'ওয়ক্ত নে কিয়া ক্যায়া হসীন সিতম', এ যেন গুরু দত্ত ও গীতা দত্তের জীবনেরই লাইন

৪৯ বছর আগে আজকের দিনে প্রয়াত হয়েছিলেন, কিংবদন্তি বাঙালি গায়িকা গীতা দত্ত। তাঁর জীবন সঙ্গীটিও ছিলেন আর এক কিংবদন্তি, কিন্তু তাঁদের জীবন অত্যন্ত ট্র‍্যাজিক।

Asianet News Bangla | Published : Jul 20, 2021 5:26 PM IST / Updated: Jul 20 2021, 11:11 PM IST

তপন বক্সি: আজ থেকে ঠিক ৪৯ বছর আগে আজকের দিনে প্রয়াত হয়েছিলেন কিংবদন্তি বাঙালি গায়িকা গীতা দত্ত। তাঁর জীবন সঙ্গীটিও ছিলেন আর এক কিংবদন্তি। তিনি অনন্য প্রতিভাধর সিনেমা পরিচালক গুরু দত্ত। আর জুলাই মাসটিও ওঁদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে জড়িয়ে গিয়েছে নাটকীয় ভাবে।

গুরুদত্ত এবং তাঁর বড় ছেলে তরুণ দত্তর  জন্মদিন একই দিনে। ৯ জুলাই। আর মেজ ছেলে অরুণের জন্মদিন তার ঠিক পরের দিন। ১০ জুলাই। গুরু এবং গীতার তিন ছেলে আর এক মেয়ে। তরুণ, অরুণ আর নিনা।

এঁদের মধ্যে বড় ছেলে তরুণের মৃত্যু হয় গুরু দত্তের মতই অস্বাভাবিক ভাবে। ঠিক কি কারণে আর কীভাবে মৃত্যু হয়েছিল তরুণের, আজ পর্যন্ত তা পরিষ্কার নয়। মেজ ছেলে অরুণ ২০১৪-র ২৬ জুলাই পুনায় মারা যান কিডনি ফেইলিওর হয়ে। আর আজকের দিন অর্থাৎ ২০ জুলাই, ১৯৭২, অকালে মারা যান অসামান্য প্রতিভাধর  বাঙালি গায়িকা গীতা দত্ত।
গুরু আর গীতার পারিবারিক মৃত্যুগুলি সবই ঘটেছে অকালে, অসময়ে। অত্যন্ত ট্র‍্যাজিক ভাবে।

১৯৭২ সালের ২০ জুলাই  মুম্বইয়ের সান্তাক্রুজের 'অমিয় কুটির' বাংলোয় গীতা তখন অচৈতন্য অবস্থায় বিছানার উপর। নাক কান মুখ দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। এমনকি সেই রক্তের দাগ ঘরের দেওয়ালেও লেগে। সিরোসিস অফ লিভারে আক্রান্ত ৪১ বছরের অনন্য সাধারণ বাঙালি গায়িকা গীতা দত্ত। যাঁর কন্ঠ থেকে বেরিয়ে ছিল একের পর এক 'নিশি রাত বাঁকা চাঁদ আকাশে', 'কাঁচের চুড়ির ছটা খেয়াবাজের ছলনা', 'ওই সুর ভরা দূর নীলিমায়', এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়', 'একটু চাওয়া আর একটু পাওয়া' কিম্বা হিন্দিতে 'আর পার' ছবির 'বাবুজি ধীরে চল না, প্যায়ার মেঁ জারা সমভল না'-র মত গান।

আরও পড়ুন - মাত্র ৩ হাজার টাকার জন্য অনুনয়-বিনয়, সুরকার হিসেবে একসময় বলিউডে রাজ করেছিলেন 'ও পি নাইয়ার'

অথচ গুরু এবং গীতার সম্পর্কের শুরুটা ছিল 'নিশি রাত বাঁকা চাঁদ আকাশ'-এর মতই। তখন কে জানত, তার শেষে অপেক্ষা করে আছে দুঃস্বপ্নের রাত আর করুণ মৃত্যু মিছিল। 

