নিজের আসন্ন মৃত্যুকে কি অনুভব করতে পেরেছিলেন কিশোর কুমার? তা নাহলে অনুষ্ঠানের শেষের দিকে এসে কেন তিনি সেদিন ভারাক্রান্ত মনে মাইকের সামনে বললেন, 'হয়তো কলকাতায় এটাই আমার শেষ আসা।' কেন তিনি পরপর দুটি বাংলা স্যাড সং ('তোমার বাড়ির সামনে দিয়ে আমার মরণযাত্রা' আর 'আশা ছিল ভালোবাসা ছিল') অনুষ্ঠানের শেষ গানটিও ধরলেন দুঃখের সুরেই? 'আমি যে কে তোমার / তুমি তা বুঝে নাও'...? আর সেই গানের মাঝামাঝি 'ওপারের ডাক যদি আসে / শেষ খেয়া হয় পাড়ি দিতে'...যখন তিনি গাইছিলেন সুর তখন সত্যিই কান্না হয়ে ঝরছে কিশোর কুমারের গলায়।
তপন বক্সী, মুম্বই: ১৯৮৭-র ১৩ ডিসেম্বর, কিশোর কুমার যেদিন মারা যান, তখন আমি কলকাতায়। তার মাত্রই কয়েক মাস আগে কলকাতা পুলিশ বেবনেভলেন্ট ফান্ডের পক্ষ থেকে নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে কিশোর কুমার নাইটের আয়োজন করা হয়েছিল। স্টেজের খুব সামনে প্রেস এনক্লেভে বসে সরাসরি সামনে থেকে কিশোর কুমার লাইভ অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ হয়েছিল সেবার।
অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ দেখলাম, পুরো স্টেডিয়ামের আলো নিভিয়ে অন্ধকার করে দেওয়া হল। তারপরই ঘূর্ণায়মান স্পটলাইট অন্ধকার স্টেডিয়ামে কিশোর কুমারকে খুঁজে চলল। আমরা স্টেডিয়ামের কিশোর কুমারের গলা শুনতে পাচ্ছি। তিনি নানারকম শব্দ করছেন। একবার বাংলায় বলছেন 'আমি এসে গেছি।' আবার হিন্দিতে বলছেন, 'ম্যাঁয় আয়া হুঁ। আ গয়া হুঁ।' আর তারপরেই বুম চিক বুম চিক, এরকম নানা রকম মজাদার শব্দ বার করতে থাকলেন। স্পট লাইটের সঙ্গে সঙ্গে সবার চোখের মণি তখন চারদিকে ঘুরপাক খাছে। এই বোধহয় কোনও কিছু দেখা যাবে। এই বোধহয় ওই দিকের কোণ থেকে কিশোরকুমারকে দেখা যাবে...। কিন্তু কোথায় তিনি? এভাবে মিনিট পাঁচেক চলল।
অবশেষে এক স্পটলাইটের ঝলকে তাঁকে দেখলাম আমি। স্টেডিয়ামের ফ্লোর থেকে ১৬ ফুট উঁচু স্টেজ। সেই স্টেজের চারদিক থেকে ঘন কালো কাপড় ফ্লোর পর্যন্ত নামানো পর্দার মতো। স্টেজের নিচের পর্দা একফালি সরিয়ে সেখানে থেকেই উঁকি মারছেন কিশোর কুমার। অন্ধকার স্টেডিয়ামের একটা জোরদার স্পটলাইট তখন তাঁর মুখে। মাথায় সাদা পশমের কাশ্মীরি টুপি। পরনে ঘনকালো পাঠান স্যুট। আর গলায় তিন ফুটের সাদা কড়ির মালা। চোখের স্কোয়্যার ফ্রেমের কালো চশমা। সেখান থেকেই হাত নেড়ে সবার অভিনন্দন নিলেন এবং অভিবাদন দিলেন। তারপরই স্টেজে ওঠার পালা।
স্টেজে উঠেই তিনি গান ধরলেন, 'এ আমার গুরুদক্ষিণা/ তোমাকে জানাই প্রণাম।' আজ পর্যন্ত যতগুলি লাইভ প্রোগ্রাম আমি শুনেছি,সেখানে একই শিল্পীর রেকর্ডেড গানের সঙ্গে লাইভ পারফরম্যান্সের কিছু-না-কিছু ফারাক কানে এসেছে। হয়তো সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কিশোর কুমারের লাইভ পারফরম্যান্স সামনে থেকে দেখা এবং শোনার সময় মাঝে মাঝে চোখ বন্ধ করে ফারাক খোঁজার চেষ্টা করেও কোন ফারাক খুঁজে পাইনি। মাঝেমাঝে নিজের কানকেই অবিশ্বাস্য লাগছিল, মনে হচ্ছিল, এটা কি রেকর্ডেড গান শুনছি, নাকি লাইভ?
মোট ৩৫ টি গান সেদিন গেয়েছিলেন কিশোর কুমার। এই পঁয়ত্রিশটি গানের লম্বা সময়ের মাঝখানে ১০+১০ মিনিটের দুটি ছোট ব্রেক নিয়েছিলেন শুধু। কি গাননি তিনি সেদিন? উজাড় করে গেয়েছিলেন। 'ইনা মিনা ডিকা' যেমন গেয়েছিলেন, তেমনই গেয়েছিলেন, 'হমে অউর জিনে কি চাহত না হোতি/ অগর তুম না হোতে', থেকে শুরু করে 'ওপারে থাকব আমি /তুমি রইবে এপারে' থেকে 'ম্যাঁয় শায়র বদনাম'...। সবরকম মুডের গান। আর সবই তো সুপার হিট। কোনও পরিসংখ্যান ডেটার সামনে না বসেই সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম, কিশোর কুমারের সারাজীবনের গাওয়া গানের শতকরা ৯৫ ভাগই হিট।
নিজের আসন্ন মৃত্যুকে কি অনুভব করতে পেরেছিলেন কিশোর কুমার? তা নাহলে অনুষ্ঠানের শেষের দিকে এসে কেন তিনি সেদিন ভারাক্রান্ত মনে মাইকের সামনে বললেন, 'হয়তো কলকাতায় এটাই আমার শেষ আসা।' কেন তিনি পরপর দুটি বাংলা স্যাড সং ('তোমার বাড়ির সামনে দিয়ে আমার মরণযাত্রা' আর 'আশা ছিল ভালোবাসা ছিল') অনুষ্ঠানের শেষ গানটিও ধরলেন দুঃখের সুরেই? 'আমি যে কে তোমার / তুমি তা বুঝে নাও'...? আর সেই গানের মাঝামাঝি 'ওপারের ডাক যদি আসে / শেষ খেয়া হয় পাড়ি দিতে'...যখন তিনি গাইছিলেন সুর তখন সত্যিই কান্না হয়ে ঝরছে কিশোর কুমারের গলায়। আর চোখের সামনে রেকর্ডকে ছাপিয়ে যাওয়া জ্যান্ত কিশোর কুমার যখন গানের সুরে সত্যিকারের কাঁদেন, তার রেশের কথা ভাবতে গেলে এখনও রোমকূপ দাঁড়িয়ে যায়।