করুণাময়ী কালীমূর্তির সঙ্গে অনেক পৌরানিক গল্প জড়িয়ে রয়েছে। দেবী মূর্তির কাছে আসা যাওয়া ছিল মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের। আসতেন রাজা মায়মান সিংহ। রয়েছেন অনেক গল্পকথা আর ইতিহাস।
অনিরুদ্ধ সরকার, করুণাময়ী কালীমূর্তি ঘিরে হাজারো কাহিনি। দেবীমূর্তিটি মন্দিরের দোতলায় প্রতিষ্ঠিত। আনুমানিক দু-ফুট উচ্চতার মূর্তিটি কষ্টিপাথরে নির্মিত। দেবীমূর্তি সালঙ্করা, ত্রিনয়না, মুণ্ডমালিনী ও মহাদেবের বক্ষের ওপর দন্ডায়মান। সামনে চন্দনকাঠের সূক্ষ কারুকাজ-শোভিত দরজাটি ৪৫০ বছরের পুরনো। মন্দিরের একতলায় রত্নবেদীটি ১০৮টি শালগ্রাম শিলার উপর প্রতিষ্ঠিত।
সম্রাট আকবর এক বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে যুবরাজ সেলিমকে বাংলাদেশ অভিযানে পাঠান। যশোরের জমিদার প্রতাপাদিত্য যিনি বারোভুঁইয়ার একজন ছিলেন তিনি মা যশোরেশ্বরীর পুজো করতেন নিয়মিত। তিনি দেবীর আশীর্ব্বাদী ফুল নিয়ে মোঘল আক্রমণকে প্রতিরোধ করেন। যুদ্ধে যুবরাজ সেলিম পরাজিত হন। এরপর সম্রাট আকবর সেনাপতি মানসিংহকে দ্বিতীয় বারের জন্য বাংলাদেশ আক্রমনে পাঠান। কৌশলী সেনাপতি মানসিংহ তাঁর চর মারফৎ প্রতাপাদিত্য সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন প্রতাপাদিত্যের শক্তি ও পরাক্রমের উৎস দেবী যশোরেশ্বরী।
সব শুনে মানসিংহ ঠিক করেন তিনি মহারাজের ক্ষমতার উৎসকেই নিয়ে চলে যাবেন। ছক কষলেন মান সিংহ। তিনি এক ব্রাহ্মণের সহায়তায় প্রতাপাদিত্যের মন্দির থেকে যশোরেশ্বরী মাতার বিগ্রহকে সরিয়ে নিজ শিবিরে নিয়ে চলে যান। এই সংবাদে হতবাক হয়ে যান রাজা প্রতাপাদিত্য। তিনি মন্দিরের প্রধান পুরোহিত রামানন্দগিরি গোস্বামীকে এই ঘটনার জন্য অপমান করলেন। অপমানে শোকে বিহ্বল ধার্মিক ব্রাহ্মণ দুঃখে উন্মাদ হয়ে যশোর ত্যাগ করেন। অম্বররাজ ঠিক সেই মুহুর্তে মোঘল বাহিনী নিয়ে প্রতাপাদিত্যের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। পরাজিত হন প্রতাপাদিত্য। প্রতাপাদিত্যকে মানসিংহ বন্দী করে বাংলাদেশ দখল করেন।
বাংলাদেশ অভিযান সফল হওয়ার পর অম্বররাজ মাতৃ বিগ্রহকে অম্বর প্রাসাদে প্রতিষ্ঠা করেন। ইতিহাসের সাক্ষী 'যশোরেশ্বরী' মাতৃবিগ্রহ রাজস্থানের অম্বর ফোর্টে আজও স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। অম্বর ফোর্টে মাতৃবিগ্রহ অধিষ্ঠানের পর মহারাজ মানসিংহ দেবীর কাছে স্বপ্নাদেশ পান যে - তিনি যেন, দেবীর প্রধান পুরোহিত ব্রাহ্মণ রামানন্দগিরি গোস্বামীকে দিয়ে দেবীর বিকল্প করুণাময়ী মাতৃমূর্ত্তি তৈরি করে তিনি যেন প্রতিষ্ঠিত করেন।
দেবীর আদেশে মানসিংহ বাংলাদেশে রামানন্দগিরির খোঁজ শুরু করেন। তারপর যশোরেশ্বরীর বিকল্প করুণাময়ী মাতৃমূর্ত্তিটি প্রতিষ্ঠত করেন। প্রাচীন পুরোহিত রামানন্দগিরির নাম ও নদীর তীরবর্তী ডাঙ্গা অঞ্চলে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় স্থানের নাম হয় ‘রাম-ডাঙ্গা’। পরে যা রামডাঙ্গা থেকে ‘আমডাঙ্গা’ নামে পরিচিতি লাভ করে। পরে মন্দিরটি ‘আমডাঙ্গা করুনাময়ী মঠ’ নামে পরিচিতি লাভ করে। একসময় কালের গর্ভে হারিয়ে যায় মন্দির।
এরপর প্রায় দুশো বছর অতিবাহিত করার পর ১৭৫৬ সালে ইংরেজদের উৎখাত করার জন্য সিরাজদ্দৌলা যখন কলকাতা আক্রমণ করেন তখন নবাবের সেই বাহিনীতে নদীয়াধিপতি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রও ছিলেন। এখনকার মন্দিরটির কাছে নবাবের শিবির হয়েছিল। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র সেই শিবিরের পাশে ঘন জঙ্গলের মধ্যে মাতৃমূর্ত্তির জীর্ণ দশা দেখতে পান। তিনি সেই মাতৃমূর্ত্তির সামনে বসে প্রার্থনা করেন -- " মা আমার মনোকামনা যদি পূর্ণ হয় তা হলে আমি মন্দিরটি সংস্কার করব এবং পূজার ব্যবস্থা করব।"
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজদ্দৌলা পরাজিত হন। নবাব নিহত হওয়ার পর বাংলার সিংহাসনে বসলেন মীরজাফর, তারপর তাকে পরাজিত করে তার জামাতা মীরকাশীম সিংহাসনে বসেন। ১৭৬৪ সালে নবাব মীরকাশীম কৃষ্ণচন্দ্রকে মুঙ্গেরে বন্দী করে প্রাণদন্ডের আদেশ দেন। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের এই বিপদে আমডাঙ্গা করুনাময়ী মন্দিরের মোহান্ত পঞ্চমুন্ডির আসনে বসে করুনাময়ী মাতৃদেবীর আরাধনা করে দৈব শক্তির প্রভাবে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে বিপদ-মুক্ত করেন। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র মাতৃদেবীর এই অপার করুণায় খুশী হয়ে আমডাঙ্গা করুনাময়ী মন্দির সংস্কারে ব্রতী হন।তিনি করুণাময়ী কালী মন্দিরকে ৩৬৫ বিঘা জমি প্রদান করেন।