তখনকার বাংলাদেশের মাদারিপুর সাব ডিভিশনের অন্তর্গত ফরিদপুরের 'ঘোষ রায়চৌধুরী' পরিবারের মেয়ে গীতা। চার-এর দশকের প্রথম দিকে যাঁর পরিবার বাংলাদেশ থেকে চলে এসেছিল কলকাতায়। ১৯৪২ সালে সেই ঘোষ রায়চৌধুরী পরিবারের দেবেন্দ্রনাথ ঘোষ রায়চৌধুরী তাঁর পরিবারকে নিয়ে চলে এসেছিলেন মুম্বইয়ের  দাদার অঞ্চলে।

গান জানা, গান শেখা পরিবারের শ্যাম বর্ণা গভীর সংবেদনশীল গীতা তখন বাংলা মিডিয়ামে পড়া ১২ ক্লাসের ছাত্রী। দাদারের তিলক ব্রিজের পাশেই হিন্দু কলোনিতে থাকতে শুরু করল ঘোষ রায় চৌধুরী পরিবার।

বাড়িতে গানের রেওয়াজ করছিলেন গীতা। সেখান দিয়ে যাতায়াতের পথে সুরকার কে. হনুমান প্রসাদ গীতার গানের গলা শুনতে পেয়েছিলেন। তিনি গীতাকে 'ভক্ত প্রহ্লাদ' (১৯৪৬) ছবির দুটি গানে দুটি লাইন করে গাওয়ালেন। হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে গীতা রায় গায়িকা হিসেবে পরিচিতি পেলেন।  নজরে এলেন শচীন দেব বর্মনের। এই সেই বাঙালি মেয়ে, পাঁচের দশকের শেষ দিকে যাঁর আবির্ভাব লতা মঙ্গেশকরকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল।

একদিকে শচীন দেববর্মণ আরেক দিকে ও.পি নায়ার, হিন্দি সিনেমার এই দুই দিকপাল সঙ্গীতকার তখন গীতাকে দিয়ে গাওয়ানোর জন্যই উঠে পড়ে লেগেছেন। চিন্তিত লতা মঙ্গেশকর। কেননা দুজনের শুরুটা প্রায়  একই সময়ে। আর আশা ভোঁসলে গীতা দত্তকেই ধ্যানে স্বপনে নিয়ে চোখ বুঁজে গান করছেন। নিজের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের অশান্তির ছায়ায় গীতা যখন রেকর্ডিংয়ে অনিয়মিত হয়ে পড়ছেন, বাধ্য হয়ে শচীনকর্তা তখন লতাকে খুঁজছেন আর নায়ার সাহেব কাছে টেনে নিয়েছেন আশাকে।

আরও পড়ুন - কীভাবে অকালে নিভে যায় গীতা দত্তের মতো স্বর্নালী কন্ঠের শিল্পীজীবন

সে সময় মানসিকভাবে বিধ্বস্ত, ব্যথা জড়ানো গলায় গীতার ফোন পেয়েছেন ও.পি.নায়ার। 'নায়ার সাব, আপ মুঝে আজকাল কিঁউ নহি বুলাতেঁ?' অসহায় নায়ার সাহেব গীতাকে সেদিন শুধু আপ্তবাক্য শুনিয়ে গিয়েছেন গীতাকে।'ডাকব গীতা, নিশ্চয়ই ডাকব তোমাকে।'

'ভক্ত প্রহ্লাদ'-এর পরের বছরই শচীন দেব গীতাকে দিয়ে 'মেরা সুন্দর সপনা বিত গয়া'('দো ভাই '/১৯৪৭) আর 'উও স্বপ্নেওয়ালি রাত'('প্যায়ার'/১৯৫০) গাওয়ালেন। তার পরের বছরই দেব আনন্দের নবকেতন ফিল্মসের দ্বিতীয় ছবি 'বাজি'-তে প্রায় সবকটি ফিমেল ভয়েসেরই রেকর্ডিং করলেন গীতা। আর এই 'বাজি' ছিল স্বাধীন পরিচালক হিসেবে গুরু দত্তের প্রথম  ছবি। 'বাজি'-র গান রেকর্ডিং এ গীতাকে প্রথম দেখেন গুরু দত্ত। সেই পরিচয় পরে প্রেমে পরিণত হয়েছিল। গীতার সঙ্গে পরিচয়ের পর গুরু  বেশিরভাগ সময় গড়গড়িয়ে বাংলাতেই কথা বলতেন গীতার সঙ্গে।

