জন্মেছিলেন ভালবাসা দিবসে
রূপালি পর্দায় তারকা হয়েছিলেন ১৪ বছর বয়সে
ডাক পেয়েছিলেন হলিউডের
স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে চলে যান ৩৬ বছর বয়সে
ভালবাসা দিবস তাঁর জন্মদিন। জন্মসূত্রে নাম মুমতাজ জহান দেহলভি। বাবা আতাউল্লা খান পেশোয়ারের ইয়ুসুফজায়ি গোত্রের পাঠান। কাজ করতেন পেশোয়ারের একটি তামাক কোম্পানিতে। কিন্তু সেই চাকরি একদিন খোয়ানোর পর ভাগ্যের সন্ধানে পাড়ি জমান মুম্বাই। দারিদ্র্যতা আর অসহায়ত্ব এই দুয়ের মাঝে পড়ে পাঁচ-ছয় বছর বয়সেই তার পাঁচ ভাই-বোন মারা যায়। এরপর ১৯৪৪ সালের ১৪ই এপ্রিল মুম্বাই ডকে বিস্ফোরণের ঘটনায় হারিয়ে যায় তাদের ছোট্ট ঘরটিও। পরিবারের এমন দুর্দশার মধ্যে একমাত্র আশার আলো মমতাজ জাহান।
গোঁড়া মুসলমান পরিবারের সেই মেয়ে মাত্র নয় বছর বয়সে সিনেমা দুনিয়ায় পা রাখেন। শিশু শিল্পী হিসেবে অভিনয়ের ডাক পেয়েছিলেন বোম্বে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে। শিশুশিল্পী হিসেবে তার অভিনয় দেখেই তার মধ্যে জাত অভিনেত্রীকে খুঁজে পেয়েছিলেন অনেক ছবি নির্মাতা।
চৌদ্দ বছর বয়সে ‘নীল কমল’ (১৯৪৭) ছবিতে প্রধান অভিনেত্রীর তিনি রাজ কাপুরের সঙ্গে। এরপর ১৯৪৯ সালে রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ অবলম্বনে ‘মহল’। রাতারাতি তিনি সুপার স্টার হয়ে যান। একে একে মুক্তি পায় ‘দুলারি’(১৯৪৯), ‘বেকসুর’(১৯৫০), ‘তারানা’(১৯৫১), ‘বাদল’(১৯৫১) এবং অন্যান্য। সবকটি ছবিই বাণিজ্যিকভাবে সফল। মুমতাজের তারকা খ্যাতি ভারত পেরিয়ে সাড়া ফেলে হলিউডেও।
অভিনেত্রী দেবিকা রানি তাঁর রূপ ও অভিনয় প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে নাম দেন মধুবালা। পরবর্তীতে এই নামেই রূপালি পর্দায় হাজির হন তিনি। ১৯৫২ সালে এক পত্রিকার প্রচ্ছদে তাঁর সাহসী ছবি দেখে অস্কারজয়ী পরিচালক ফ্র্যাঙ্ক কাপরা তাঁকে হলিউডের ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন। কিন্তু বেঁকে বসেন মধুবালার বাবা। অশোক কুমার, রাজ কাপুর, দেব আনন্দ, দিলীপ কুমার, বলিউডের সর্বকালের তারকাদের সঙ্গে অভিনয় করেছেন মধুবালা।
১৯৪৪ সালে প্রথম বার জুটি বাঁধেন মধুবালা-দিলীপ কুমার। অনস্ক্রিনের পাশাপাশি অফস্ক্রিনেও জমে ওঠে তাঁদের সম্পর্ক। কিন্তু দু’জনের বিয়েতে বাধা হয়ে দাঁড়ান মধুবালার বাবা আতাউল্লাহ খান।
‘তারানা’ ছবির সেটেই দিলীপ কুমার আর মধুবালা জড়িয়ে পড়েন গভীর সম্পর্কে। শুটিং চলাকালীন একদিন মধুবালা তার হেয়ার ড্রেসারকে একটি লাল গোলাপ ও উর্দুতে লেখা চিরকুটসহ দিলীপ কুমারের কাছে পাঠান এবং তাকে ভালবাসলে ফুলটি গ্রহণ করতে বলেন। দিলীপ কুমার মুগ্ধ হয়ে ফুলটি গ্রহণ করেন। অনিন্দ্য সুন্দরী মধুবালার প্রেমপ্রার্থীর সংখ্যা কম ছিল না। আর তিনি এটি বেশ উপভোগও করতেন। কিন্তু সত্যিকারভাবে ভালবেসেছিলেন দিলীপ কুমারকেই। দিলীপ কুমারও ভালবেসেছিলেন মধুবালাকে। তারা একসাথে গাঁটছড়া বাঁধারও পরিকল্পনা করেছিলেন।
কিন্তু বাঁধা হয়ে দাঁড়ান মধুবালার বাবা আতাউল্লা খান। তিনি প্রথমে তাদের বিয়েতে রাজি ছিলেন। কিন্তু তিনি পুরো বিষয়টিকে দেখছিলেন একটি বিজনেস ডিল হিসেবে। আতাউল্লা খান ততদিনে একটি প্রোডাকশন হাউসের মালিক। তার পরিকল্পনা ছিল দিলীপ কুমার ও মধুবালার বিয়ের পর শুধুমাত্র তাঁর প্রোডাকশনের ছবিতেই অভিনয় করবেন। কিন্তু আতাউল্লা খানের এ ধরনের আচরণ দিলীপ কুমারের পছন্দ হয়নি। তিনি সরাসরি জানিয়ে দেন ছবি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তিনি নিজস্ব ইচ্ছের বাহিরে যাবেন না, এমনকি তার নিজের প্রোডাকশন হাউস হলেও তিনি এ ধরণের সিদ্ধান্ত নিতেন না। আতাউল্লা খান ক্ষুব্ধ হন এবং মধুবালার সঙ্গে দিলীপ কুমারের সম্পর্কের বিরোধিতা করেন। মধুবালা পড়েন বিপাকে। একদিকে তার ভালবাসা অন্যদিকে পরিবার।
