সংক্ষিপ্ত

সেই সাইবাড়ি হত্যাকাণ্ড (Saibari Massacre) থেকে সাম্প্রতিক রামপুরহাট হিংসা (Rampurhat violence) - - বাংলার রাজনীতির ইতিহাস হিংসায় ভরা (History of political violence in Bengal)। কেন বদলায় না এই অবস্থাটা? 

অগ্নিগর্ভ রামপুরহাট (Rampurhat Violence)। সোমবার রাতে, বোমা হামলায় বীরভূমের (Birbhum) রামপুরহাট (Rampurhat) ১ নম্বর ব্লকের বড়শাল গ্রাম পঞ্চায়েতের (Barashal Gram Panchayat) উপ-প্রধান ভাদু শেখের মৃত্যুর পর রাতভর চলেছে তাণ্ডব। জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে ৭ থেকে ৮টি বাড়ি। পুলিশের হিসাবে মৃত্যু হয়েছে অন্তত ৮ জনের। সব মিলিয়ে ফের চরম রাজনৈতিক হিংসার (Political Violence) সাক্ষী বাংলা। বস্তুত, সেই সাইবাড়ি (Saibari Massacre) থেকে নন্দীগ্রাম (Nandigram Movement) হয়ে রামপুরহাট - বাংলার হিংসাত্মক রাজনীতির ঐতিহ্যটা একেবারেই বদলায়নি।

সাইবাড়ি হত্যাকাণ্ড

স্বাধীনতার পর কয়েক বছরের মধ্যে সাম্প্রদায়িক রক্তপাত বন্ধ হলেও, ১৯৬০-এর দশক থেকেই বাংলার রাজনৈতিক নীতির গভীরে ঢুকে গিয়েছিল হিংসার বীজ। সেই সময় রাজ্যে ক্রমে জমি হারাচ্ছিল কংগ্রেস (Congress), আর শক্তি বাড়ছিল কমিউনিস্টদের (CPIM)। ফলে প্রধান এই দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে জমি রাজনৈতিক জমি দখলের রক্তাক্ত লড়াই বেধেছিল। ১৯৭০ ১৭ মার্চ, এর সবথেকে ভয়ঙ্কর রূপ দেখা গিয়েছিস। খুন হয়েছিলেন বর্ধমানের (Burdwan) সাই পরিবারের সদস্যরা, যাঁরা ছিলেন কংগ্রেসের প্রবল সমর্থক। 

আরও পড়ুন - 'রামপুরহাট মধ্যযুগীয় বর্বরতা', মমতার পদত্যাগের দাবিতে বিধানসভায় ওয়াকআউট বিজেপির

আরও পড়ুন - 'আমায় ফাঁসি দিন', 'প্রোপাগান্ডা ফিল্ম' কাশ্মীর ফাইলস দেখে এ কী বললেন ফারুক আবদুল্লা

আরও পড়ুন - 'চলছে দেহ লোপাটের চেষ্টা', রামপুরহাটের ঘটনায় অমিত শাহর কাছে অভিযোগ, কী বললেন শুভেন্দু

১৯৭২ থেকে ১৯৭৭ 

একই সময়ে শিলিগুড়ির ছোট গ্রাম নকশালবাড়ি (Naxalbari, Siliguri) থেকে উদ্ভূত হয়েছিল কট্টরপন্থী বাম আন্দোলন, যারা বন্দুকের নলের মাধ্যমে ক্ষমতা জয়ে বিশ্বাস করত। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী (Indira Gandhi) চেয়েছিলেন এই আন্দোলনকে যে কোনও উপায়ে চূর্ণ করতে। সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের (Siddhartha Shankar Roy) নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার, এই ৫ বছরে অতি-বামপন্থীদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়েছিল। সেই সময়ে পুলিশি অত্যাচার ও ভুয়ো এনকাউন্টারের মৃত্যুর অগণিত অভিযোগ ছিল। 

সুচপুর হত্যাকাণ্ড

১৯৭৭ সালে মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় আসার পর, প্রগতিশীল ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে প্রথম কয়েক বছর ব্যাপক জনসমর্থন পেয়েছিল। তবে, সমর্থন হারাতে শুরু করতেই তাদেরও হিংসার দাঁত নখ বের হতে শুর করেছিল। জ্যোতি বসুর (Jyoti Bose) শাসনামলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) উত্থানে প্রবল সহায়ক হয়েছিল ২০০০ সালের ২৭ জুলাই, বীরভূমের সুচপুর (Suchpur Killing) গ্রামে ভূমিহীন মুসলিম শ্রমিকদের হত্যা। ১১ জনকে  পিটিয়ে হত্যা করার অভিযোগ ছিল সিপিআই(এম) ক্যাডারদের বিরুদ্ধে, যাদের বেশিরভাগই পরে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিল।