শুনলে অদ্ভুত মনে হলেও সত্যি 'গুরু দত্ত' এই নামটি গুরু দত্তের আসল নাম নয়। বেঙ্গালুরুতে জন্মের সময় তাঁর নাম ছিল বসন্ত কুমার শিবশঙ্কর পাড়ুকোন। বসন্ত কুমারকে ছোটবেলায় পড়াশোনার জন্য কলকাতায় পাঠানো হয়েছিল। কলকাতার পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে বসন্তকুমার উদয়শংকর ডান্স একাডেমিতে নাচের শিক্ষা নিয়েছিলেন।

পরে বসন্ত কুমার  এক দুর্ঘটনার মুখোমুখি হয়েছিলেন। তখন তাঁর পরিবার থেকেই 'বসন্ত'-র বদলে 'গুরু' এবং কলকাতার বাঙ্গালিদের পদবি হিসেবে 'দত্ত'-কে গ্রহণ করে 'বসন্ত পাড়ুকোন'-এর  নতুন নামকরণ করা হয় 'গুরু দত্ত'। শুধু পড়াশোনা বা নাচের শিক্ষা নয়, গুরু দত্ত কলকাতাতে তাঁর জীবনের প্রথম চাকরিও করেছিলেন লিভার ব্রাদার্স- এর টেলিফোন অপারেটরের। পরে এই চাকরি ছেড়ে তিনি পুনার 'প্রভাত ফিল্মস'-এ  যোগ দেন। সুতরাং গুরু দত্তের সঙ্গে কলকাতা, কলকাতার বাঙালি জীবন আগে থেকেই  জড়িয়ে ছিল।

বম্বের মাতুঙ্গায় পরিবারের সবার সঙ্গেই থাকতেন গুরু দত্ত। 'বার্মা শেল' কোম্পানিতে চাকরি করা বাবা আর স্কুল টিচার মায়ের চার পাঁচ ভাইবোনের সংসারে তেমন কোনও বিলাসব্যসন ছিল না।  সেই বাড়িরই একটি ঘরের কাঠের চেয়ার টেবিলে বসে গুরু দত্ত তাঁর জীবনের বেশিরভাগ ছবির চিত্রনাট্য লিখেছেন। তারমধ্যে 'প্যায়াসা'-ও ছিল। শুনেছি 'প্যায়াসা' গুরু দত্তের বাবার জীবন কাহিনী নিয়ে লেখা। কবিতা লেখা বাবার সঙ্গে গুরু দত্তের মায়ের কোনওদিনই মনের মিল ছিল না।

আরও পড়ুন - স্বর্ণযুগের ইতিকথা, মুম্বই ফিল্মের সঙ্গীত দুনিয়ায় আশা ভোঁসলে একাই গানের মেহেবুবা

গুরু দত্তর বোন ললিতা লাজমি। যিনি একজন কমার্শিয়াল আর্টিস্ট এবং এখনও জীবিত। সেই ললিতার মেয়েই হলেন পরিচালক কল্পনা লাজমি।মাত্র ২/৩ বছর আগে যিনি অকালে প্রয়াত হয়েছেন।

গুরু দত্ত বা 'পাড়ুকোন পরিবার '-এর সঙ্গে যোগ রয়েছে আরও অনেক সিনেমা ব্যক্তিত্বের। শ্যাম বেনেগাল হলেন গুরু দত্তর ফার্স্ট কাজিন। বিখ্যাত অভিনেতা গিরিশ কারনাড, অনন্ত নাগ, প্রকাশ পাড়ুকোন দীপিকা পাড়ুকোনেরাও এই পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত।

