চলে গেছিলেন লক্ষীদেবী। প্রহ্লাদের প্রসাদেই তিনি বসবাস করছিলেন তার সঙ্গে। এদিকে ইন্দ্র ভাবলেন প্রহ্লাদের মধ্যে এমন কি আছে যা তার মধ্যে নেই ? লক্ষীদেবী কেন ইন্দ্রকে ছাড়লেন প্রহ্লাদের জন্য ? তিনি গেলেন ব্রহ্মার কাছে। বললেন যে করেই হোক লক্ষীদেবীকে ফিরিয়ে আনতেই হবে অমরাবতীতে । ব্রহ্মা তখন তাকে দিলেন এক দারুন বুদ্ধি। বললেন প্রহ্লাদের দাস হয়ে তার কাছ থেকে জানতে যে লক্ষীকে পাবার আসল কৌশলটা কি ? ইন্দ্র গেলেন প্রহ্লাদের প্রাসাদে ,প্রহ্লাদের ছায়াসঙ্গী হয়ে ঘুরতে লাগলেন তিনি। সেবা শুশ্রুষা কিছুতেই কমতি রাখলেন না ইন্দ্র ।কিন্তু তবুও প্রহ্লাদের পেট থেকে কথা বের করতে পারলেন না কিছুতেই। অবশেষে একদিন মদ্যপ অবস্থায় প্রহ্লাদ ইন্দ্রাকে বলে ফেললেন সব। বললেন লক্ষী তার কাছেই যান যে শুধু মুখে বলেন না কাজে করে দেখান। ব্যাস রহস্য উন্মোচন হতেই ইন্দ্র বুঝলেন এবার তাকে কি করতে হবে।করেও ফেললেন পরিকল্পনা মাফিক কাজ ।আর তাতেই লক্ষ্মী আবার ফিরে এলেন অমরাবতীতে।
একবার ইন্দ্র খুব অপমান করেছিলেন লক্ষীকে। প্রচন্ড অপমানিত হয়ে রাগে দুঃখে তিনি সমুদ্রের তলায় গিয়ে আশ্রয় নিলেন । এদিকে অমরাবতী লক্ষীহারা হলে, সারা স্বর্গলোকে দেখা দিলো অভাব- অনটন । দেবতারা ভাবলেন যে করেই হোক লক্ষীকে সমুদ্রের তোলা থেকে তুলতেই হবে। শুরু হলো সমুদ্রমন্থন। সমুদ্রমন্থন বিষয়টি আসলে একটি রূপক। বিশেষজ্ঞরা বলেন সমুদ্র এখানে বিশ্বজগৎ এবং অসুর আর দেবতারা হলেন ক্রেতা -বিক্রেতা। বাজারে ক্রেতা- বিক্রেতার সামঞ্জস্য থাকলে তবেই লক্ষীলাভ হয়। এই বিষয়টি বোঝাতেই রূপক হিসাবে গল্পে বলা হয়েছিল অসুর ও দেবতাদের মন্থনের। আবার অনেক গল্পকথা এমনও বলে যে দেবতাদের সঙ্গে অসুরদের এই লড়াই হতো লক্ষ্মীর জন্যেই। অসুররা তাদের ভগিনীকে ফিরিয়ে আনতে চাইতেন বার বার। তাই অসুরদের সঙ্গে দেবতাদের লড়াই সবসময় লেগেই থাকতো।
তবে সমুদ্রমন্থনের পর লক্ষী বোঝেন যে নারায়ণই শ্রেষ্ঠ পুরুষ। যার শ্রেষ্ঠত্বের কাছে কেমন যেন ফিকে হয়ে যায় সবকিছুই । একারণেই সমুদ্রমন্থনের পর লক্ষী বিবাহ করেছিলেন নারায়ণকে। তারপর থেকে তিনি নারায়ণের সেবা করার জন্য তার কাছে থেকে গেছিলেন সারাজীবন। বিবাহের সময় বিষ্ণু কথা দিয়েছিলেন লক্ষীকে যে, যাই হয়ে যাক না কেন তিনি সবসময় রক্ষা করবেন লক্ষীকে। সেই কথা তিনি রেখেওছিলেন সারাজীবন। এনিয়েও এক দারুন গল্পকথা আছে পুরানে। ভিনা নাম এক প্রচন্ড অত্যাচারী রাজার অত্যাচারে ভূদেবী অর্থাৎ লক্ষী একবার পৃথিবী ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। ভিনার এই অত্যাচারের দাপটে ঋষি মুনিরাও হয়ে উঠেছিলেন অতিষ্ট। একসময় তা সহ্যের সীমা পার করলে মুনিরা তাকে হত্যা করেন । ভিনার হত্যার পর তার ভালো গুণগুলি থেকে জন্ম হলো এক নতুন রাজার। ঋষিরা তার নাম দিলেন পৃথু। রাজার সিংহাসনে বসার পর পৃথু প্রথমেই বেরোলেন ভূদেবীকে খুঁজতে। কিন্তু সারা ব্রম্ভান্ড খোঁজার পরও কিছুতেই পাওয়া গেলো না ভূদেবীকে। ক্লান্ত পৃথু যখন পৃথিবীতে ফিরছেন, তখন তিনি দেখলেন ভূদেবী গরু সেজে লুকিয়ে আছেন এক জায়গায়। অনেক অনুনয় বিনয়ের