নন্দীগ্রাম 

২০০০ সালের নভেম্বরে প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য (Buddhadeb Bhattacharya)। মেয়াদের প্রথম কয়েক বছর রাজ্যে শান্তি ধরে রাখতে পারলেও, শিল্প স্থাপনের চেষ্টায় জমি অধিগ্রহণ করতে যেতেই আগুন জ্বলে উঠেছিল রাজ্যে। পূর্ব মেদিনীপুরের (East Midnapore) নন্দীগ্রামে (Nandigram) রাসায়নিক কেন্দ্র স্থাপন করা নিয়ে সিপিআই(এম) এবং তৃণমূল কর্মীদের মধ্যে মারাত্মক সংঘর্ষ বেধেছিল। ২০০৭ সালের ১৪ মার্চ, নন্দীগ্রামে অবরোধ করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন ১৪ জন স্থানীয় বাসিন্দা। আন্দোলনে কৃষক ও তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন মাওবাদীরাও (Maoists)। পরের দুই বছরের ধারাবাহিক সংঘর্ষে ৫০ জনেরও বেশি মানুষের প্রাণ গিয়েছিল। 

২০০৮ পঞ্চায়েত নির্বাচন  ও লালগড় 

২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে রাজনৈতিক হিংসার বলি হয়েছিলেন ২০ জনেরও বেশি মানুষ। তার মধ্যে শাসক ও বিরোধী দুই পক্ষেরই লোক ছিলেন। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে সময় (Lok Sabha Elections 2009), পশ্চিম মেদিনীপুরের (West Midnapore) লালগড়ে (Lalgarh) বহু স্থানীয় সিপিআইএম নেতাকে হত্যা করেছিল মাওবাদীরা।  লালগড় জোনাল কমিটির সেক্রেটারি, অনুজ পান্ডের (Anuj Pandey) বাড়ি ভেঙে ফেলেছিল জনতা।

নেতাই হত্যাকাণ্ড

২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি, নেতাই গ্রামে (Netai Massacre) স্থানীয় এক সিপিআইএম নেতার বাড়িতে অস্ত্র মজুত করা হয়েছে এই অভিযোগে স্থানীয় গ্রামবাসীরা তাঁর বাড়ি ঘেরাও করেছিল। ভিতর থেকে জনতাকে লক্ষ্য করে সিপিএম ক্যাডাররা গুলি চালিয়েছিলেন বলে অভিযোগ। ৯ জন হ্রামবাসীর মৃত্যু হয়েছিল। 

তৃণমূলের বদলা

২০১১ সালে বদলা নয় বদল চাই-এর স্লোগান দিয়ে ক্ষমতা এসেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে, বাংলার হিংসার রাজনীতির ছবিটা বদলানি, বরং আরও খারাপ হয়েছে।  ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে, প্রাক্তন সিপিআই(এম) বিধায়ক প্রদীপ তা (Pradeep Ta) এবং বর্ধমান জেলার নেতা কমল গায়েনকে (Kamal Gain) নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পরের নয় মাসে মোট ৫৬ জন সিপিআই (এম) নেতা-কর্ খুন হয়েছিলেন। 

২০১৮ পঞ্চায়েত নির্বাচন

ভোটের দিন মৃত্যু হয়েছিল ১০ জনের। তবে, গোটা নির্বাচন জুড়েই শাসক দল তৃণমূলের বিরুদ্ধে ব্যাপক হিংসা, হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। ৩৪ শতাংশ আসন তারা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেই জিতেছিল। বহু জায়গায় ভয় দেখিয়ে প্রার্থীদের মনোনয়ন বাতিল করতে বাধ্য করানোর অভিযোগ ওঠে। 

নির্বাচন পরবর্তী হিংসা 

২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় উত্থান ঘটেছিল বিজেপির (BJP)। ৪২ টি আসনের মধ্যে ১৮ টিতে জয় পেয়েছিল তারা। ফলে তৃণমূলেরসামনে তৈরি হয়েছিল নতুন বড় হুমকি। ভোট পরবর্তী হিংসায় ১১ জন পুরুষ এবং ১টি ২ বছরের শিশুর মৃত্যু হয়েছিল। আর, গত বিধানসভা নির্বাচনের পরও তাদের শতাধিক কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে রাজ্য বিজেপি। 

কেন এই হিংসার ধারাবাহিকতা?

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, বাংলার এই রাজনৈতিক হিংসার কয়েক দশকের ইতিহাসের মূলে রয়েছে ১৯৭০-এর দশকের নকশাল আন্দোলন। বামফ্রন্ট সরকার সেই হিংসা পেয়েছিল উত্তরাধিকার সূত্রে। তৃণমূল কংগ্রেসও কোনও ইতিবাচক পরিবর্তন আনার উদ্যোগ নেয়নি। বরং রাজনৈতিক ক্ষমতার সঙ্গে বর্তমানে জড়িয়ে গিয়েছে অর্থনীতি। আর তাতেই হিংসার মাত্রা আরও বাড়ছে।