১৯৫১ সালে 'বাজি' ছবির গান রেকর্ডিংয়ে দেখা হওয়া  এহেন গুরু দত্ত ১৯৫৩-র মে মাসে ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন গীতাকে। 'বাজি' ছাড়াও বিয়ের পর 'আর-পার', 'মিঃ অ্যান্ড মিসেস ৫৫', 'সিআইডি ', 'প্যায়াসা', 'কাগজ কে ফুল', 'সাহেব বিবি অউর গুলাম', এর মত ছবিগুলিতে গীতা গেয়ে গিয়েছেন একচেটিয়া।

বলিউডের প্রবীণেরা বলেন, গীতা নিজেও নায়িকা হতে চেয়েছিলেন। সেই মত  গীতাকে নায়িকা করে গুরু কলকাতায় একটি ছবি 'গৌরী'-র তোড়জোড় করেছিলেন। সিনেমাস্কোপে তৈরি হওয়ার কথা ছিল। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা চিত্রনাট্য, শচীন দেব বর্মনের সুরে দু একটি গান রেকর্ডিংও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেই ছবি শেষমেশ হয়ে ওঠেনি।

আসল কথা হল, গুরু-গীতার বিয়ের দু বছর পরই হায়দরাবাদ থেকে মুম্বইতে নায়িকা হতে আসা ওয়াহিদা রেহমানকে তাঁর চার চারটি ফিল্মের স্যালারাইড নায়িকা হিসেবে চুক্তিবদ্ধ করেছিলেন গুরু দত্ত। আর তারপর থেকেই গুরু অন্তঃপ্রাণ গীতার  বিশ্বাসের জমি টলে গিয়েছিল। সংবেদনশীল, আবেগপ্রবণ, ক্রিয়েটিভ পরিচালক হিসেবে গুরু দত্ত হিন্দি সিনেমায় যে জায়গাটি করেছিলেন, সেখানেই কাঁটা হয়ে বসে গেল 'গীতা দত্ত' আর 'ওয়াহিদা রেহমান'-এর নাম।

শুরু হলো সন্দেহ, বাদানুবাদ আর পারস্পরিক অবিশ্বাসের খেলা। মনে মনে ব্যক্তিগতভাবে রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত হতে থাকলেন গুরু ও গীতা। গুরুর চিত্রনাট্যের পাতায় লিখে আসা নিঃসঙ্গ, বিষণ্ণ, যন্ত্রণামাখা চরিত্রগুলি যেন নিজের ব্যক্তিগত জীবনেই জায়গা করে নিল। গীতা আর গুরু দুজনেরই সঙ্গী হয়ে উঠল মদের বোতল।

১৯৬৪-র ১০ অক্টোবর দক্ষিণ  বম্বের অ্যাপার্টমেন্টে গুরু তখন একা থাকেন। গীতা আলাদা থাকেন ছেলেমেয়েদের নিয়ে সান্তাক্রুজের 'অমিয় কুটির'-এ। সেই রাতে গুরু খালি পেটে মদ খাওয়ার পর কয়েকটি স্লিপিং পিল নিয়ে নিয়েছিলেন। সেদিনই ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেন গুরু। কত বয়স তখন গুরুর? মাত্র ৩৯।

তারপর গীতার বেঁচে থাকা ছিল তিলে তিলে নিজেকে শেষ করার নামান্তর। আর তার সাড়ে সাত বছরের মাথায়  ১২০০ -র মত গান গেয়ে (যার বেশিরভাগ হিন্দি, সেইসঙ্গে কিছু বাংলা, কিছু গুজরাতি, যার শতকরা ৫০ ভাগই ছিল সুপারলেটিভ)চলে গেলেন গীতাও। মাত্র ৪১ বছর বয়সে। অকালে। আজ গীতার মেয়ে, জামাই, কয়েকজন নাতি নাতনিরা সেই স্মৃতি বুকে আঁকড়ে দিন কাটাচ্ছেন। কে জানত, ১৯৫৯-এর গুরু দত্তর ছবি 'কাগজ কে ফুল'-এ কয়ফি আজমির লেখা, গীতা দত্তর নিজেরই গাওয়া সেই গানটিই ('ওয়ক্ত নে কিয়া ক্যায়া হসীন সিতম/ তুম রহে না তুম/ হম রহে না হম'...)ওঁদের ব্যক্তিগত জীবনেই প্রতিফলিত তার কয়েক বছরের মধ্যে।

Share this article
click me!