অঘটন ঘটে ‘নয়া দৌড়’ ছবিতে। দিলীপ কুমারের সঙ্গে ওই ছবিতে অভিনয়ের জন্য চুক্তিবদ্ধ হন মধুবালা, অগ্রিম টাকাও নেন তার বাবা। পনের দিন শুটিং-এর পর ঠিক ছিল শুটিং ইউনিট ভোপাল যাবে শুটিং এর জন্য। বেঁকে বসেন আতাউল্লাহ খান। তিনি মধুবালাকে ভোপাল যেতে দিতে নারাজ। তিনি বলেন, দিলীপ কুমারের সঙ্গে মধুবালার প্রেম করার সুযোগ করে দিতেই এই বাহানা। বাবার বাধ্য মেয়ে মধুও মেনে নেন সেটি।
বিপাকে পড়ে প্রযোজক ও পরিচালক বি আর শর্মা মধুবালার পরিবর্তে বৈজয়ন্তীমালাকে অভিনয় করান। মধুবালার বাবার কাছে অগ্রিম টাকা ফেরত চাইলে তিনি তা দিতে অস্বীকার করেন। শেষ পর্যন্ত আদালত পর্যন্ত গড়ায়। আর সেই মামলার সাক্ষ্য দেন দিলীপ কুমার। প্রেমের থেকেও তাঁর কাছে প্রাধান্য পায় নৈতিকতা।
বিষয়টি মধুবালাকে ভীষণ রকম আঘাত করে। পরে তিনি চেয়েছিলেন দিলীপ কুমার যাতে তার বাবার কাছে দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চেয়ে নেয়। কিন্তু দিলীপ কুমার তা করেননি। দিলীপ কুমার মধুবালাকে বিয়ে করার জন্য দুটি শর্ত দিয়েছিলেন। আতাউল্লাহ খানের অর্থলোভী এবং দাম্ভিক আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি মধুকে পরিবার ছাড়তে বলেন। আর স্টুডিওর বদ্ধ পরিবেশে মধুবালা প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়তেন বলে অভিনয়ও ছাড়তে বলেন তিনি। মধুবালা অভিনয় ছাড়তে রাজী হলেও পরিবার ছাড়ার কথা মেনে নিতে পারেননি।
গভীর অভিমান বুকে চেপে তিনি সম্পর্ক ভেঙে দিয়েছিলেন দিলীপ কুমারের সঙ্গে। শুধুমাত্র প্রেমিকের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যই বিয়ে করেছিলেন কিশোর কুমারকে। প্রতিশোধ নেয়ার জন্য বিয়ে করলেও তাদের দাম্পত্য জীবন সুখের ছিল না। কিশোর কুমারও বুঝতে পারতেন যে মধুবালা দিলীপ কুমারকেই ভালবাসেন।
দিলীপ কুমার ও মধুবালার সম্পর্কের উত্থান পতনের সাক্ষী ছিল ‘মুঘল-ই-আজম’। তাদের সম্পর্কের গুঞ্জন যখন ছড়াতে শুরু করেছে, সেই সময় পরিচালক কে আসিফ তাদের কাছে যান ওই ছবির প্রস্তাব নিয়ে। তিনি চেয়েছিলেন তাঁদের মন দেয়া নেওয়ার রসায়ন যাতে জীবন্ত ফুটে ওঠে রূপোলী পর্দায়।
ন’বছর ধরে তৈরি হওয়া ছবিটি সাক্ষী আরও বেশী কিছুর। দিলীপ কুমার-মধুবালার তুমুল প্রেম, সে প্রেমে ভাঙনের সুর, এরপর বেদনা-বিধুর বিচ্ছেদ জীবন্ত হয়ে ফুটে ওঠে পর্দার সেলিম-আনারকলির চরিত্রে। সেটে তাঁরা পরস্পরের সঙ্গে কথা বলতেন না। কিন্তু উপহার দিয়েছেন নিজেদের সেরা অভিনয়।
‘মুঘল-ই-আজম’ মুক্তি পায় ১৯৬০ সালে। ওই ছবির পর আর মাত্র পাঁচটি ছবিতে অভিনয় করতে পেরেছিলেন মধুবালা। কারণ ততদিনে তার শারীরিক অসুস্থতা প্রকট হয়ে ওঠে। ছোটবেলা থেকেই তাঁর হৃৎপিণ্ডে একটি ফুট ছিল। মধুবালা আগেই তা জানতেন। কিন্তু তার জন্য যদি কাজের সুযোগ না পান, সেই ভয়ে তার বাবা প্রকাশ করতে বারণ করেন। অসুস্থ শরীর নিয়ে তিনি নিয়মিত কাজ করে যান পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য।
দুঃসহ যন্ত্রণায় ন’টি বছর পার করে ২৩ই ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সালে মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে চলে রূপোলী পর্দার ভালবাসার প্রতিমা মধুবালা।