পরও যখন ভূদেবী পৃথিবীতে ফিরতে চাইলেন না , তখন তার বিশ্বাস অর্জনের জন্য পৃথু করে ফেললেন এক ভয়ানক পন। পৃথু বললেন " আজ থেকে আপনি যখন যেখানে যাবেন আমি আপনার সঙ্গে সঙ্গে যাবো আপনাকে রক্ষা করতে। "কথিত আছে ভূদেবী যখন গরুরুপে নেমে এসেছিলেন পৃথিবীতে তখন পৃথুও তাকে রক্ষা করতে নেমে এসেছিলো "গোপালা" সেজে অর্থাৎ রাখাল সেজে। এই পৃথু নাকি ছিলেন স্বয়ং বিষ্ণু। এরপর পৃথুর তদারকিতে বেশ ভালোই দিন কাটছিলো ভূদেবীর। কিন্তু একসময় পৃথু ফিরে এলো স্বর্গে। তিনি স্বরগে ফিরতেই আবার শুরু হলো রাজাদের অত্যাচার। পৃথিবীর লোভী রাজারা আবার নির্মমভাবে অত্যাচার শুরু করলেন ভূদেবীর উপর। কি আর করবেন ভূদেবী ? চোখের জল ফেলে নালিশ জানালেন তিনি বিষ্ণুকে। বিষ্ণু অনেক ভেবে চিনতে ফাঁদলেন এক দারুন ফন্দি। তিনি একে একে মর্ত্যে পাঠালেন রাম , পরশুরাম , আর কৃষ্ণকে। এরা এক এক যুগে , এক এক ভাবে অত্যাচারী রাজাদের শাস্তি দিয়েছেন। সবই কিন্তু ভূদেবীকে রক্ষার তাগিদে।
তবে নারায়ণের সাথে যে লক্ষীর দাম্পত্য কলহ লেগেই থাকতো তার কাহিনীও মেলে পুরানে। কথিত আছে একবার ভৃগু তার মেয়ের সাথে দেখা করতে গেছিলেন বৈকুন্ঠে। গিয়ে দেখেন জামাই নারায়ণ ঘুমোচ্ছেন। আপ্যায়ন তো দূরের কথা শত ডাকাডাকির পরও ঘুম থেকে ওঠার নাম নিচ্ছেন না দেখে, তিনি নারায়ণের বুকে মারলেন এক লাথি। মারলেন ঠিক সেই জায়গায় যেখানে লক্ষীদেবী অবস্থান করতেন। ঘুম ভাঙার পর নারায়ণের বাড়িতে ভৃগুর আপ্যায়ন হলো ঠিকই কিন্তু লক্ষ্মীস্থানে লাথি মারার পরও নারায়ণ তার কোনও প্রতিবাদ না করায় , লক্ষীদেবী গেলেন প্রচন্ড রেগে। রাগের চোটে ছাড়লেন বৈকুন্ঠ। অনেক কাকুতি মিনতির পরও ফিরিয়ে আনতে না পেরে , নারায়ণ হৃদয়ভঙ্গের যন্ত্রণা নিয়ে আশ্রয় নিলেন দক্ষিণ ভারতের তিরুমালাতে। তিরুমালার বাসিন্দারা কেউই এই লক্ষ্মীহীন দরিদ্র -নারায়ণকে আশ্রয় দিতে রাজি হলেন না। উপায়হীন হয়ে নারায়ণ সিদ্ধান্ত নিলেন যে তিরুমালার রাজকন্যা পদ্মাবতীকে বিয়ে করে ওখানেই থেকে যাবেন বাকি জীবন। মেয়ে পাত্রস্থ হবে তাতে আপত্তি ছিল না পদ্মাবতীর বাবার কিন্তু বিয়ের আগে তিনি হাঁকলেন এক বিরাট অঙ্কের কন্যাপণ। সেই কন্যাপণ জোগাড় করতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খেতে হলো নারায়ণকে। উপায় না পেয়ে অবশেষে তিনি গেলেন কুবেরের কাছে। কুবের মেটালেন তার কন্যাপণ। কিন্তু এদিকে নারায়ণ আবার বিয়ে করছেন শুনে লক্ষীদেবীও এলেন ফিরে। তার জায়গা তো তিনি এইভাবে ছেড়ে দিতে পারেন না ? অবশেষে তিরুপতি মন্দিরে নারায়ণ বসবাস করতে লাগলেন তার দুই স্ত্রী লক্ষী ও পদ্মাবতীকে নিয়ে। তিরুপতি মন্দিরে তাই নারায়ণের পাশে দুজনকে দেখা যায়। অনেকেই বলেন এদের একজনের নাম ভূদেবী আর একজনের নাম শ্রীদেবী।
আরও পড়ুন জেনে নিন ধনদেবী লক্ষ্মীকে তুষ্ট করতে কোন নিয়মগুলি অবশ্যই মেনে চলতে হবে আপনাকে
আরও পড়ুন লক্ষ্মী পুজোর সঙ্গে কীভাবে জড়িয়ে রয়েছে জেগে থাকার বার্তা? জানুন 'কোজাগরী'-র প্রকৃত অর্থ
আরও পড়ুন ঘরের এই দিকে প্রতিষ্ঠা করুন দেবী লক্ষ্মীর মূর্তি, সম্পদ ঐশ্বর্যে ভরে উঠবে সংসার